ঢাকা, রবিবার   ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪,   আশ্বিন ৭ ১৪৩১

ভয়াল সিডর: এখনও আতঙ্ক কাটেনি অরক্ষিত উপকূলবাসীর

বরগুনা প্রতিনিধি

প্রকাশিত : ১১:৪৩ এএম, ১৫ নভেম্বর ২০২১ সোমবার | আপডেট: ১১:৪৫ এএম, ১৫ নভেম্বর ২০২১ সোমবার

১৫ নভেম্বর। উপকূলবাসীর ইতিহাসে বিভীষিকাময় একটি দিন। এই দিনটি দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের কাছে এখনও এক দুঃস্বপ্ন। ভয়াল ঘূর্ণিঝড় সিডরের আঘাতে সেদিন উপকূলীয় এলাকা দেখেছিলো ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ। শতাব্দীর অন্যতম ভয়াবহ ওই ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারিয়েছিল হাজারো মানুষ। নিখোঁজ হয়েছিল আরও সহস্রাধিক। 

সিডরের ১৪ বছর পেরিয়ে গেলেও আজ পর্যন্ত ধকল কাটেনি উপকূলবাসীর। ক্ষতচিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছেন নিহতের স্বজনরা। ঘরবাড়ি আর সহায় সম্বল হারানো মানুষ সেই ক্ষতি এখনও পুষিয়ে উঠতে পারেননি।

২০০৭ সালের এদিনে ঘূর্ণিঝড় সিডরে বরগুনা জেলায় সরকারি হিসাব অনুযায়ী ১ হাজার ৩৪৫ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। নিখোঁজ ছিলেন আরও ১৫৬ জন। তবে বেসরকারি হিসাবে নিহতের সংখ্যা প্রায় ২ হাজার। আর আহতের সংখ্যা ২৮ হাজার ৫০ জন। 

এ জেলার ২ লাখ ১৩ হাজার ৪৬১ পরিবারের মধ্যে বসতঘর বিধ্বস্ত হয়েছে ১ লাখ ৮৯ হাজার ৭৮৫টি, ফসলের ক্ষতি হয়েছে ২ লাখ ৪৩ হাজার ৩৯৩ একর, গবাদি পশু মারা গেছে ৩০ হাজার ৪৯৯টি, ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ১ হাজার ২৩৫টি, ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা ৪২০ কিলোমিটার। তবে বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্য আরও বেশি।

সিডরের ভয়াবহ তাণ্ডবের ক্ষত ১৪ বছরেও কাটিয়ে উঠতে পারেনি উপকূলের মানুষ। এরপর একের পরে এক আঘাত হানে দানবীয় ঝড় বুলবুল, আইলা, মহাসেন, ফনিসহ বিচিত্র নামের সব ঘূর্ণিঝড়। এতে কম বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় উপকূলীয় জেলা বরগুনা। বসত বাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট, গাছপালা, ফসলের মাঠসহ প্রায় প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়েই প্রাণহানীর মত ঘটনা ঘটেছে একাধিকবার।

দুর্যোগকালীন সময়ে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষদের যথাসময়ে আশ্রয় কেন্দ্রে না যাওয়ার ব্যাপারে এখনো তাদের মধ্যে সচেতনতা গড়ে ওঠেনি। আর ‘যা হয় হোক ঘরেই থাকবো’ এমন মানসিকতার কারণেই হতাহতের ঘটনা বাড়ছে। 

সিডরের এমন ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকার যথাসাধ্য উদ্যোগ গ্রহণ করে। পাশাপাশি দেশী ও বিদেশি দাতা সংস্থাও এগিয়ে আসে। একের পর এক উন্নয়ন পরিকল্পনায় ফের যখনই ঘুরে দাঁড়ানোয় মানুষের প্রানান্ত প্রচেষ্টা, ঠিক তখনি কোনো না কোনো দুর্যোগের ঘনঘটা শুরু হয়। চলে নিয়ন্ত্রহীন দানবীয় ঘূর্ণিঝড়ের একের পর এক তাণ্ডবলীলা। আর এসব মোকাবেলা করতে এখন অনেকটাই অভ্যস্ত এলাকার মানুষ। 

সিডরের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বরগুনা সদর উপজেলার নলটোনা ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নের ২৯ জনের মৃত্যু হয়। একের পর এক মরদেহ উদ্ধারের পরে তাদের এক স্থানে দাফন দেয়া হয়। সাড়িসাড়ি সেই কবরের স্থানটিতে এ বছর নির্মিত হয়েছে সিডর স্মৃতিসৌধ।   

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বরগুনা কার্যালয়ের তথ্যমতে, সিডরের আঘাতে জেলার সাড়ে ৯শ’ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের প্রায় সাড়ে পাঁচশ’ কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সিডর পরবর্তি আইলা, মহাসেন, ফণীসহ একাধিক প্রতিটি প্রাকৃতিক দুর্যোগে পায়রা বলেশ্বর ও বিষখালী নদী তীরবর্তি বন্যা নিয়ন্তন বাঁধগুলো নাজুক হয়ে পড়ে। 

বাঁধের কিয়দংশ সংস্কার ও রিং বেড়িবাধ দিয়ে আপাতত জানমাল রক্ষা হলেও ফের বুলবুলের আঘাতে জেলার ৩৭ কিলোমিটার বাঁধ ঝুকিঁপূর্ণ অবস্থায়। স্বাভাবিক জোয়ারের পানিতেই ওইসব এলাকা প্লাবিত হয়। পানিতে নিমজ্জিত হয় বসত-ভিটা, লোকালয় ও ফসলী জমি। চরম শংকায় দিন কাটে বাঁধের পাড়ের বাসিন্দাদের, ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষক। 

স্থানীয়দের দাবি, নদী শাসন করে স্থায়ী সুরক্ষা বাঁধ নির্মাণই একমাত্র কার্যকরি সমাধান। এছাড়া উপকূলীয় এলাকার সুরক্ষা সম্ভব না। তাদের অভিযোগ, মানুষের জানমাল রক্ষার্থে কর্তৃপক্ষের মনোভাব অনেকটাই দায়সারা। রিং বাঁধ নির্মাণ করে দায় এড়িয়ে যান তারা।

১৪ বছর পরেও ক্ষতিগ্রস্ত নলটোনা ইউনিয়নের চিত্রটি অভিন্ন নয়। এখানের ৪ থেকে ৫ কিলোমিটার এলাকার বাঁধের এক-তৃতীয়াংশ টিকে আছে। তিন তিনবার রিং বাঁধ দেয়া হয়েছে, কিন্ত একটিও টিকে নেই। কারণ নদী শাসন করে ব্লক দিয়ে স্থায়ী সুরক্ষা ব্যতীত উপকূলীয় এলাকাগুলোর ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার বাসিন্দাদের রক্ষার সুযোগ নেই।

বরগুনা সদরসহ পাথরঘাটা, বামনা, বেতাগী, তালতলী ও আমতলী উপজেলার বিষখালী বলেশ্বর ও পায়রা নদী তীরবর্তি ঝূঁকিপূর্ণ বাঁধ এলাকার বাসিন্দাদের একই অবস্থা। দুর্যোগের ঘনঘটনায় এদের যেমন আতংকে নির্ঘুম রাত কাটে, তেমনি অরক্ষিত থাকেন বছরজুড়ে প্রকৃতির রুদ্ররোষে।

এএইচ/