প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় ‘জেল হত্যা দিবস’
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ১০:৩৫ এএম, ৩ নভেম্বর ২০২১ বুধবার | আপডেট: ১০:৩৬ এএম, ৩ নভেম্বর ২০২১ বুধবার
১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর। মধ্যরাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে একটি পিকআপ এসে থামে। রাত তখন আনুমানিক দেড়টা থেকে দুইটা।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায়, সে গাড়িতে কয়েকজন সেনা সদস্য ছিল।
ঢাকা তখন অস্থিরতার নগরী। সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে অভ্যুত্থান এবং পাল্টা অভ্যুত্থান নিয়ে নানা রকম কথা শোনা যাচ্ছে। সে সময় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জেলার হিসেবে কর্মরত ছিলেন আমিনুর রহমান। রাত দেড়টার দিকে কারা মহাপরিদর্শক টেলিফোন করে জেলারকে তাৎক্ষনিকভাবে আসতে বলেন। দ্রুত কারাগারের মূল ফটকে ছুটে যান জেলার। গিয়ে দেখেন, একটি পিকআপে কয়েকজন সেনা সদস্য সশস্ত্র অবস্থায় আছে।
মূল ফটকের সামনে সেনা সদস্যরা কারা মহাপরিদর্শককে একটি কাগজ দিলেন। সেখানে কী লেখা ছিল সেটি অবশ্য জানতে পারেননি জেলার আমিনুর রহমান। মূল ফটক দিয়ে ঢুকে বাম দিকেই ছিল জেলার আমিনুর রহমানের কক্ষ। তখন সেখানকার টেলিফোনটি বেজে উঠে। আমিনুর রহমান যখন টেলিফোনের রিসিভারটি তুললেন, তখন অপর প্রান্ত থেকে বলা হলো প্রেসিডেন্ট কথা বলবেন।
২০১০ সালে বিবিসি বাংলার কাছে সে ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে আমিনুর রহমান বলেন, “টেলিফোনে বলা হলো প্রেসিডেন্ট কথা বলবে আইজি সাহেবের সঙ্গে। তখন আমি দৌড়ে গিয়ে আইজি সাহেবকে খবর দিলাম। কথা শেষে আইজি সাহেব বললেন যে- প্রেসিডেন্ট সাহেব ফোনে বলছে আর্মি অফিসাররা যা চায়, সেটা তোমরা কর।”
মূল ফটকের সামনে কথাবার্তার চলতে থাকে। এক সময় রাত তিনটা বেজে যায়।
আমিনুর রহমান বলেন, “এক পর্যায়ে কারাগারে থাকা তৎকালীন আওয়ামী লীগের চার জন নেতাকে একত্রিত করার আদেশ আসে।”
কারা মহাপরিদর্শক একটি কাগজে চার ব্যক্তির নাম লিখে জেলার আমিনুর রহমানকে দিলেন। সে চারজন হলেন - সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামান।
আমিনুর রহমানের বর্ণনা অনুযায়ী- সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং তাজউদ্দীন আহমদ কারাগারের একটি কক্ষে ছিলেন। ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামানকে অপর কক্ষ থেকে এখানে নিয়ে আসা হয়। সেখানে আসার আগে ক্যাপ্টেন মনসুর আলী কাপড় পাল্টে নিলেন।
আমিনুর রহমান বর্ণনা করেন, “তাজউদ্দীন সাহেব তখন কোরআন শরীফ পড়ছিলেন। ওনারা কেউ আমাদের জিজ্ঞেস করলেন না আমাদের কোথায় নেও (নেয়া হচ্ছে)? সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব হাত-মুখ ধুলেন। আমি বললাম আর্মি আসছে।”
চারজনকে যখন একটি কক্ষে একত্রিত করার ক্ষেত্রে কিছুটা সময় লাগার কারণে সেনাসদস্যরা কারা কর্মকর্তাদের নোংরা ভাষায় গালিগালাজ করছিল।
আমিনুর রহমান, “মনসুর আলি সাহেব বসা ছিল সর্ব দক্ষিণে। যতদূর আমার মনে পড়ে। আমি মনসুর আলীর ‘ম’ কথাটা উচ্চারণ করতে পারি নাই, সঙ্গে সঙ্গে গুলি।”
কারাগারের ভেতর এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের খবর চার নেতার পরিবার সেদিন জানতে পারেননি। তাজউদ্দীন আহমদের পরিবার কারাগারের খোঁজ নেবার জন্য সারাদিন চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। পরের দিন অর্থাৎ ৪ নভেম্বর পুরনো ঢাকার এক বাসিন্দা তাজউদ্দীন আহমদের বাসায় এসে জানান যে তিনি আগের দিন ভোরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গুলির শব্দ শুনেছেন।
প্রয়াত তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে সিমিন হোসেন রিমি ২০১০ সালে বিবিসি বাংলাকে বলেন, ৪ নভেম্বর বিকেল চারটার দিকে খবর আসতে শুরু করলো তাজউদ্দীন আহমদসহ চারজন নেতাকে হত্যা করা হয়েছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবর রহমানকে সপরিবারে হত্যার ঘটনার সঙ্গে জেল হত্যাকাণ্ডের যোগসূত্র রয়েছে।
তখন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে লে. কর্নেল হিসেবে কর্মরত ছিলেন আমিন আহমেদ চৌধুরী, যিনি পরবর্তীতে মেজর জেনারেল হয়েছিলেন।
২০১০ সালে তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, তখন সেনাবাহিনীতে নেতৃত্ব নিয়ে টানাপোড়েনের পরিণতি ছিল জেলখানার হত্যাকাণ্ড।
১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের বিপরীতে পাল্টা আরেকটি অভ্যুত্থান হয়েছিল তেসরা নভেম্বর। সেটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফ।
আমিন আহমেদ চৌধুরীর মতে, তেসরা নভেম্বরের অভ্যুত্থানটি ছিল অনিবার্য। কারণ বঙ্গবন্ধুকে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছয়জন জুনিয়র সেনা কর্মকর্তা তখন বঙ্গভবনে বসে রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাককে পরিচালনা করছিলেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছয়জন জুনিয়র সামরিক কর্মকর্তাকে সেনাবাহিনীর চেইন অব কমাণ্ডের আওতায় আনার জন্য তেসরা নভেম্বর খালেদ মোশারফের নেতৃত্ব অভ্যুত্থান হয়েছিল বলে উল্লেখ করেন জেনারেল আমিন আহমেদ চৌধুরী।
তাছাড়া বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডকেও তারা মেনে নিতে পারছিলেন না বলে তিনি উল্লেখ করেন। কিন্তু খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে সে অভ্যুত্থান সেনাবাহিনীর ভেতরে আবারো চেইন অব কমাণ্ড ভাঙার সম্ভাবনা তৈরি করেছিল বলে মনে করেন জেনারেল চৌধুরী। শুধু তাই নয়, খালেদ মোশারফের অনুগত সৈন্যরা সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে বন্দি করে।
ঢাকা সেনানিবাসে যখন এ অবস্থা চলছিল সে সময় পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে জেলখানায় আওয়ামী লীগের চারজন সিনিয়র নেতাকে হত্যা করা হয়।
পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টিতে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর থেকেই হত্যাকারী সেনা কর্মকর্তারা পাল্টা আরেকটি অভ্যুত্থানের আশংকায় ছিল। সেনাবাহিনীর মধ্যে ছিল এক ধরনের বিশৃঙ্খলা। সিনিয়র সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিল ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। একদিকে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং অন্যদিকে মেজর জেনারেল খালেদ মোশারফ। তখন ঢাকা সেনানিবাসে মেজর পদমর্যাদায় কর্মরত ছিলেন বিগ্রেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি এসব ঘটনাপ্রবাহ বেশ কাছ থেকে দেখেছেন।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যাকারী সেনা কর্মকর্তারা তখন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদকে পরিচালনা করছিলেন।
ব্রিগেডিয়ার হোসেন বলেন, “বঙ্গভবনের থাকা সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে একটা সংঘাত চলছিল সেনানিবাসের উর্ধ্বতন কিছু সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে।”
“খন্দকার মোশতাক যে বেশিদিন ওখানে টিকবেন না, এটাও ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে সিনিয়র অফিসারদের মধ্যে একটা ধারণা জন্মেছিল। তখন আবার সিনিয়র অফিসারদের মধ্যেও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ছিল,” বলছিলেন ব্রিগেডিয়ার হোসেন।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যাকারী সেনা কর্মকর্তারা ধারনা করেছিলেন যে কোন পাল্টা অভ্যুত্থান হলে সেটি আওয়ামী লীগের সমর্থন পাবে। সে ধরনের পরিস্থিতি হলে কী করতে হবে সে বিষয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী সেনা কর্মকর্তারা কিছুটা ভেবেও রেখেছিলেন।
তিনি বলেন, “ঐ ধরনের ক্যু হলে তখনকার আওয়ামী লীগে যাতে কোন ধরনের লিডারশিপ না থাকে সেটাই তারা বোধ হয় নিশ্চিত করেছিল।”
হত্যাকারী সেনা কর্মকর্তারা ভেবেছিল চারজন রাজনীতিবিদকে যদি হত্যা করা হয় তাহলে পাল্টা অভ্যুত্থান হলেও সেটি রাজনৈতিক সমর্থন পাবে না।
সূত্র : বিবিসি বাংলা
এসএ/