ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর ফাঁসির রায়

‘নিজের চোখে দেখলাম ওরা কবর খুঁড়ছে’

শেখ সাদী

প্রকাশিত : ০৮:২১ এএম, ৪ ডিসেম্বর ২০২১ শনিবার

ইয়াহিয়ার ইচ্ছে শেখ মুজিবের মুন্ডুটা এক কোপে উড়িয়ে দিয়ে ঢাকায় যাই। সেখানে গিয়ে সবাইকে বুঝিয়ে দেবো আমিই পাকিস্তানের মালিক। রাগের মাথায় করাচি পর্যন্ত চলে এলেও পরামর্শদাতারা আটকে দেয়। ওরা বুঝিয়ে দেয়, এখন কোনোক্রমেই পূর্বদিকে যাওয়া মঙ্গলজনক  হবে না।

এদিকে লয়ালপুর কারাগারে ফাঁসির মঞ্চ তৈরি। বন্ধুবন্ধুর ফাসির রায় ঘোষণা হলো আজ। রায়ে বলা হয় ‘শেখ মুজিবের বিপক্ষে আনীত সকল অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রদান করা হলো।’ এই রায় প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের অনুমোদন সাপেক্ষ ছিল। তাই সামরিক আদালতকে রায় বিশ্লেষণমূলক প্রমাণাদি অথবা সিদ্ধান্তের কোনো কারণ প্রদর্শন করতে হয়নি।

লয়ালপুর কারাগারে ফাঁসির মঞ্চটা ভালো না। অনেক পুরনো। সেজন্য নতুন মঞ্চে তুলতে চান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। মিয়ানওয়ালি কারাগারে কিছুদিন আগে ফাঁসির মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। এই দিনটির কথা পরে সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি আমার নিজের চোখে দেখলাম, ওরা কবর খুঁড়ছে। আমি নিজের কাছে নিজে বললাম, আমি জানি, এ কবর আমার কবর। ঠিক আছে, কোনো পরোয়া নেই। আমি তৈরি আছি।’

এদিকে ঢাকার আকাশে পাকিস্তানি উড়োজাহাজ বিধ্বংসী কামানের গোলা ফাটছে আতশবাজির মতো।

এসব ভারতীয় বিমানবাহিনীর আক্রমণ নাকি গোলন্দাজদের মহড়া? প্রশ্নটি এখনো অমীমাংসিত। সকাল থেকে ভারতীয় মিগ নিয়মিত রকেট আক্রমণ করছে। নিচ থেকে ছোড়া কামানের গোলার ধোঁয়ায় ভরে গেছে ঢাকার আকাশ।

হোটেলের ওপর আকাশে বেশ কয়েকটি ফলশূন্য ‘ডগফাইট’ দেখা গেল। মাথায় লতাগুল্মের ক্যামোফ্লেজ করে রাস্তায় বেরোনো কয়েকটি সামরিক যানবাহন ছাড়া ঢাকা শহরের সবগুলি রাস্তাই জনশূন্য।

টহল দেওয়া পুলিশের মাথায়ও লতাপাতা বাঁধা।

সারাদেশে চারটি অঞ্চল থেকে সন্মুখ বাহিনীর অভিযান শুরু।

১। পূর্ব ত্রিপুরা রাজ্য থেকে থেকে তিন ডিভিশনের গঠিত চতুর্থ কোর সিলেট-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-কুমিল্লা-নোয়াখালির পথে।

২। উত্তরজনপদ থেকে দুই ডিভিশনে গঠিত ৩৩তম কোর রংপুর-দিনাজপুর-বগুড়া অভিমুখে।

৩। পশ্চিমাঞ্চল থেকে দুই ডিভিশনের সমবায়ে ২য় কোর যশোর-খুলনা-কুষ্টিয়া-ফরিদপুর অভিমুখে।

৪। মেঘালয় রাজ্যের তুরা থেকে ডিভিশন অপেক্ষা কম আর একটি বাহিনী জামালপুর-ময়মনসিংহ অভিমুখে।

এর সঙ্গে যুক্ত হয় ভারতের বিমান আর নৌশক্তি।

চার নম্বর সেক্টর কমান্ডার লেফটেনেন্ট কর্নেল সি আর দত্ত এবং জেড ফের্সের মেজর জিয়াউদ্দিনেরে নেতৃত্বে সিলেটের কানাইঘাট দখলের পর এলাকার শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করেন। তিন নম্বর সেক্টরের মুক্তিবাহিনী শমশের নগর এবং আখাউড়া রেলস্টেশন দখল করে।

আট নম্বর সেক্টরের মুক্তিবাহিনী মেহেরপুর দখল করে যশোরের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করলো । ১১ নং সেক্টরে যৌথ বাহিনী প্রবল আক্রমণ করে পাকিস্তানি সেনার শক্ত ঘাঁটি কামালপুর বিওপি দখল করে।

যুদ্ধ হচ্ছে ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন দখলের। পাকিস্তানি সেনারা স্টেশনটি দখলের সর্বাত্মক চেষ্টা করে।

পাকিস্তান নৌবাহিনীর সাবমেরিন পিএনএস গাজী বিশাখাপত্তম বন্দরের কাছে আক্রান্ত হয়ে ধ্বংস করে। আক্রমণ থেমে নেই ভারতীয় বিমানবাহিনীর। ঢাকা, চট্টগ্রাম, চালনায় পাকিস্তানের সামরিক ঘাঁটিতে বোমাবর্ষণ করছে।

ঢাকায় পাকিস্তানের জঙ্গী বিমান ঘাঁটিতে রাখা ছিল অনেকগুলো চীনা মিগ-১৯ আর স্কোয়াড্রন স্যাবার জেট । এগুলোর অর্ধেকের বেশি গতরাতেই মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে ভারতীয় বিমান বাহিনী।

কূটনৈতিক লড়াই চলছে জাতিসংঘে।

মার্কিন প্রতিনিধি জর্জ বুশ প্রস্তাব করলেন, অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা, ভারত ও পাকিস্তানের নিজ নিজ সৈন্য ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য জাতিসংঘ মহাসচিবকে ক্ষমতা প্রদান করতে হবে।  প্রস্তাবে ভারত ও পাকিস্তানকে একই মানদণ্ডে বিচার করা আর পূর্ব পাকিস্তানে মানবতা বিরোধী অপরাধে দায়ে পশ্চিম পাকিস্তানকে কিছুই বলা হলো না।

জর্জ বুশের প্রস্তাবটি ‘একতরফা’ ঘোষণা দিয়ে ভেটো প্রয়োগ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। আবার বুশের প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয় পোল্যান্ড। ভোটদানে বিরত থাকে ফ্রান্স ওব্রিটেন।

একাত্তরের এইদিনে মুজিবনগর সরকারে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে চিঠিতে লিখলেন, ‘পাকিস্তানের সর্বশেষ আক্রমণের সমূচিত জবাব প্রদানে ভারতীয় বাহিনী এবং বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর মিলিত ভূমিকা সফলতর হতে পারে যদি এই দুটি দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়।’

ওদিকে রাওয়ালপিণ্ডিতে পাকিস্তান সরকারে মুখপাত্র জানায়, পাকিস্তানের উভয় অংশে যুদ্ধ চলছে। পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় চাপ মোকাবিলা করা হচ্ছে। পাকিস্তানকে দৃঢ় সমর্থন দেবে বলে আবারো জানিয়েছে চীন।
শেখ সাদী : লেখক ও গবেষক
এসএ/