ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

চুয়াডাঙ্গা মুক্ত দিবস ৭ ডিসেম্বর

চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি

প্রকাশিত : ১০:৫৯ এএম, ৭ ডিসেম্বর ২০২১ মঙ্গলবার

স্বাধীনতা যুদ্ধের সুতিকাগার বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাজধানী চুয়াডাঙ্গা। ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে চুয়াডাঙ্গা শত্রুমুক্ত করেন বাংলার মুক্তিসেনারা। দেশ স্বাধীনের পর এই দিনটিকে স্থানীয়ভাবে মুক্ত দিবস হিসাবে পালন করা হয়। 

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালোরাতে হানাদার বাহিনীর নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞের পরই চুয়াডাঙ্গার হাজার হাজার মুক্তিপাগল দামাল ছেলেরা দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন। একই রাতে যশোর সেনানিবাস হতে একদল সৈন্য কুষ্টিয়া শহর দখল করে নেওয়ার খবরে মুক্তিযোদ্ধারা শহর রক্ষার জন্য শহরের প্রবেশ পথগুলোতে গাছের ডাল ফেলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন। একই সঙ্গে চুয়াডাঙ্গার বিভিন্ন এলাকা থেকে আনসার, মুজাহিদ ও স্বেচ্ছা সেবকদের শহরের শ্রীমন্ত টাউন হলে একত্রিত করে চুয়াডাঙ্গা ট্রেজারি থেকে সকল অস্ত্র ও গোলাবারুদ তাদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থা মজবুত করা হয়।

এদিকে, চুয়াডাঙ্গা শত্রুমুক্ত থাকার খবর শুনে আওয়ামী লীগের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ও পরবর্তীতে বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ ভারত গমনের উদ্দেশে একমাত্র সঙ্গী ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামকে নিয়ে ৩০ মার্চ চুয়াডাঙ্গায় আসেন। এসময় তিনি স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে আলেচনায় সার্বিক পরিস্থিতিতে সন্তোষ প্রকাশ করে চুয়াডাঙ্গাকে  যুদ্ধকালীন সময়ের জন্য বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী ঘোষণা দেন।

স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতেই সীমান্তবর্তী চুয়াডাঙ্গা জেলা মুক্ত থাকার সুবাদে ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী হওয়ায় চুয়াডাঙ্গায় হয়ে ওঠে বাংলাদেশের রণাঙ্গনের অন্যতম যুদ্ধাঞ্চল।

বিদেশি সংবাদিকদের মাধ্যমে চুয়াডাঙ্গা ডেটলাইনে বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা বিশ্বব্যাপী প্রচারিত হওয়ায় চুয়াডাঙ্গা পাকিস্তানি বাহিনীর টার্গেটে পরিণত হয়। ৩ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গার ওপর প্রথম বিমান হামলা চালানো হয়।

১০ এপ্রিল ভারতের আগরতলায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে উপস্থিত ২৮ জন সংসদ সদস্যের (এমপি) উপস্থিতিতে এক সভায় অস্থায়ী সরকারের রাজধানী ও শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল চুয়াডাঙ্গায় করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়। যদিও সিদ্ধান্তটি নিরাপত্তাজনিত কারণে গোপন রাখার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সেই খবরটি দ্রুত বিদেশি বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। যার ফলশ্রুতিতে পাকিস্থানি বাহিনীর টার্গেটে পরিণত হয় চুয়াডাঙ্গা। 

এরপরই মূলত চুয়াডাঙ্গার ওপর ব্যাপকভাবে বিমান হামলা চালাতে শুরু করে হানাদার বাহিনী। একই সঙ্গে যশোর সেনানিবাস থেকে হানাদার বাহিনীর একটি দল ১৬ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় প্রবেশ করে। চুয়াডাঙ্গা প্রবেশের পরই হানাদার বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালিয়ে অগণিত মানুষকে হত্যা করে শহর দখলে নেয়। এ খবরে দ্রæত দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের সদর দপ্তর চুয়াডাঙ্গা থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়।

মুক্তিযুদ্ধকালীন যুবনেতা বর্তমানে চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সংসদ সদস্য সোলায়মান হক জোয়ার্দার ছেলুনের নেতৃত্বে চুয়াডাঙ্গার তরুণদের একত্রিত করে ২২ এপ্রিল ভারতের হৃদয়পুর শিবিরে ১২০ জন  যুবক নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম ক্যাম্প   চালু করা হয়। যুদ্ধ পরিচালনার জন্য ১১ জুলাই বাংলাদেশের সমগ্র যুদ্ধাঞ্চলকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। সিনিয়র সামরিক কর্মকর্তারা যে যেখানে যুদ্ধরত ছিলেন, তাকে সে অঞ্চলের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ওই এলাকার সব উপদলকে একক অধিনায়কত্বের আওতায় আনা হয়। চুয়াডাঙ্গা ৮নম্বর সেক্টরের অর্ন্তভ‚ক্ত হয়। চলতে থাকে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন রণাঙ্গনে সম্মুখ ও গেরিলা যুদ্ধ। 

৫ আগস্ট চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার নাটুদহের কাছে বাগোয়ান গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে তার সহযোদ্ধা পিন্টু, হাসান, খোকন, কাশেম, রবিউল, রওশন, তারিক ও আফাজউদ্দিন নামে আটজন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাদের জগন্নাথপুর গ্রামের দু’টি কবরে দাফন করা হয়। যা এখন আট কবর নামে পরিচিত। এছাড়া ৭ আগস্ট জীবননগর থানার ধোপাখালি সীমান্তে নিয়মিত বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাঁচজন শহীদ হয়।

সেপ্টেম্বরে ৮নম্বর সেক্টর কমান্ডার হিসেবে লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবুল মনজুর দায়িত্ব নেন। তিনি যুদ্ধ বেগবান করা ও বিজয় অর্জনের লক্ষে যুদ্ধ কৌশলে পরিবর্তন আনেন। ২৬ নভেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীকে হটিয়ে দিয়ে জীবননগরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ৪ ডিসেম্বর মুক্ত হয় দর্শনা। ৭ ডিসেম্বর চুয়াডাঙ্গা ও আলমডাঙ্গা থেকে শত্রুদের হটিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন মুক্তিকামী মানুষ। বিজয়ের বেশে চুয়াডাঙ্গায় প্রবেশ করেন মুক্তিযোদ্ধারা। স্বদেশের পতাকা উড়িয়ে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে আনন্দ উল্লাস করে এলাকার মুক্তিকামী মানুষ।

স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও এখনো অনেক প্রত্যাশিত দাবি পূরণ না হওয়ায় ক্ষোভ ও হতাশা জানিয়েছেন অনেক সাধারণ মুক্তিযোদ্ধারা। 

সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা আলী আজগর ফটিক জানান, ৭১ এর ৩০ মার্চ চুয়াডাঙ্গাকে অস্থায়ী রাজধানী ঘোষণা করে যুদ্ধ পরিচালনা করা হয়। আওয়ামী লীগের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ও পরবর্তীতে বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ এ ঘোষণা দিলেও এখনও সামান্য অধিকার থেকে বঞ্চিত জেলাবাসী।

জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার মোস্তফা খাঁন জানান, দেশ স্বাধীনের দীর্ঘ ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি রক্ষার্থে জেলায় এখনও তৈরি হয়নি স্মৃতিস্তম্ভ। শহীদদের সম্মানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির দাবি তার।

অপর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেনের দাবি, জেলায় অন্তত একটি স্মৃতিস্তম্ভের পাশাপাশি যাদুঘর তৈরি করা হোক। এতে করে নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে আরো দক্ষ হবে। 

জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের সাবেক কমান্ডার আবু হোসেন জানান, মুক্তিযোদ্ধাদের সবার প্রাণের দাবিগুলো পূরণের জন্য বারবার জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন সংশ্লিষ্টদের চিঠি দিয়ে আশ্বাস ছাড়া কিছুই মেলেনি। তাই শুধ আশ্বাস না দিয়ে দাবি পূরণের আহ্বান জানান তিনি। 
এসএ/