গাছকে জুতার শোরুম বানিয়ে সন্তোষ মণ্ডলের ৪১ বছর
জামাল হোসেন, বেনাপোল থেকে
প্রকাশিত : ০৩:৩২ পিএম, ১৮ ডিসেম্বর ২০২১ শনিবার
রাস্তার ধারে জুতা সেলাই আর কালি এবং নতুন নতুন জুতা বানিয়ে জীবনের মূল্যবান ৪১টি বছর কাটিয়ে দিয়েছেন সন্তোষ মণ্ডল। কিন্তু একটি দোকানের ইচ্ছা পূরণ হয়নি। সেলাই-কালির সামান্য আয় দিয়েই চলে তার ৯ জনের সংসার। এখন কাজ কম তাই আগের মত আয় নেই, আধাপেটে দিন কাটে জুতার কারিগর সন্তোষের।
যশোর-বেনাপোল হাইওয়ে সড়কের নাভারণ ডিগ্রি কলেজের সামনে একটি শিশু গাছের নিচে একাধারে ৪১ বছর ধরে এই কাজ করছেন সন্তোষ। এই শিশু গাছটিও তার নিজের হাতে লাগানো। কলেজের ছাত্র-ছাত্রীসহ নাভারণ বাজারের অধিকাংশ ব্যবসায়ীই তাকে চেনেন। এলাকার অনেকের কাছে তিনি সন্তোষ দা।
সন্তোষ মণ্ডলের বয়স এখন ৬৫ বছর। ২৪ বছর বয়সে এই পেশায় আসেন তিনি। দীর্ঘদিন ধরে এই কাজ করলেও নিজের ভাগ্য ফেরাতে পারেননি। সংসারে লোক বাড়তে থাকায় খরচ বেড়েছে কিন্তু আয় না বাড়ায় বরং অভাব বেড়েছে। অভাবের সংসারে বড় মেয়ে সীমা বিধবা হয়ে দুই সন্তান নিয়ে উঠে কষ্ট আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন।
অসাধারণ মানুষ সন্তোষ। ৪১ বছর একই স্থানে বসে কাজ করছেন। অথচ আশপাশের কারো সাথে কখনই ঝগড়াঝাটি হয়েছে বলে কেউ বলতে পারেননি। অনেক কষ্ট জগদ্দল পাথরের মত বুকের উপর চেপে থাকলেও কোন টু-শব্দ নেই।
অভাব থাকলেও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মধুর সম্পর্ক। সন্তোষের ৪ ছেলেমেয়ে। বড় মেয়ে সীমার বয়স ৩৫। বিয়ে হয়েছিল, স্বামী স্ট্রোক করে মারা যাবার পর থেকে দুই ছেলে নিয়ে বাপের সংসারে। দ্বিতীয় সন্তান চন্দন দুই ছেলের জনক। সেও বাপের সংসারের সাথে। তৃতীয় সন্তান রতন বিয়ে করে অন্যত্র চলে গেছে। ছোট মেয়ে ইতি দুই মেয়ে নিয়ে আছে স্বামীর সংসারে।
খেয়ে না খেয়ে দিন কাটে সন্তোষ মণ্ডলের। সকালে পান্তাভাত যা জোটে তাই খেয়ে কাজে বেরিয়ে পড়েন। দুপুরে খাওয়া বলতে এক টাকার দুটি বিস্কুট আর এক মগ পানি। বলেন, দুপুরে না খেয়ে খেয়ে আর খিদে লাগে না। সয়ে গেছে।
সন্তোষের ইচ্ছে ছিল একদিন জুতা সেলাই আর কালি করতে করতেই হয়ত একটি নতুন জুতার দোকান দিতে পারবেন। পারবেন ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে। চেষ্টার কমতি ছিল না তার। কিন্তু ভাগ্য সহায় হয়নি। তাই ৪১ বছর ধরে একই জায়গায় একই কাজ করছেন।
সম্পদ বলতে পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ৩ শতক জমি। আর নিজের দেহ। ঘর বলতে সেই টালির দোচালার দুই রুম। আত্মীয় স্বজন আসলে ঘরে আর শোবার জায়গা থাকেনা। বারান্দা অথবা প্রতিবেশীর বারান্দায় ঠাঁই হয় স্বামী-স্ত্রীর।
এতে সন্তোষের কোন আক্ষেপ নেই। কিন্তু সন্তোষের চিন্তা অন্যখানে। তার কিছু হয়ে গেলে স্ত্রী বেচারার কী হবে?
প্রতিদিনের আয় থেকে কিছু কিছু সঞ্চয় করে তা দিয়ে নতুন জুতা তৈরির কাঁচামাল চামড়া, রাবার এবং আঠাসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস ক্রয় করেন। পরে তা দিয়ে নতুন জুতা তৈরি করেন। গরিব নিম্নবিত্তরাই সন্তোষ দা’র নতুন জুতার খরিদ্দার।
আক্ষেপ করে সন্তোষ মণ্ডল বলেন, ‘আমার জুতার মান অনেক ভালো হলেও ধনী এবং মধ্যবিত্তরা তো ফুটপাতে এসে গাছে টাঙ্গানো জুতা কিনবে না। লোকে দেখে ফেললে তাদের জাত যাবে। তাই মাঝে মাঝে যা দু’এক জোড়া বিক্রি হয় তা ওই গরিব লোকেরাই কেনে।’
জুতা কেন গাছে টাঙিয়ে রাখেন? এ কথা জিজ্ঞাসা করতেই সন্তোষ দা’র চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। বললেন, আমার তো কোন দোকান ঘর নেই, যেখানে জুতা শো-কেচে শোভা পাবে। তাই খরিদ্দারদের দৃষ্টি আনতেই নতুন জুতা গাছে ঝুলিয়ে রেখেছি। ধরেন, এই শিশু গাছটিই আমার জুতার শো রুম।
৬৫ বছরের সন্তোষের জীবনের গতি থামানোর উপায় নেই, বিশ্রামেরও সুযোগ নেই। আর বিরতি সে তো অলিক কল্পনা। কেননা এই পড়ন্ত বিকেলে এসে বিশ্রাম আর বিরতির কথা ভাবলে তো জীবনই থেমে যাবে। সকাল থেকে সন্ধ্যা অব্দি নিরন্তর আধা পেটা দেহের উপর ভর করে চলা এই পেশা হতে বেরিয়ে আসার কোন পথ নেই।
ন্যুজ্ব দেহ নিয়ে নিরবে সব কিছু মেনে নিয়ে চলেছেন অবিরত। নেই কোন প্রতিবাদ, নেই কোন অভিযোগ-অনুযোগ। একটি দোকান করার আশা সন্তোষ মণ্ডলের। কারও সহযোগিতা পেলে তার আশা পূরণ হতে পারে, নচেৎ নয়।
এএইচ/