ডিসেম্বরের রণাঙ্গন
ইন্দিরা গান্ধীকে দেয়া চিরকুটে কী লেখা?
শেখ সাদী
প্রকাশিত : ০৮:৩০ এএম, ৩ ডিসেম্বর ২০২১ শুক্রবার
একাত্তরের তিন ডিসেম্বরে
.................
পাল্টে যাচ্ছে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গন।
আসছি সে কথায়। এখন যাচ্ছি ১৯৭১ সালের কলকাতায়। পরিকল্পনা ছিল ৪ ডিসেম্বর কলকাতায় আসবেন ইন্দিরা গান্ধী। হঠাৎ কর্মসূচি বদল হলো। দিল্লি থেকে প্রেসনোটে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কলকাতায় আসবেন ৪ তারিখে নয় আজ তিন ডিসেম্বর। এদিনই ফিরে যাবেন।
এদিকে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে উত্তেজনা চরমে। আগরতলা আক্রান্ত।
কাশ্মীর সীমান্তে চলছে খণ্ডযুদ্ধ। কলকাতার প্যারেড গ্রাউন্ডে প্রধানমন্ত্রী কী বলবেন? এসব নিয়ে বিশ্বময় জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। জনসভায় লাখ লাখ মানুষের সামনে যুদ্ধসংক্রান্ত কিছুই বললেন না।
চমকপ্রদ কোনো ঘোষণা দিলেন না। প্যারেড গ্রাউন্ডের বক্তৃতা শেষ করে রাজভবনে এলেন। শিল্পী, সাহিত্যিকদের সঙ্গে ঘরোয়া আড্ডায়। বক্তৃতা করে ক্লান্ত ইন্দিরা ওডিকোলন দেওয়া টিস্যু পেপারে মুখটা মুছে নিয়ে বললেন, ‘এ রাজ্যের সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনারা বলুন আমি শুনি।’
কথাবার্তা শুরু হলো। ইন্দিরা বললেন, ‘যুদ্ধ কবে হবে, নাকি আদৌ হবে না, সেটা বড় নয়। বড় কথা হলো, যুদ্ধের চাপ আমরা সহ্য করতে পারব কিনা। সৈন্যরা হাতিয়ার নিয়ে যুদ্ধ করে। তবে সাধারণ নাগরিকদেরও অনেক দায়িত্ব নিতে হয়।’ একটু থেমে বললেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমি কিছুদিনের জন্য লন্ডন আটকা পড়ে যাই। তখন লন্ডনে নিয়মিত বোমা পড়ছে। তবু ব্রিটিশ সরকার সমস্ত কনসার্ট হল খোলা রাখত, কারো টিকিট লাগত না। বোমা পড়ার শব্দ থামলেই লোকজন মিউজিক শুনতে ছুটে যেত।
উদ্বেগ, দুশ্চিন্তার সময় গান-বাজনা শোনার উপকারিতা অনেক। আপনারা যাঁরা লেখক, শিল্পী, আপনাদের দেখতে হবে যেন দেশের মানুষ যুদ্ধের উন্মাদনায় না মেতে ওঠে। হন্তদন্ত অরোরা ইন্দিরা গান্ধীর কথা শেষ হয়নি। এমন সময় হলঘরে হনহন করে লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরা ঢুকে পড়লেন। পরনে সামরিক পোশাক। কাছে এসে স্যালুট দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর হাতে দিলেন একটা চিরকুট। এটার ওপর ইন্দিরার দুই চোখ আটকে গেল। দেড় মিনিট তাকিয়ে থাকলেন।
অরোরার দেওয়া চিরকুটে লেখা ছিল, কাল মুজিবুরের রায়। সম্ভবত রাতেই ফাঁসি।
কাগজটা ছিঁড়ে ফেললেন ইন্দিরা। চেপে রাখতে চান মনের অবস্থা। নায়ক উত্তমকুমারের সঙ্গে হেসে কথা বললেন। তবে উদ্বিগ্নতা ঢেকে রাখার চেষ্টা ধরে ফেললেন কেউ কেউ। নিজেও আর পারলেন না।
আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘মাফ করবেন, আজ বেশিক্ষণ কথা বলার সুযোগ নেই। জরুরি দরকারে এক্ষুনি দিল্লি ফিরতে হবে। আপনারা চা পান করুন। আমি আসছি।’
ভারত আক্রান্ত ভারতের বিভিন্ন শহরে বোমা ফাটায় পাকিস্তান।
বিকেল পাঁচটা ৪০ মিনিটে বোমা ফেলেছে অমৃতসরে।
পাঁচটা ৪৭ মিনিটে শ্রীনগরে।
ছয়টা আট মিনিটে কাশ্মীরের অবন্তিপুর।
দিল্লি পৌঁছে মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠক ডাকলেন।
কথা বললেন প্রতিরক্ষা বাহিনীপ্রধানদের সঙ্গে। সেনাপ্রধান মানেকশ, বিমানবাহিনীর প্রধান লাল এবং নৌপ্রধান নন্দকে নির্দেশ দিলেন, ‘ওয়ার ইজ অন। হিট ব্যাক। হিট ব্যাক উইথ অল ইওর মাইটি।’
ইন্দিরার ঘোষণা ‘পাকিস্তান আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এ যুদ্ধ বাংলাদেশের। এ যুদ্ধ আমাদের।
দীর্ঘকালীন কৃচ্ছ্র ও আত্মত্যাগের জন্য আমাদের সকলকে প্রস্তুত থাকতে হবে। এ ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না। বাংলাদেশের সংকট মোকাবিলায় জাতিসংঘ শতভাগ ব্যর্থ।’
এদিকে মুক্তিযোদ্ধারা প্রবল আক্রমণ করে আখাউড়ার আজমপুর রেল স্টেশনে বড় অংশ দখল করে নেয়। খতম করা হয় ১১ জন পাকিস্তানি সেনা। শহীদ হন মুক্তিবাহিনীর দুজন সেপাই আর একজন নায়েব সুবেদার।
পূবাঞ্চলে পাকিস্তানের চার ডিভিশন সৈন্য ভারতের সাত ডিভিশন সৈন্য ও মুক্তিযোদ্ধার মুখোমুখি। চতুথ ও দশম বেঙ্গল ফেনী থেকে অগ্রসর হয়ে রেজুমিয়া সেতুতে হাজির হয়।
এক নম্বর সেক্টরের ক্যাপ্টেন মাহফুজ বাহিনী নিয়ে একসাথে হয়ে যান। ফেনী-চট্টগ্রাম সড়ক দিয়ে এই বাহিনীর একটি অংশ মহুরী নদী ধরে আর একটি অংশ বাম দিকের সড়ক ধরে চট্টগ্রামের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ ও ফ্লাইট লেফটেনেন্ট বদরুল আলম মধ্যরাতে নারায়ণগঞ্জে গোদানাইলে জ্বালানি ঘাঁটির ওর সফল আক্রমণ করেন। মধ্যরাতে, ইংরেজি ক্যালেন্ডারে চার তারিখের শুরুর পর ভারতীয় ফাইটার বিমান হামলা চালায় ঢাকা ও কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে। মুক্তির যুদ্ধ চলছে, চলবে।
শেখ সাদীঃ লেখক ও গবেষক
এসবি/