জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু : স্বপ্নদ্রষ্টা ও স্থপতি
এইচ টি ইমাম
প্রকাশিত : ১১:০২ পিএম, ১ ডিসেম্বর ২০২১ বুধবার | আপডেট: ০৯:৪৬ এএম, ২ ডিসেম্বর ২০২১ বৃহস্পতিবার
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে জানাই তাঁর প্রতি অসীম শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা। এই মহামানবের স্মৃতি চির অম্লান। তিনি এমনভাবে আমাদের জীবনে-কর্মে- হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন, যেন মনে হয় আমাদের মাঝেই আছেন। যুগ যুগ ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাঁকে শ্রদ্ধায় আর ভালবাসায় স্মরণ করবে; তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা থেকে পাঠ নিবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রতিষ্ঠাতা। এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পেছনে যে অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবোধ এবং পৃথক জাতিসত্ত্বা রয়েছে; জনগণ ও দলীয় সহকর্মীদের সাথে নিয়ে তিনি তা দীর্ঘদিনের লড়াই-সংগ্রাম, জেল-জুলুম, মেধা-পরিশ্রম দিয়ে তিল তিল করে বিকশিত করেছিলেন। তিনি এই রাষ্ট্রের স্থপতিও। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে নতুনভাবে রাষ্ট্র গড়ে তুলতে এমন কোন প্রতিষ্ঠান, আইন নেই যা তিনি সৃষ্টি করে যাননি। ইতিহাসে প্রথম বহু আকাঙ্ক্ষিত জাতীয় চার নীতির ওপর ভিত্তি করে তিনি সংবিধান উপহার দিয়েছিলেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধুমাত্র স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টাই ছিলেন না; একটি পুরোনো, জরাজীর্ণ এবং গণবিরোধী রাষ্ট্র থেকে একটি জাতিকে উদ্ধার করতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন সেই জাতিকে উৎসাহিত এবং উজ্জীবিত করা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে অনুধাবন করেছিলেন ঐ রাষ্ট্রে বাঙালি জাতির কোন স্থান হবে না এবং পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী পূর্ববাংলাকে শুধুমাত্র শোষণ করবে, কোন উন্নয়ন করবে না। সেই ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের গোড়া থেকে তিনি আন্দোলন সংগ্রামের পথ ধরে গোটা বাংলাদেশ চষে বেড়িয়েছেন আর মানুষকে বুঝিয়েছেন যে তারা পাকিস্তানি নন, তারা বাঙালি। এই বাঙালি জাতীয়তাবোধ সৃষ্টি এবং জনমনে জাতিসত্ত্বা প্রোথিত করা একমাত্র বঙ্গবন্ধুর মতো অসীম সাহসী, দেশপ্রেমিক নেতার পক্ষেই সম্ভব ছিল। বাঙালির সুদীর্ঘ ইতিহাস বিদেশিদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণের ইতিহাস। বাঙালি বীরের জাতি, কখনও মাথা নত করে নাই। এদেশের কৃষ্টি এবং ভাষা হাজার বছরের; এই বোধ থেকেই জন্ম হয় বাঙালি হিসেবে আমাদের গর্বের। এজন্যই বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা।
প্রথম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠা
২৫ মার্চ কালরাত্রিতে যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির উপর ঝাপিয়ে পড়ে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে, তখন বঙ্গবন্ধুর অনুসারি নেতৃবৃন্দ ও আপামর জনগণ যার যার অবস্থান থেকে তৎপর হয়ে ওঠেন। বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক গ্রেফতার হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেন এবং সেই বার্তা তৎকালীন ইপিআর-এর ওয়্যারলেস ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে চট্টগ্রামসহ দেশের সকল প্রান্তে তাৎক্ষণিক ছড়িয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধুর পূর্ব নির্দেশ অনুযায়ী তৎকালীন প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ সীমান্তবর্তী ভারতের বিশেষ একটি স্থানে সমবেত হয়ে গণপরিষদ গঠন করেন। এ গণপরিষদ বঙ্গবন্ধুর ২৬ মার্চের ঘোষণাকে কার্যকর করার জন্য এবং পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি এবং জাতির পিতা ঘোষণা করে ১০ এপ্রিল, ১৯৭১ স্বাধীন সার্বভৌম, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টি করেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে এবং ঘোষণায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন। ১০ এপ্রিল থেকেই সরকার কার্যক্রম শুরু করে। পরবর্তীতে ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ বর্তমান মেহেরপুর জেলার মুজিবনগরে (সাবেক বৈদ্যনাথ তলা) দেশি-বিদেশি কয়েকশত সাংবাদিক এবং প্রিন্ট মিডিয়ার উপস্থিতিতে এই সরকারের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হয়। স্থানটির নামকরণ হয় মুজিবনগর। প্রথম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা, বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ও বিশ্ব জনমত সৃষ্টিতে অনন্য সাধারণ ভূমিকা পালন করে।
নবজাত বাংলাদেশে সংবিধান প্রণয়ন
মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে সংবিধান প্রণয়ন ছিল যুগান্তকারী ঘটনা। জাতীয় পুনর্গঠনের দিক বিবেচনায় দ্রুত সংবিধান প্রণয়নের প্রয়োজন ছিল। জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে স্বাধীনতার ১১ মাসের মধ্যে গণপরিষ সংবিধান প্রণয়ন করে এবং ৪ নভেম্বর ’৭২ তা গৃহীত হয়। স্বাধীনতার প্রথম বর্ষপূর্তির দিন ১৬ ডিসেম্বর ’৭২ থেকে তা কার্যকর হয়। প্রসঙ্গত বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে স্বদেশের মাটিতে পা দিয়েই ঘোষণা করেন যে, ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও অপশাসনমুক্ত শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হচ্ছে আমাদের লক্ষ্য। এই লক্ষ্যই সংবিধানে জাতীয় চার নীতি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা হিসেবে ঘোষিত হয়। অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদ, শোষণমুক্ত সমাজ, সংসদীয় গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মানবাধিকার হয় সংবিধানের ভিত্তি। মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে প্রণীত এই সংবিধান বিশ্ব ইতিহাসে অনন্য। এই সংবিধানের ভিত্তিতে ৭ মার্চ ’৭৩ প্রথম সংসদ নির্বাচন হয়। এত স্বল্প সময়ের মধ্যে সংবিধান প্রণয়ন ও নির্বাচন অনুষ্ঠান ছিল ইতিহাসে বিস্ময়কর ও বিরল ঘটনা।
সার্বভৌম রাষ্ট্র পরিচালনা
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধুমাত্র একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টাই ছিলেন না। তিনি একটি আধুনিক রাষ্ট্রের সত্যিকার স্থপতি ছিলেন। একদিকে রাষ্ট্র পরিচালনা অন্যদিকে একটি গণমুখী প্রশাসন স্থাপনও করে গিয়েছিলেন অতি অল্প সময়ের মধ্যে। একই সাথে সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রে পৃথকভাবে নির্বাহী (সরকার), সার্বভৌম সংসদ, স্বাধীন বিচার বিভাগ এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে নির্বাচন পরিচালনার জন্য RPO, 1972 জারি এবং নির্বাচন কমিশন গঠন করেন। রাষ্ট্রের পরিচালনার কার্যপদ্ধতি (Rules of Business) ও কার্যবন্টন (Allocation of Business) প্রণয়নও করেন।
বঙ্গবন্ধুর আরেকটি বিশেষ কৃতিত্ব ছিল আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করার জন্য তিনি সশস্ত্রবাহিনী শক্তিশালীকরণে দৃষ্টি দিয়েছিলেন। সেই সাথে পুলিশ এবং অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আধুনিকায়ন করেছিলেন।
স্বাধীন ও সার্বভৌমত্বের পরিচিতি
একটি আধুনিক রাষ্ট্রে বহির্বিশ্বের সরকারের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে আরো অনেকগুলো অত্যন্ত জরুরি বিষয় প্রতিষ্ঠা করতে হয়। যেমন জাতীয় সংগীত এবং সেই সাথে তার বিধি, জাতীয় পতাকা আইন ইত্যাদি। ১৩ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিপরিষদ সভায় গৃহীত হয় জাতীয় সংগীত। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পতাকা আইন, ১৯৭২ ও জাতীয় প্রতীক আইন ১৯৭২ অনুসারে প্রতিষ্ঠিত হয় জাতীয় পতাকা ও জাতীয় প্রতীক।
কিলো ফ্লাইট
১৯৭১ এর ২রা মে ঢাকা চট্টগ্রাম সড়কে ফেনী নদীর উপরে শুভপুর ব্রীজে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা যে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন সেটি ভেঙ্গে পড়ে। তার পরপরই পাকিস্তান বিমান বাহিনী প্রথমে শুভপুর এবং পরে আমাদের অস্থায়ী ক্যাম্প রামগড়ের উপরে হামলা চালায়, একই সাথে বোমাবর্ষণ এবং মেশিনগান থেকে গুলি। এরকম পরিস্থিতি হতে পারে চিন্তা করে আমরা পূর্ব থেকেই রামগড়ের উল্টো দিকে ভারতের সাবরুমে কার্যালয় স্থানান্তরের ব্যবস্থা করে রেখেছিলাম। মার্চ-এপ্রিল মাসে ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং সিলেট বিভাগ থেকে বিপুল সংখ্যক শরণার্থী ত্রিপুরায় আশ্রয় গ্রহণ করে। এই সময় আমাদের কয়েকজন সহকর্মী এবং রাজনৈতিক নেতা ত্রিপুরার আগরতলায় আঞ্চলিক দপ্তর গড়ে তোলেন। জায়গাটির নাম ছিল কর্নেল চৌমুহনী। এখানে প্রয়াত জহুর আহমেদ চৌধুরী, এম এ হান্নান, প্রফেঃ খালেদ এবং আরও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ অবস্থান করছিলেন। মে ১৯৭১ সালে আমি সপরিবারে আগরতলায় উপস্থিত হই এবং তার কয়েকদিন পর থেকেই আঞ্চলিক প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণ করি। ঐ সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃদ্ধ আগরতলায় আশ্রয় নেন, তাদের অধিকাংশের গন্তব্য ছিল কলকাতায়। আগরতলার সাথে কলকাতার যোগাযোগ ছিল আকাশ পথে ইন্ডিয়ান এয়ার লাইন্স এর মাধ্যমে স্থল পথেও যাওয়া যেত কিন্তু সেটি ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং সময় সাপেক্ষ। ত্রিপুরার মোট জনসংখ্যা ছিল পাঁচ লক্ষের মত এবং বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থী ছিল প্রায় পঁচিশ লক্ষ। স্বভাবতই সমস্যারও অন্ত ছিল না। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এবং ত্রিপুরার রাজ্য সরকারের সমর্থন থাকা সত্ত্বেও আমাদের আঞ্চলিক দপ্তরের উপর প্রচণ্ড চাপ ছিল। কর্নেল চৌমুহনীর অফিসে নানারকম অভিযোগ নিয়ে বিপুল সংখ্যক বাঙালি নাগরিক উপস্থিত হতেন। এরকম সময়ে দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দলের আগমন ঘটে। কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে কলাকৌশলীরা এসে দাবী করেন তাদের জন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ট্রান্সমিটার ব্যবস্থা করার জন্য। সেটি সম্ভব ছিল একমাত্র ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর আনুকূল্যে, সে ব্যবস্থা আমরা করেছিলাম এবং স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র অংকুরিত হয় ত্রিপুরাতেই।
অপর গুরুত্বপূর্ণ যে দলটি আমাদের দপ্তরে এসে উপস্থিত হন তারা সবাই ছিলেন উচ্চপদস্থ বিমান বাহিনীর সদস্য এবং তাদের সাথে ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স (PIA) এর বৈমানিকগণ। তারা এসেছিলেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য। এই দলটির নেতৃত্বে ছিলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ.কে. খদকার। তাঁর সাথে উইং কমান্ডার বাশার, SQ. LDR সদরউদ্দিন, SQ. LDR. ফজলুর রহমান, SQ. LDR সুলতান, ক্যাপ্টেন আকরাম আহমেদ PIA এর জ্যেষ্ঠ ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন এবং আলমগীর সাত্তার এদের সবাইকে বিশেষ ব্যবস্থায় ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স মারফত কোলকাতায় পাঠিয়ে দিলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনকে অবহিত করলাম। এই অসীম সাহসীরা পরবর্তীকালে উত্তরপূর্ব ভারতে প্রথম বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর কিলো ফ্লাইট প্রতিষ্ঠা করেন। ৭১ এর ডিসেম্বরে এই কিলো ফ্লাইটের বৈমানিকরাই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তানি ঘাঁটির উপর আক্রমণ চালায়। এদের মধ্যে বেসামরিক ক্যাপ্টেন আলমগীর সাত্তার বীর বিক্রম এবং ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দিন বীর উত্তম পদকে ভূষিত হয়, মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের যাত্রা
৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালে প্রাক্তন PIA এর ক্যাপ্টেনগণ বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করেন ধানমন্ডির ১৮ নম্বর রোডের তাঁর অস্থায়ী বাসভবনে। এই বাড়িটিতেই বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা তাঁর ছেলেমেয়েদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিদের দ্বারা গৃহবন্দি হয়েছিলেন। এখান থেকেই ক্যাপ্টেন কামাল এবং লেঃ জামাল কৌশলে বের হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এখানেই আমাদের জননেত্রী শেখ হাসিনা ছিলেন তার মায়ের সাথে, তাঁর কোলে জয়। উল্লেখ্য, ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িটি বসবাসযোগ্য করতে কিছুদিন সময় লেগেছিল।
বঙ্গবন্ধু মনেপ্রাণে চেয়েছিলেন অন্যান্য স্বাধীন দেশের মত বাংলাদেশেরও পতাকাবাহী একটি এয়ারলাইন্স থাকুক। পাইলটগণ বঙ্গবন্ধুর কাছে আবেদন করলেন তাদের একটি বিমান সংগ্রহ করে দিতে, যাতে তারা নবগঠিত বিমান বাংলাদেশকে চালু করতে পারেন। ঐ সময় মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত বিমানবাহিনীর একটি ডিসি-৩ (ডাকোটা) বিমান ছিল। তারা অনুরোধ করলেন বঙ্গবন্ধুকে, তিনি যেন কর্নেল ওসমানি সাহেবকে বলে ঐ এয়ারক্রাফটি বিমানকে দিয়ে দেন। বঙ্গবন্ধু তাৎক্ষণিকভাবে ওসমানি সাহেবকে নির্দেশ দিলে তিনি গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকারের সাথে আলোচনা করে বিমানের বহরে হস্তান্তর করলেন।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের প্রথম ফ্লাইট ছিল ৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা। ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই একটি ফ্লাইট চালু ছিল। ঐ সময় কয়েকজন নতুন বৈমানিককে নিয়োগ দেওয়া হয় এবং তাদের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নেন PIA এর জ্যেষ্ঠ Boeing ক্যাপ্টেন এস এম হায়দার (সবুজ)। দুর্ভাগ্যবশত এমন একটি প্রশিক্ষণ ফ্লাইটে দুর্ঘটনায় ডিসি-৩ বিমানটি ধ্বংস হয়ে যায় এবং তার সাথে মৃত্যুবরণ করেন ক্যাপ্টেন হায়দার। এপ্রিল-মে মাসের দিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বিমানের ব্যবহারের জন্য দুইটি Folker ফ্রেন্ডশীপ বিমান উপহার দেন। এই দুটি বিমান দিয়েই বিমানের অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটগুলো চালানো হতো। এরপর বিমান একটি Boeing-707 চার্টার্ড করে এবং ঐ একটি বিমান দিয়েই ঢাকা-লন্ডন ফ্লাইট চালু করে। তখন রুট ছিল ঢাকা-বাহরাইন-লন্ডন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র ১৯ দিনের মাথায় জন্ম নেয় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ নং ১২৬ অনুসারে ১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স প্রতিষ্ঠিত হয়। বিমানের বিখ্যাত “বলাকা” লোগোটি ডিজাইন করেছিলেন শিল্পী কামরুল হাসান।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চেয়েছিলেন ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত, শিক্ষিত এবং আধুনিক এমন একটি রাষ্ট্র যেটি পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান দেখলেই বোঝা যায় যে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর সহকর্মীরা কী অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে এই দেশের মানুষের সুখ, দুঃখ, চাওয়া-পাওয়ার অবলোপন করেছেন এবং এই জনগোষ্ঠীকে কিভাবে উন্নততর জীবন জীবিকা উপহার দেয়া যায় তার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। বাংলাদেশ বিরোধী এবং পাকিস্তানপন্থি বিরাট সংখ্যক জনগোষ্ঠী এই স্বাধীন বাংলাদেশের আনাচে কানাচে ঘাপটি মেরে ছিল। বাংলাদেশের সংবিধান এবং এর প্রণেতাদের প্রতি তাদের ছিল অবিমিশ্রিত ঘৃণা। তারা তাই শত্রুদের পক্ষ হয়ে তাদের পরামর্শে জাতির পিতাকে সপরিবার এবং জাতীয় চার নেতাকে হিংস্র হায়েনার মতো নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে প্রায় দীর্ঘ ২১ বছর বাংলাদেশ উল্টো পথে চলেছে, যে বাংলাদেশ সৃষ্টির জন্য বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে ত্রিশ লক্ষ মানুষ শহীম হয়েছিলেন এবং লক্ষ লক্ষ মা-বোনেরা সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু ক্ষমতায় ছিলেন মাত্র- ১১ জানুয়ারি ১৯৭২ থেকে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ পর্যন্ত ৩ বছর ৭ মাস ৫ দিন। এই সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে তিনি অসাধ্য সাধন করে গেছেন। রাষ্ট্র মানে শুধু একটি ম্যাপ বা একটি নির্দিষ্ট ভূমি নয়, শুধু জাতীয় পতাকা কিংবা জাতীয় সংগীত নয়। রাষ্ট্র হলো এর সকল নাগরিকের জন্য কল্যাণকর এমন একটি ব্যবস্থা সৃষ্টি করা যেখানে সকলের অধিকার নিশ্চিত করা যায়। আধুনিক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে যার যে সমস্ত স্তম্ভ দরকার সেগুলিকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর স্থাপন করা এবং এমন সমস্ত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যেগুলো একটি আরেকটির পরিপূরক।।
অতি অন্ত সময়ের মধ্যেই জাতির পিতা এবং রাষ্ট্রের স্থপতি সুদূর প্রসারী চিন্তা ভাবনা নিয়ে একটি আধুনিক রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে আসা বাংলাদেশ- জাতির পিতার নেতৃত্বে বিশ্ব মন্দার মধ্যেও ৯.৬% প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল। তারই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে আর এক উচ্চতায় নিয়ে এসেছেন। বঙ্গবন্ধুর আজন্ম লালিত স্বপ্ন “সোনার বাংলা” আজ বাস্তবায়নের পথে।
“জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু
বাংলাদেশ চিরজীবি হোক”
লেখক: মরহুম এইচ টি ইমাম মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাবেক রাজনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রী পরিষদ সচিব
এসি