ডিসেম্বরের রণাঙ্গন
বুদ্ধিজীবী হত্যায় স্তম্ভিত বিশ্ব, ’ঠ্যাটা মালেইক্কা’র পদত্যাগ
শেখ সাদী
প্রকাশিত : ০৯:১৯ এএম, ১৪ ডিসেম্বর ২০২১ মঙ্গলবার
১৪ ডিসেম্বর। আমেরিকার স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ছয়টা ৪৫ মিনিট। হেনরি কিসিঞ্জার, সোভিয়েত চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ভরনস্তব ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হেগ বৈঠকে বসলেন।
বৈঠকের শুরুতে কিসিঞ্জার বললেন, সোভিয়েত সরকারের কাছ থেকে নিশ্চয়তা পেয়ে আমরা আশ্বস্ত হচ্ছি, পশ্চিম পাকিস্তানের ভূখণ্ড দখল করা ভারতের উদ্দেশ্য নয়। এই বৈঠক একটি বিষয় স্পষ্ট করে, পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করার পর পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে জুড়ে থাকা কাশ্মীর যেন নিরাপদ থাকে। জেনারেল নিয়াজিসহ পাকিস্তানের সেনা কর্তারা পরাজয় মেনে নেওয়ার জন্য গালে হাত দিয়ে বসে আছেন।
চূড়ান্ত বিজয়ের অপেক্ষায় সারাদেশ। বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের সবাই এখন আনন্দে।
শুধু একজনের মন খারাপ। তিনি এখন কলকাতার অফিস ঘরে একা বসে আছেন। মোশতাকের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ সারা ঘরে ঘুরপাক খাচ্ছে।’
ইয়াহিয়ার বার্তা দুপুর দেড়টায় ইয়াহিয়া বার্তা পাঠালেন। প্রাপক দুইজন।
পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর এবং জেনারেল নিয়াজি। বার্তায় লেখা, ‘এখন আপনারা এমন এক অবস্থার মধ্যে পৌঁছেছেন, যেখানে কোনো মানুষের পক্ষে আর লড়াই করা সম্ভব নয়। করেও কোনো ফায়দা নেই। আরও মানুষের প্রাণ যাবে। ক্ষয়ক্ষতি বাড়বে। যুদ্ধ থামাতে এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পাঠানো সেনা ও সহযোগীদের প্রাণ বাঁচাতে যা যা করা দরকার, সব করুন।’
বার্তাটি হাতে নিয়ে উদ্বিগ্ন গভর্নর ডাক্তার এম এ মালিক। বাংলাদেশের মানুষের কাছে তিনি ‘ঠ্যাটা মালেইক্কা ‘ নামে পরিচিত। চিকিৎসা না করে রাজনীতি শুরু করেছেন অনেক আগে থেকে। ‘এখন তার হাত কাঁপছে।-হাত কাঁপা রোগটা পুরনো। কয়েক দিন হলো তা বেড়েছে। টেলিফোনের কাছে গিয়ে বসলেন। একবার প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে কথা বলতে চান। তবে কী বলবেন? বুঝে উঠতে পারছেন না। কাঁপা কাঁপা হাতে ডায়াল করলেন। একবার-দুইবার না, অন্তত দশবার রিং বাজল।
ইয়াহিয়া ফোন রিসিভ করলেন না। ‘
২
মুক্তিযুদ্ধের এই দিনে শহীদ হন বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসেবে যোগ দেন সাত নম্বর সেক্টরে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ ঘাঁটি হানাদার মুক্ত করার যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। মহানন্দা নদী পার হয়ে শত্রুর বাংকার দখল করে এগিয়ে যাচ্ছেন, এমন সময় পাকিস্তানি সেনার গুলি এসে লাগে কপালে। শহীদ হন জাহাঙ্গীর। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ সরকার তাকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করেন।
আজ শত্রুমুক্ত হয় সাভার, দিনাজপুর, বগুড়ার শিবগঞ্জ, জয়পুরহাটের পাঁচবিবিসহ চট্টগ্রামের বান্দরবন।
ঢাকা শত্রুমুক্ত করতে মরিয়া মুক্তি-মিত্র। পরাজয় নিশ্চিত জেনে জরুরি বৈঠক ডাকলেন গভর্নর মালিক। গোপন বৈঠক। পকিস্তানের গোপন সংকেতের সিগনাল ধরে ফেলে দিল্লী। দ্রুত সিদ্ধান্ত, সকাল ১১টায় বৈঠক চলার সময়েই বিমান হামলা করা হবে।
শিলং বিমানঘাঁটি থেকে মিগ-২১ গভর্নর হাউসের ওপর রকেট হামলা। প্রকম্পিত হয়ে ওঠে সারা এলাকা। গোপন বৈঠকটি আর হলো না। প্রাণের ভয়ে পদত্যাগ পত্র লিখে মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়ে গভর্নর হাউস থেকে বেরিয়ে এলেন মালিক। উঠলেন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। হোটেলে বোমার ভয় নেই।
ক্যান্টনমেন্টের গোপন ব্যাংকারে মাথা নিচু করে বসে আছেন লে জে নিয়াজি। রাওয়ালপিণ্ডি সদর দপ্তরের প্রতি বিরক্ত। কোথায় সপ্তম নৌবহর? কোথায় চীনের বন্ধুরা? চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাচ্ছেন দাড়ির ফাঁস। আর, কানে বেজেই চলেছে, মিত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক মানেকশ-র কথা, ‘নিয়াজি হাতিয়ার ডাল দো। হাতিয়ার ডাল দো!’
কোনরকম নিজেকে সামলে নিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে প্রস্তাব পাঠালেন লে জে নিয়াজি। কোন উত্তর নেই। এবার ফোন করলেন পকিস্তানের কমান্ডার ইন চিফ হামিদকে। বললেন, অনুগ্রহ করে জানান যে দ্রুত কোন ব্যবস্থা নেয়া যায় কিনা? দিন শেষে এলো ইয়াহিয়ার লম্বা চিঠি। এতে আত্মসমর্পনের কোন কথা নেই। বরং, বলা হয়েছে পাকিস্তানি সৈন্যদের জীবন রক্ষার ব্যবস্থা করুন।
এদিকে যেসব বাঙালি জ্ঞানে-গুণে এগিয়ে থাকা। সেসব উন্নত চিন্তার মানুষদের আগেই তলিকা করে রেখেছিলেন রাও ফরমান। সেই তালিকাটি এখন পাকিস্তানি সেনার দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর হাতে।
এখন ফরমানের নির্দেশে উন্নত মানুষদের খতম অভিযান। রাতের অন্ধকারে সবার চোখ বেঁধে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। হত্যা করে। এই বর্বরতায় স্তম্ভিত হয় বিশ্ববিবেক।
শেখ সাদীঃ লেখক ও গবেষক
এসবি/