ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

মুক্তির যুদ্ধ চলছে, চলবে

ডিসেম্বরের রণাঙ্গন

শেখ সাদী

প্রকাশিত : ০৮:১৭ এএম, ১ ডিসেম্বর ২০২১ বুধবার | আপডেট: ০৯:১৭ এএম, ১ ডিসেম্বর ২০২১ বুধবার

ঘৃণা আর প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে পুড়ছে পাকিস্তান পিপলস পার্টির অফিস। দুমাস আগে ঢাকায় এই অফিসটি উদ্বোধন করেছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। এএফপি এই খবরটি ছড়িয়ে দিলো বিশ্বজুড়ে।

ছড়িয়ে পড়েছে মুক্তিযুদ্ধ সারদেশে। মুক্তির যুদ্ধ সবখানে। যুদ্ধ রণাঙ্গণে। যুদ্ধ পথে, ঘাটে, মাঠে। লড়াই চলছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে, ‘বিশ্ববিবেক জেগে ওঠো।‘ বিশ্ব বিবেক হতবাক, নিউইয়র্ক টাইমসের আজ বিশ্বকে জানলো, ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গেরিলা হামলা অস্বাভাবিক বেড়েছে।

পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তাদের নির্দেশে সেনাবাহিনী আরও ভয়াবহভাবে নিরীহ জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। বুড়িগঙ্গা নদীর অপর পারে জিঞ্জিরাতে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে একদিনেই হত্যা করে ৮৭ জনকে। এদের অধিকাংশই যুবক। নারী এবং শিশুরাও ওদের হাত থেকে রেহাই পায়নি।

রাঙ্গামাটি ব্যাপটিস্ট মিশনে হানাদার বাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে চার্লস আর হাউজার নামে একজন ধর্মযাজক এবং বহু বাঙালী সন্ন্যাসিনী নিহত হন।‘ ১৯৭১ সালের আজকের দিনটি ছিল বুধবার। বিজয়ের আর ১৬ দিন বাকি।

তবে রণাঙ্গণে লড়ে যাওয়া বাঙালি জানে না, মুক্তির আর কতদিন? কোন দিন আসবে বিজয়? মার খাওয়া বাঙালি জেগে উঠেছে। লক্ষ্যে কেবল ‘মৃত্যু, না হয় দেশের স্বাধীনতা’।

এদিকে আট মাস পাঁচ দিনের যুদ্ধে দিশেহারা পাকিস্তানি সেনা। প্রতিটি বাঙালির বুকের ভেতর বঙ্গবন্ধুর জাগিয়ে দেয়া শক্তি, ‘আর দাবায়া রাখতে পারবা না।‘ সত্যিই ‘দাবায়া’ রাখতে পারছে না হিংস্র পাকিস্তানি সেনারা।

বাঙালি নিধনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে মুক্তিযোদ্ধা। সিলেটের কানাইঘাটে মুক্তিবাহিনীর হাতে ৩০ জন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার নিহত হয়।

জুড়ি, বড়লেখা থেকে পাকিস্তানি সেনারা সরিয়ে নিলো যুদ্ধাস্ত্র। মুক্তিযোদ্ধার তাড়া খেয়ে কুলাউড়া থেকে পালিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তানি সেনা। শমশেরনগরে আক্রমণ। টেংরাটিলা ও দোয়ারাবাজার হয়ে গেলো শত্রুমুক্ত।

মুক্তিবাহিনীর অপারেশনের মুখে পাকিস্তানিরা সিলেটের গ্যরা, আলীরগাঁও ও পিরিজপুর থেকেও ব্যারাক গুটিয়ে নিচ্ছে পাকিস্তানি সেনা। ছাতক শহরে প্রচণ্ড যুদ্ধ। যুদ্ধে ৬৫ জন রাজাকার নিহত।

সুনামগঞ্জ মৌলভীবাজার মুক্ত করে এগিয়ে যায় মুক্তিযোদ্ধারা। কুমিল্লার কসবা রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনীর হাতে ৬০ জনের বেশি পাকসেনা নিহত।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মেরানী, সিঙ্গারাইল, গৈরালসানী, রাজাপুর ও আজমপুর এলাকা শত্রুমুক্ত। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শহিদ হন মুক্তিযোদ্ধা ইয়াসিন খাঁ। আর, ২৩ জন পাকসেনা নিহত হয়। একদল পাকসেনা অতর্কিতে ঘোড়াশাল ন্যাশনাল জুট মিলস ঘিরে ফেলে। মিলের বিভিন্ন পদের ১০৪ জন নিরীহ নিরস্ত্র কর্মচারীকে লাইনে দাঁড় করিয়ে এলএমজির ব্রাশ ফায়ারে নির্মমভাবে হত্যা করে।

সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ শত্রুমুক্ত হওয়ায় মুজিবনগর সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামান, ফণি মজুমদার, তোফায়েল আহমেদ এমএনএ, অর্থসচিব এ জামান, আইজি এম এ খালেক কালিগঞ্জে বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠাকল্পে সরেজমিনে পরিদর্শন করেন।

একটা একটা করে এলাকা শত্রুমুক্ত হচ্ছে। হানাদার পাকিস্তানি সেনার শিরদাঁড়া ভেঙে দেয়ার ’ব্রত’ সকল বাঙালির। যে ব্র্রত-র জন্ম সাতই মার্চে।

এদিন বঙ্গবন্ধু সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ‘আর তোমরা গুলি করবার চেষ্টা কোরো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না।‘ আর সব শেষে বললেন, ‘এ বারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এ বারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।‘ আবেগ-উদ্দীপিত বাক্যের সোজা-সরল শব্দগুলি বর্শার ফলার মতো গেঁথে যায় বিক্ষুব্ধ সারাবাংলার কোণে কোণে, ‘ভায়েরা আমার।‘ ‘এ বারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এ বারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’ সেই ডাক।

‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে, তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা কিছু আছে আমি যদি হুকুম দেবার না-ও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে।’ কথাগুলি বাঙালির মর্মস্থলে বিঁধলো। বঙ্গবন্ধু নিজেকে নামিয়ে আনতেন, ভাসিয়ে নিতেন মানুষের স্রোতে, তাঁদের উপরে নিজেকে রাখতেন না। অপূর্ব বাগ্মিতায় থাকতো না কোন আনুষ্ঠানিকতা।

একত্তরের মার্চ মাসেই অসহযোগ প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিত্তি তৈরি করেছেন। লক্ষ্য, পাকিস্তানের রাষ্ট্র কাঠামোকে প্রত্যাখ্যান। যে প্রতিরোধ থেকে একটি রাষ্ট্র গঠনে বদলে দিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি এখন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি।

সকালে রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের এক মুখপাত্র বললেন, শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার শেষ হয়নি। দুপুরের পর ভারতীয় সংসদে ইয়াহিয়া খানকে আহবান জানলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। জানিয়ে দিলেন,’ভারত যথেষ্ট সংযম দেখিয়েছে, আর নয়।

আমরা আমাদের প্রতিবেশীদের নিশ্চিহ্ন হতে দিতে পারি না। উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বার্থে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি সৈন্য সরিয়ে নিন। সৈন্য অপসারণই সমস্যার শ্রেষ্ঠ সমাধান। বসে নেই জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতা রাজাকার গোলাম আযম। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠক করে পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়োগের দাবি তোলেন।

আর, মুক্তিযুদ্ধকে ‘কমিউনিস্টদের অপতৎপরতা’হিসেবে চিহ্নিত করে সবাইকে সতর্ক থাকতে বললেন গোলাম আযম। এমন দিনে স্বাধীন বাংলা বেতার তরঙ্গ থেকে ছড়িয়ে পড়ছে আহবান।

সবার কানে আসছে, ‘যাদের চক্ষু আছে এবং চক্ষু থেকেও যাঁরা অন্ধ নন, আজ তাঁদেরকে একবার বাংলাদেশের রণাঙ্গনের দিকে দৃষ্টিপাত করতে অনুরোধ করব। একবার চোখ খুলে দেখুন সংগ্রামী বীর যোদ্ধা বাঙালী যুবকগণ কিভাবে পশ্চিমা হানাদার পশুদের খতম করে ক্রমাগত জয়ের লক্ষ্য পানে এগিয়ে চলেছেন।

বাংলাদেশের চূড়ান্ত দুর্দিনে পাকসেনাদের হাত থেকে দেশকে সম্পূর্ণ মুক্ত করার জন্য মুক্তিবাহিনীর বীর সৈনিকগণ আত্মত্যাগ, সাহসিকতা, বিক্রম, ধৈর্য এবং দেশপ্রেমের যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন বিশ্বের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তার নিদর্শন একান্ত বিরল।‘

শেখ সাদীঃ লেখক ও গবেষক।