একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিচারণ
মিরসরাই (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি
প্রকাশিত : ১১:৩৭ এএম, ২ ডিসেম্বর ২০২১ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ১২:৩৬ পিএম, ২ ডিসেম্বর ২০২১ বৃহস্পতিবার
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা নূর হোসেন
নূর হোসেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। যখন ২২ বছরের টগবগ যুবক ঠিক তখনই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্রকন্ঠের আহ্বানে দেশ মাতৃকাকে পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত করার সুদৃঢ় প্রত্যয়ে সক্রিয়ভাবে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তিনি।
তিনি মিরসরাই উপজেলার ১৩নং মায়ানী ইউনিয়নের সৈদালী গ্রামে ১৯৪৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মরহুম আবদুল সাত্তার ও মা মরহুমা রাবেয়া খাতুন। বাংলাদেশ জাতীয় গেজেট নং-৪৬৩৪, যুদ্ধাহত গেজেট নং-২২৯৫, ইবিআরসি/কল্যাণ ট্রাস্টের তালিকা নং-২১৮, মুক্তিবার্তা নং-০২০৩০৪১০৭৯, ভারতীয় তালিকা নং-১৯২৯৬, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নং-৩৯৪৬২১৮, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ইস্যুকৃত সনদপত্র (নং-২০০০৩৮) রয়েছে তার।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ের স্মৃতিচারণ করেছেন মুক্তিযোদ্ধা নূর হোসেন। তা নিম্নে তুলে ধরা হলো-
“১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের দুই তারিখে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের হরিনা আর্মি ক্যাম্পে ভর্তি হই। সেখানে দেড় মাস প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর ১নং সেক্টরের অধীনে ক্যাপটেন মাহফুজ, ক্যাপটেন এনাম, ক্যাপটেন সামফুল হুদা, মেজর রফিকুল ইসলাম এবং লেপটেন্যান্ট ফারুখের নেতৃত্বে যুদ্ধের সবগুলো অপারেশনে অংশগ্রহণ করি। বাংলাদেশ বর্ডারের পাশে ভারতের সাবরুম বাজার, মনু বাজার ও হরবাতলী এই তিন জায়গায় আমাদের ক্যাম্প গঠন করা হয়।
সেখান থেকে আমরা আমরিঘাট, আন্দার মানিক, বাগান বাজার, হলদিয়া ডেবা, ছিকনছরা, রামগড়, তবলছড়ি, বিলাইছড়ি, কালাপানিয়া, ফবাড়ি, চামলাইশ্যা, কইলা, কাঁঠালছড়ি ও চা বাগানসহ বিভিন্ন জায়গায় পাকবাহিনীর সাথে সম্মুখযুত্থে লড়াই করি। প্রায় সময় আমার সন্ধ্যায় ৫টা-৬টা এবং বেশির ভাগ সময় ভোর ৩টা-৪টায় ক্যাম্প থেকে বের হয়ে শত্রুপক্ষকে তছনছ করে দিতাম। পরে সাধারণ মানুষের মাধ্যমে জানতে পারতাম যে এতে কতো পাকবাহিনী নিহত ও আহত হয়েছে।
বিভিন্নভাবে খবর পেতাম যে, রাজাকার, আলবদর, আল-শামস, মুজাহিদরা হানাদার বাহিনীর কাছে আমাদের মা-বোনদেরকে বিভিন্নভাবে তুলে দিত। কোন অপারেশনের পূর্বে আমরা পাঞ্জাবীদের অবস্থান শনাক্ত করতে সাধারণ মানুষ সেজে রেকি করতে যেতাম। তখন দেখতাম স্কুল-কলেজ পড়ুয়া মেয়েদেরকে শুধুমাত্র আন্ডারওয়্যার পরিয়ে গোসল করাতে নিয়ে আসত। এ রকম আরও অনেক ঘটনা আছে, যা প্রকাশ করার মত নয়।
অনেক সময় আমরা কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে অবস্থান নিতাম। পাকবাহিনী যখন আমাদের সীমানায় উপস্থিত হত তখন হামলা চালিয়ে তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দিতাম। এরকম হামলায় তাদের অনেক সৈন্য নিহত হত।
যুদ্ধকালিন সময়ে হাবিলদার বিল্লারের নেতৃত্বে আন্দার মানিক স্থানে একটি অ্যাম্বুস বানাই। সেখানেও পাকবাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধ হয় এবং ৭ জন পাঞ্জাবী নিহত হয়। এর কয়েকদিন পর আমরা সেখানে আবার অ্যাম্বুস বসাই। তখন ওই অ্যাম্বুসের কমান্ডারের দায়িত্বে ছিলেন হাবিলদার মেজর মজিবর। কিন্তু ঘটনা চক্রে সেখান থেকে তিনি পালিয়ে যান। তখন সেখানে আমার নিজ নেতৃত্বে যুদ্ধ হয়। ওই ঘটনার কিছুদিন পর ক্যাপ্টেন শামসুল হুদা শহীদ হন।
একদিন ক্যাপ্টেন মাহফুজ আমাদেরকে ডেকে বললেন যে, ছিকন ছড়ায় যদি কোন অ্যাম্বুস বসানো হয় তাহলে আমাদের কোন জওয়ান ওখান থেকে ফিরে আসতে পারবেনা। কারণ, নকশা অনুযায়ী ওই জায়গাটা ছিল খুবই বিপদজনক। তখন লে. ফারুক সুবেদার হাফেজকে বললেন, ওই ছিকন ছড়ায় আমার জওয়ানেরা অ্যাম্বুস বসাবে। কিন্তু সুবেদার হাফেজ তাহা প্রত্যাখান করলেন। তখন লে. ফারুকের নির্দেশে আমি হাবিলদার মেজর নুরুল আলমকে ডেকে আনলাম। মেজর নুরুল আলম তার প্রস্তাব মানলেন।
তখন আমরা বিকাল ৫টার দিকে ছিকন ছড়ার দিকে রওনা হলাম এবং খুবই গোপনে ও সতর্কভাবে অ্যাম্বুস বসাইলাম। আমাদের সাথে দুজন সাধারণ মানুষ ছিল। তারা আমাদেরকে পথ দেখিয়ে দিত। আমরা যে রাস্তা দিয়ে প্রবেশ করেছিলাম ওই রাস্তায় আমাদের পায়ের চিহ্ন দেখে হানাদার বাহিনীরা আমাদের ঘেরাও করে ফেলে। কিন্তু সেটা আমরা জানতাম না। যখন আমাদের উপর ত্রিমুখী হামলা শুরু হয় তখন অ্যাম্বুস রেখে একটি খামার বাড়িতে আশ্রয় নিলাম আমরা। বুঝতে পারলাম, পাকবাহিনী আমাদেরকে ঘিরে ফেলেছে।
আমরা তখন বাঁচার কৌশল অবলম্বন করি। পাকবাহিনী পাহাড়ের যে ক্যাম্পে ছিল আমরা ওই পাহাড়ের গোড়ায় আশ্রয় নিলাম। সেখানে দু’রাত একদিন পাকিস্তানিদের ঘেরাওতে ছিলাম। জলিল নামের একজন লোক এসে আমাদেরকে রাতের অন্ধকারে পথ দেখিয়ে দেন এবং ভারতের মনু বাজার ক্যাম্পে পৌঁছিয়ে দেন।
এর কয়েকদিন পর আমাদেরকে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশের স্বীকৃতি দেয়া হয়। তখন আমরা পাকবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করতে করতে বাংলাদেশে প্রবেশ করি। শুভপুর ব্রীজ, ছিনকি আস্তানা, জোরারগঞ্জ, মিরসরাইসহ বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান করি। বাঁশবাড়িয়া হতে কুমিরা ঘাঁটঘর ও কুমিরা টিবি হাসপাতাল এলাকায় পাকবাহিনীর সাথে আমাদের মুখোমুখি শেষ যুদ্ধ হয়। সে দিনটি ছিল ১৪ ডিসেম্বর।
সেদিন পাকবাহিনীর সাথে আমাদের বিমান হামলা, ট্যাংক হামলাসহ তুমুল যুদ্ধ হয়। এতে আমাদের প্রায় ১৫০-২০০ গজ পেছনে থাকা মিত্র বাহিনীর ১৫০-২০০ সৈন্য নিহত হয়। এটি ছিল আমাদের স্মরণীয় যুদ্ধ। সেদিন আমিসহ অনেক সৈন্য আহত হয়। সেদিন আমাদের ২ জন সৈন্য শহীদ হন। একজন শহীদ কামাল অন্যজন শহীদ আবুল কালাম।
তার দুইদিন পর অর্থাৎ ১৬ই ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনী আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে।”
এএইচ/