ডিসেম্বরের রণাঙ্গন
দেশের কপালে স্বীকৃতির চিহ্নে কে কখন?
শেখ সাদী
প্রকাশিত : ০৯:৩৯ এএম, ৬ ডিসেম্বর ২০২১ সোমবার
বন্ধুত্বের ইতেহাসে উজ্জ্বল দৃষ্টান্তের জন্ম দিল দুই দেশ, ‘ভুটান’ ও ’ভারত’।
স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এখন দুই দেশের স্বীকৃত সত্য। একই দিনে প্রথমে ভুটান। পরে স্বীকৃতি দেয় ভারত। যুদ্ধরত পোড়াদেশের কপালে পড়লো প্রথম স্বীকৃতি । পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত বাঙালির এমন একটি দিনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। তাই, আজ উল্লাস ধ্বনি উচ্চারিত হলো যুদ্ধরত দেশের আনাচে-কানাচে। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার পাশাপাশি পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে ভারত সরকার।
প্রথম স্বীকৃতি ভুটানের। ছয় ডিসেম্বরের সকাল নয়টা ১৫ মিনিটে।
ভুটানের রাজা জিগমে দর্জি ওয়াংচুক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানিয়ে তারবার্তা পাঠালেন। রাজা বললেন, ‘বিদেশি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বাংলাদেশের জনগণের মহান এবং বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম অদূর ভবিষ্যতে সাফল্য লাভ করবে। ভুটানের জনগণ এবং তার প্রত্যাশা, সৃষ্টিকর্তা বর্তমান বিপদ থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করবেন, যেন তিনি দেশের পুনর্গঠন এবং উন্নয়নের মহান কর্তব্যে দেশ ও দেশের মানুষকে নেতৃত্ব দিতে পারেন।’
এরপরই স্বীকৃতি দেয় ভারত।
সকাল ১১টা। ‘অল ইন্ডিয়া রেডিওর তরঙ্গে ভেসে এলো সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতির ঘোষণা।
ভারতের পার্লামেন্টের বিশেষ অধিবেশনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের প্রস্তাব উত্থাপন করে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ‘বাংলাদেশের সব মানুষের ঐক্যবদ্ধ বিদ্রোহ এবং সেই সংগ্রামের সাফল্য এটা ক্রমান্বয়ে স্পষ্ট করে তুলেছে যে তথাকথিত মাতৃরাষ্ট্র পাকিস্তান বাংলাদেশের মানুষকে স্বীয় নিয়ন্ত্রণে ফিরিয়ে আনতে সম্পূর্ণ অসমর্থ।’
ইন্দিরা আরো বললেন, ‘স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে বিশাল বাধার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রাম এক নতুন অধ্যায় রচনা করেছে। সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করার পর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত।’বক্তব্য শেষ না হতেই সংসদ সদস্যরা হর্ষধ্বনি আর ‘জয় বাংলাদেশ’ ধ্বনিতে মুখর করে তোলেন সংসদরা।
এরপর স্বাধীন বাংলা বেতারে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিলেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। ভাষণে ভারতীয় জওয়ানদের অভিনন্দন জানিয়ে বললেন, ভারতের সেনাবাহিনীর জওয়ানরা আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে বাংলাদেশের মাটি থেকে হানাদার শত্রুদের নির্মূল করার জন্য আজ যুদ্ধ করে চলেছে।
এদিকে উত্তর ভিয়েতনামে যুদ্ধরত দক্ষিণ চীন সাগরে দাঁড়িয়ে থাকা সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরের দিকে রওনা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হলো। নৌবহর রওনা দেয়ার আগেই পাকিস্তানি সৈন্যরা পালাতে শুরু করেছে।
মুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গা।
দুপুরে হলো পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁ। দুই এলাকা মুক্ত করে বীরগঞ্জ ও খানসামার পাকিস্তানি সৈন্যদের ক্যাম্পের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা আর মিত্রবাহিনীর দল।
মেজর জলিলের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা সাতক্ষীরা মুক্ত করে এগিয়ে যাচ্ছে খুলনার পথে।
আগেই মুক্ত হয়েছে শেরপুরের পানিহাতা, নালিতাবাড়ি ও বাওয়ামারী।
এবার ঝিনাইগাতির আহম্মদ নগরের পাকিস্তানি সেনার ক্যাম্প আক্রমনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন কোম্পানি কমান্ডার রহমতুল্লাহ। খবর পেয়ে ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা।
শেরপুর সদরে আলবদর কমান্ডার কামারুজ্জামানের বাড়ি ঘিরে ফেললেন মুক্তিযোদ্ধারা।
ধরা গেলো এই মানবতাবিরোধী অপরাধিকে। খবর পাওয়া গেলো, পকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে জামালপুর পালিয়ে গেছে রাজাকার কামারুজ্জামান।
সকাল সাতটায় শেরপুরের আকাশ কাঁপিয়ে নামলো মিত্রবাহিনীর একটা হেলিকপ্টার।
হেলিকপ্টারের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন মিত্রবাহিনীর পূর্বাঞ্চলিয় কমান্ডার লেফটেনেন্ট জেনারেল অরোরা। এলাকার মানুষজন উষ্ণ অভিনন্দন জানালেন অরোরাকে।
গোপন সিদ্ধান্ত হলো বিকেল পাঁচটায় জামালপুর আক্রমণ করা হবে।
এই আক্রমণের সময় যেন কোনভাবেই পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যেতে না পারে সেজন্যে জামালপুর অ্যমবুশের জন্য রহমতুল্লাহ ও তার বাহিনীকে নান্দিনায় ডিফেন্স দেওয়া হলো।
ওদেকে যশোর ছেড়ে দলবল নিয়ে পালিয়ে যায় পাকিস্তানের নয় ডিভিশনের জেনারেল আনসারি।
মিত্রবাহিনী হেঁটে পৌঁছে যায় ঝিনাইদহে। মুক্ত হয় ঝিনাইদহ। এখানেই ছিলেন পাকিস্তানের লেফটেনেন্ট জেনারেল নিয়াজি। ঝিানাদহ দখলছাড়া হয়ে যাবার পর সেনাদের নির্দেশ দিলেন ঢাকা রক্ষা করার। বললেন, মেঘনার তীরে সেনা জমায়েত করতে।
নিয়াজির কোন নির্দেশ কাজে আসছে না। মুক্তিযোদ্ধা আর মিত্রবাহিনীর যৌথ হামলায় কোথায় দাঁড়ানো দূরের কথা প্রাণ রক্ষা করাই এখন কঠিন পাকিস্তানি সেনার। ঢাকা-যশোর মহাসড়কটি এখন মিত্রবাহিনীর দখলে।
মুক্ত হলো হবিগঞ্জ। এইদিন হবিগঞ্জবাসী স্বাধীনতার স্বাদ পায়।
দূর হলো নয় মাসের অবরুদ্ধ পরিবেশের।
শীতকাল। সকালের উজ্জ্বল আলোর আভা ছড়িয়ে পড়লো হাবিগঞ্জের আনন্দে উদ্বেল হবিগঞ্জবাসী মুহূর্তের মধ্যে স্বজন হারানোর বেদনায় থমকে পড়েছিলেন। সূর্যাস্তের পর হবিগঞ্জ শহরে নেমে আসে স্তব্ধতা। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ের খবর শোনার জন্য শহরবাসী রেডিওতে কান পেতেছিলেন।
শায়েস্তানগর ও উমেদনগরে বীর মুক্তিযোদ্ধারা গুলির শব্দে আগমন বার্তা ঘোষণা করলো।
আর; খোয়াই নদীর ওপার থেকে মুক্তিযোদ্ধারা গুলি ছুঁড়তে থাকেন। শায়েস্তানগর এলাকায় বর্তমানের টেলিফোন এক্সচেঞ্জের স্থানে পাকিস্তানী মিলিশিয়াদের যে ক্যাম্পটি ছিল, এখন সেটি ফাঁকা। গতকালই পাকিস্তানি সেনারা শহর ছেড়ে চলে যায়।
পাকিস্তানীদের দালাল রাজাকারের গুলিতে মুক্তিযোদ্ধা সাবেক সেনা সদস্য নূরুল ইসলাম মাসুদ। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা শহরে আর কোন প্রতিরোধের সামনে পড়েনি।
রাজাকার, আলবদর, আল সামস্ বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র হামলার মুখে রাতেই শহর ছেড়ে পালিয়ে যায়। এলাকার মানুষজন মুক্তিযোদ্ধাদের অভিবাদন জানায়, ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানে মুখর হবিগঞ্জ।
মুক্ত হবিগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের যে দলটি প্রথমে প্রবেশ করছে তার সামনে আছে অবসরপ্রাপ্ত ল্যান্স নায়েক আব্দুস শহীদ। সঙ্গে আরো যে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। আছেন, লতিফ, অবসরপ্রাপ্ত হাবিলদার আব্দুল কাইয়ুম, মুহাম্মদ আজিম, আব্দুল মালেক, সাবু মিয়া, রইছ আলী, শুকুর মিয়া, হাবিব মিয়া, আলফু মিয়াসহ অন্তত ৩৫ জন ।
সকাল ১১ টার দিকে পইলের রাস্তা দিয়ে শহরে প্রবেশ করে।
এর আগে তাদের অবস্থান ছিল সাবাসপুর, বক্তারপুর ও সুয়াইয়া গ্রামে। দলটি শহর প্রদক্ষিণ করে থানায় গিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। পরে হাইস্কুল ময়দানে মুক্তিযোদ্ধাদের অভিবাদন জানায় এলাকার হাজার হাজার মানুষ। এদিকে আজ শত্রুমুক্ত হয় চুনারুঘাট ও নবীগঞ্জ।
২
আমেরিকায় এক বৈঠকে তুলে ধরা হলো গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ প্রধান রিচার্ড হেলমেসের সমীক্ষা।
এতে বলা হয়, দশ দিনের মধ্যে ভারতীয় বাহিনী পূর্বাঞ্চলে একচূড়ান্ত সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে সক্ষম হবে। মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষে জেনারেল ওয়েস্টমোরল্যান্ড বরং পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তানের প্রতিরোধের মেয়াদ তিন সপ্তাহ স্থায়ী হতে পারে বলে জানান রিচার্ড হেলমেস।
এবার প্রশ্ন করলেন হেনরি কিসিঞ্জার। জানতে চাইলেন, পূর্ব পাকিস্তানে বিহারিদের কী হত্যা করা শুরু হয়েছে? চলমান রক্তপাত বন্ধের উপায় কী? যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাবটি নিরাপত্তা পরিষদ থেকে সাধারণ পরিষদে কী আজ নেয়া সম্ভব? ভারতের নৌ প্রতিরোধ কী বেআইনি? জর্ডান ও সৌদি আরব থেকে পাকিস্তানের সমরাস্ত্র পাঠানোর পথে যুক্তরাষ্ট্রের আইনে কী কোন বাধা আছে?
বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে আমেরিকার সামরিক হস্তক্ষেপ করতে এখনই এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে চান কিসিঞ্জার। আজকের WSAG বৈঠকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন জরুরি তারবার্তা পাঠলেন সোভিয়েত নেতা ব্রেজনেভকে।
হুমকি দিলেন নিক্সন, ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন যদি পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষার জন্য ভারতকে সামরিকভাবে নিষ্ক্রিয় না করে তবে পরবর্তী মে মাসে প্রস্তাবিত রুশ-মার্কিন শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়া সম্ভব নয়।’
শেখ সাদীঃ লেখক ও গবেষক