নদীতে মধ্যরাতে পুড়ে যাওয়া লঞ্চটিতে কী ঘটেছিল?
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৫:৩০ পিএম, ২৪ ডিসেম্বর ২০২১ শুক্রবার
ঢাকার সদরঘাট থেকে শত শত যাত্রী নিয়ে বরগুনার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়া অভিযান-১০ নামের লঞ্চটির যাত্রীরা বলছেন, লঞ্চটি বরিশাল ঘাট ধরে বরগুনা যাওয়ার পথে রাত দু'টার দিকে আগুন ধরে যায়। এ সময় আর্তনাদ, হৈ-চৈ আর চিৎকারে অবর্ণনীয় এক পরিবেশ তৈরি হয় মাঝনদীতে থাকা লঞ্চটিতে এবং আগুন থেকে প্রাণ বাঁচাতে নদীতে ঝাঁপ দিতে থাকেন নারী, পুরুষ ও শিশুরা, যাদের অনেকেই এখনও নিখোঁজ।
এক পর্যায়ে ঝালকাঠির দিয়াকূল গ্রামের তীরে লঞ্চটি ভেড়ান হলেও দ্রুত নামতে গিয়ে আহত হন আটকে পড়া যাত্রীদের অনেকে। শিশু সন্তান হারিয়ে এখনও খুঁজে ফিরছেন কেউ কেউ।
একজন যাত্রী বলেন, যখন মাঝরাতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে, তখন একদিকে আগুন আর অন্যদিকে পানি- এ ছাড়া আর তো কোনো উপায় ছিল না।
যাত্রীদের কয়েকজন জানিয়েছেন, ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়ার পর থেকেই ইঞ্জিনের দিক থেকে মাঝে মধ্যেই জোরে শব্দ হচ্ছিল, আর প্রচণ্ড কালো ধোঁয়া দেখা যাচ্ছিলো।
লঞ্চের তিন তলার একটি কেবিনে থাকা যাত্রী জহিরুল বলছিলেন, "আমরা অনেকেই বুঝতে পারছিলাম যে, কোনও একটা ঝামেলা হচ্ছে। লঞ্চের ফ্লোরগুলোও গরম হয়ে উঠছিলো। ইঞ্জিনে প্রচণ্ড শব্দ হচ্ছিল আর ব্যাপক কালো ধোঁয়া দেখছিলাম। স্টাফরা তবুও বলছিল, সমস্যা হবে না।"
আগুন লাগার পর নদীতে লাফ দেন জহিরুল এবং প্রায় এক ঘণ্টা ভাসার পর তীরে আসতে সক্ষম হন। আগুনে তার দুই পা-ই পুড়ে গেছে। হাসপাতাল থেকে ফোনে কথা বলেন তিনি।
তাঁর দেয়া তথ্য অনুযায়ী, সদরঘাট থেকে ছেড়ে যাওয়ার পর একটা ইঞ্জিনেই চলছিল লঞ্চটি। পরে চাঁদপুর ছাড়ার পর দ্বিতীয় ইঞ্জিনটি চালু করা হয়।
জহিরুল বলেন, "এরপর ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ ব্যাপক চিৎকারে ঘুম ভেঙ্গে যায়। দরজা খুলে দেখি আগুন দেখা যাচ্ছে। স্টাফরা তখনও বলছিল ধৈর্য্য ধরেন। কিন্তু আগুনের উত্তাপ সইতে না পেরে দিলাম নদীতে ঝাঁপ"।
তখন কেমন ছিল লঞ্চটির ভেতরের অবস্থা-
যাত্রীরা বলছেন, লঞ্চটি বরিশাল ঘাট ধরে সুগন্ধা নদী হয়ে বরগুনা যাচ্ছিল। হঠাৎই প্রচণ্ড শব্দ শোনা যায় এবং রাত দু'টার পর থেকে রাত তিনটার মধ্যে সম্পূর্ণ লঞ্চটিতে আগুন ধরে যায়। এক পর্যায়ে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেলেও গতির কারণে লঞ্চটি রানিং ছিল বেশ কিছুটা সময়।
এ সময়ে বাতাসে আগুন আরও ছড়িয়ে পড়ে। তাছাড়া যাত্রীবাহী সব লঞ্চের মতো এটিতেও যাত্রীদের প্রচুর পরিমাণ কাপড় আর ভেতরের ফ্লোরে কার্পেটের মতো থাকায় দ্রুতই আগুন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
তিন তলা লঞ্চটির নীচতলার পেছনের অংশে ছিল ইঞ্জিন রুম। এরপর থেকে সামনের অংশ পর্যন্ত কিছু মালামাল আর অনেক যাত্রী ছিল, যারা মূলত কার্পেটের ওপর কাপড় বিছিয়ে নিজেদের ঘুমানোর জায়গা করে নিয়েছিলেন।
পুড়ে যাওয়ার পর ভেতরের অবস্থা-
নিজেদের কাপড়ের ব্যাগ থেকে শুরু করে লাগেজ বা বস্তা ছিল অনেক যাত্রীর সঙ্গে। কিন্তু ঠিক কতো যাত্রী ছিলো তার কোন তথ্য কারও কাছে নেই। লঞ্চটিতে আগাম টিকেট কাটার ব্যবস্থা ছিল না।
দোতলার সামনের অংশে কেবিন আর বাকী অংশের পুরোটাই খোলা জায়গা, যা ডেক হিসেবে পরিচিত। সেখানে অনেক পরিবার, নারী ও শিশু থাকায় কাপড় দিয়ে নিজেদের থাকার জায়গা ঘিরে দিয়েছিল তাঁরা। আবার নীচতলা ও দোতলার ডেকের অংশে লঞ্চটির দু'পাশে পর্দা হিসেবে ত্রিপল দেয়া ছিল।
বাবাকে পেয়েছেন, এখনও মাকে খুঁজছেন আমেনা-
আমেনা আক্তার নামে এক শিক্ষার্থী তাঁর বাবা-মায়ের সঙ্গে দোতলায় ছিলেন। তিনি বলেন, "মনে হয় আজানের আগে হঠাৎ বাবা ঘুম থেকে ডেকে তুললো। বাবা-মাসহ তিন তলার ছাদে উঠে গেলাম। দেখি আগুন নেভেনা। একপর্যায়ে একেবারে কাছে চলে আসলো আগুন। তখন আমি লাফ দিলাম। পরে বাবাকে পেলেও মাকে এখনও পাইনি।"
মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ নামে আরেকজন যাত্রী জানান, মধ্যরাতে ২/৩টা শব্দ শুনতে পান তারা। এরপর নীচে সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে দেখেন আগুন। আবার উপরে রওনা দিয়ে দেখেন সেখানেও আগুন দেখা যাচ্ছে।
আব্দুল্লাহ বলেন, "চারদিকে কাপড় লাগানো। এক পর্যায়ে কাপড় বেয়ে নীচে নেমে লঞ্চের সামনের দিকে চলে যাই। দেখি যাত্রীতে ভরপুর। তার উল্টো দিকে দেখি তীর দেখা যায়। প্যান্ট বাদে সব খুলে ঝাঁপ দেই পানিতে। দু 'মিনিট পরে নদীর পাড় পেয়ে যাই।"
নদীতে অনেক নারী পুরুষকে সাঁতরানোর চেষ্টা করতে দেখেছেন তিনি। তীরে পৌঁছার পর নিজের জামা দিয়ে আরেকটা মেয়েকে সহায়তাও করেছেন এই যাত্রী।
আর্তনাদ, হৈ-চৈ
আমেনা আক্তার বলেছেন, ঘুম ভেঙ্গেই তিনি সবদিক থেকে চিৎকার আর আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছিলেন। এরপর তিন তলার ছাদ থেকে যখন লাফ দেন তখন বাবা মায়ের দিকে তাকাবার মতো হুঁশ তার ছিল না। তিনি বলেন, "কখন যে সবাইকে ছেড়ে লাফ দিলাম বুঝতেই পারিনি।"
তবে নীচতলা ও দোতলার ডেকের যাত্রীরা আগুন আগে টের পেলেও কেবিনের যাত্রীরা টের পেয়েছেন অনেক পরে। মূলত হৈ-চৈ শুনে তাদের অনেকের ঘুম ভাঙ্গে। অনেকে ধোঁয়ায় দমবন্ধ অবস্থায় পড়েন কেবিনের মধ্যে।
তিনতলার একটি কেবিনে ছিলেন জহিরুল এবং শব্দ শুনে দরজা খুলে আগুন দেখে হতভম্ব হয়ে যান তিনি। চারদিক থেকে চিৎকারের শব্দ আসছিল। পরে নদীতে লাফ দেন এবং এক ঘণ্টা পর তীরে আসতে সক্ষম হন।
এসব যাত্রীরা বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। সূত্র- বিবিসি বাংলা।
এনএস//