ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ১০ অক্টোবর ২০২৪,   আশ্বিন ২৪ ১৪৩১

মেরিন ড্রাইভ আল্ট্রা-ম্যারাথন

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৬:২৩ পিএম, ২৬ ডিসেম্বর ২০২১ রবিবার | আপডেট: ০৬:৩০ পিএম, ২৬ ডিসেম্বর ২০২১ রবিবার

ভোরে ঘুম ভেঙে দেখি আজও আকাশ কালো হয়ে আছে, আবারও বৃষ্টি ঝরল বলে। গতকাল বিকেল থেকেই সাগর থমথমে হয়ে আছে। নিন্মচাপ জোয়াদ বোধহয় কাছাকাছি চলে এসেছে। ঝিরিঝিরি বাতাসের মধ্যে তটের দিকে এগিয়ে গেলাম।

সাতদিন ধরে কক্সবাজারের ইনানিতে, অথচ এর মধ্যে একদিনও সাগরতটে পা রাখার সুযোগ পাইনি। শেষ দিন সন্ধ্যায় মেরিন ড্রাইভ আল্ট্রাম্যারাথন-২০২১ এর আসর ভেঙ গেল।

সকল ম্যারাথনার ও স্বেচ্ছাসেবকরা চলে যাবার পর আমরা আট দশজন স্বেচ্ছাসেবক রয়ে গেছি সবকিছু গোছগাছ করার জন্য। এবার সৈকতে বাঁশের তৈরি বিশাল গেইট বসেছিল, সেই সাথে প্রচুর ব্যানার ও ফেস্টুন লাগানো হয়েছিল। এগুলো সব একে একে এখন খুলে ফেলছি। প্যানাফ্লেক্সের এই ব্যানারগুলো আপসাইকেলের জন্য চমৎকার একটি পণ্য। এছাড়া এই ব্যানারগুলো স্থানীয়রা ফুটো হয়ে যাওয়া টিনের চালে, কিংবা দোকানের ছাউনি হিসেবে তেরপালের মতো করে ব্যবহার করে থাকেন।

আমরা অনেকেই ম্যারাথন ক্রীড়াটির সাথে পরিচিত হলেও আল্ট্রা-ম্যারাথন ক্রীড়াটি অনেকের কাছেই নতুন মনে হতে পারে। ম্যারাথনে অংশগ্রহণকারীদের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট দুরত্ব অতিক্রম করে ফিনিশ লাইনে পৌঁছাতে হয়। আল্ট্রা-ম্যারাথন বা আল্ট্রা-রান এমন একটি সময় বেঁধে দেয়া রেস যার দৈর্ঘ্য প্রথাগত ফুলম্যারাথন অর্থাৎ ৪২.২ কিলোমিটার এর চেয় বেশি দৈর্ঘ্যের হয়। ম্যারাথন ও আল্ট্রা-ম্যারাথন বৈশ্বিকভাবে জনপ্রিয় ক্রীড়া কর্মকান্ড। সারা বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতি বছর অসংখ্য ম্যারাথন ও আল্ট্রা-ম্যারাথন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। সমাজ সচেতনতা, ইতিবাচক জীবনধারায় মানুষকে উদ্বুদ্ধকরণ, বিভিন্ন স্থান ও দেশের ইতিবাচক ব্রান্ডিং এর ক্ষেত্রে ম্যারাথন বিশ্বজুড়ে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। 

গত ৩ থেকে ৪ ডিস্বেম্বর ২০২১ তারিখে আয়োজিত দেশের সবচেয়ে লম্বা দৈর্ঘ্যের আল্ট্রা-ম্যারাথন ‘মেরিন ড্রাইভ আলট্রা’-এর দ্বিতীয় আসরের গল্প বলছি। দেশের সবচেয়ে বড় ভ্রমন বিষয়ক সামাজিক প্ল্যাটফর্ম ট্রাভেলার্স অব বাংলাদেশ (টিওবি) গত এক যুগের বেশী সময় ধরে বাংলাদেশে নানা রকম আউটডুর কর্মকাণ্ড আয়োজন করে আসছে। টিওবি’র বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মধ্যে ব্যাকপ্যাকিং, এডভেঞ্চার ট্রেকিং, বিচ হাইকিং, মাউন্টেনিয়ারিং, ট্রেজার হান্ট, কমিউনিটি ট্যুরিজম, পর্যটন গন্তব্য সমূহে পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা, পর্যটন তথ্য সহায়তা প্রদান, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের চিত্তবিকাশে সহায়তা কার্যক্রম ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এরই ধারাবাহিকতায় টিওবি এবং সহযোগী প্রতিষ্ঠান এসকাপেড এর যৌথ উদ্যোগে ২০২০ সাল থেকে কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে এই আল্ট্রা-ম্যারাথন। এবছর মহান স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের জন্য উৎসর্গকৃত এই আল্ট্রা-ম্যারাথন আয়োজনটির স্লোগান ছিলো ‘দেশ আমার, দায়িত্ব আমার’।

৫০ কিলোমিটার, ১০০ কিলোমিটার আর ১০০ মাইল- এই তিনটি ক্যাটাগরীতে ম্যারাথনাররা অংশ নিয়েছেন এই আল্ট্রা-ম্যারাথনে। এই আল্ট্রা-ম্যারাথনটিতে অংশ নেয়ার জন্য ম্যারাথনারদের কাছ থেকে কোনো প্রকার রেজিস্ট্রেশন ফী নেয়া হয় নি অর্থাৎ এই আল্ট্রা-ম্যারাথনটি ছিলো ম্যারাথনারদের জন্য সম্পূর্ণ ফ্রী। তবে চুড়ান্ত তালিকায় ঠাঁই পাবার জন্য তাঁদেরকে একটা বাছাই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। আগ্রহী ম্যারাথনারদের পূর্বের রেকর্ড যাচাই বাছাই করে আয়োজকগণ চুড়ান্ত অংশগ্রহণকারীদের নির্বাচন করেছেন। 

গত বছর শুরু হওয়া মেরিন ড্রাইভ আল্ট্রা আয়োজনটি এবছর আরো বড় পরিসবে আয়োজিত হয়েছে। গতবার ১২০ জন অংশগ্রহণকারী আল্ট্রা-ম্যারাথনার নিয়ে আয়োজিত হয়েছিলো মেরিন ড্রাইভ আল্ট্রা-২০২০ আর এবার অংশগ্রহণকারী ম্যারাথনারদের সংখ্যা ছিলো আড়াইশ (২৫০) এর অধিক। ম্যারাথনারদের তাঁবুবাস, খাবার, পানীয়, বিশ্রাম, শুশ্রূষা, চিকিৎসা ও অন্যান্য সহযোগিতার জন্য কক্সবাজারের ইনানী থেকে টেকনাফ এই পুরো পথ জুড়ে এগারোটি ক্যাম্পে শতাধিক স্বেচ্ছাসেবক নিয়োজিত ছিলেন এবার। 

এবারের আয়োজনের সবচেয়ে অনন্য বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো অংশগ্রহণকারী হিসেবে অন্যান্য ম্যারাথনারদের পাশাপাশি শারীরিক প্রতিবন্ধি, ট্রান্সজেন্ডার এবং বিশেষভাবে সক্ষম (অটিস্টিক) মানুষদের এই আল্ট্রা-ম্যারাথনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই উৎসবে আমাদের সমাজের প্রতিবন্ধী, সুবিধা বঞ্চিত, বৈষম্যের শিকার এবং বিশেষভাবে সক্ষম মানুষদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার মাধ্যমে বৈষম্যহীন ও একটি সমাজ গড়ার প্রচেস্টাকে সবার সামনে তুলে ধরা আমাদের কাছে বিশাল একটি গুরুত্বপুর্ণ ব্যাপার ছিলো। তৃতীয়লিঙ্গ, অন্ধ, হুইলচেয়ার এবং বিশেষভাবে সক্ষম ম্যারাথনাররা যে সকলের সাথে সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে পারেন, এবারের মেরিন ড্রাইভ আল্ট্রা তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলে আমাদের বিশ্বাস। বিশেষ করে, গত ৩ ডিসেম্বর বিকেলে, বাংলাদেশের প্রথম ট্রান্সজেন্ডার আল্ট্রা-ম্যারাথনার হিসেবে ইভান আহমেদ কথা ৫০ কিলোমিটারের আল্ট্রা-ম্যারাথন সফলভাবে শেষ করে (ফিনিশার হয়ে) প্রমাণ করতে পেরেছেন যে, যথাযথ পরিবেশ ও বৈষম্যহীন সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে তাঁরা দেশ ও সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারেন। 

এবারের মেরিন ড্রাইভ আল্ট্রায় বিশেষভাবে সক্ষমদের যেনতেনভাবে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেই দায় সারতে চাওয়া হয়নি; বরং দৃষ্টিহীনরাও যেন পড়তে পারেন সে বিষয়টি মাথায় রেখে এবারকার মেরিন ড্রাইভ আল্ট্রা এর সকল ফিনিশার মেডেল ছিল ব্রেইল মেডেল অর্থাৎ মেডেলের লেখা গুলো সাধারণ বর্ণমালার পাশাপাশি ব্রেইল বর্ণমালাতেও লিখিত ছিল। মেডেলের কথা যখন উঠল তখন আরও কিছু কথা না বললেই নয়। আমাদের দেশে সাম্প্রতিক সময়ে অনুষ্ঠিত হওয়া ম্যারাথন ইভেন্টগুলোতে যে ফিনিশার মেডেল দেয়া হয়েছে বা হচ্ছে তা পুরোটাই চায়না বা বাইরের কোনো দেশ থেকে আমদানি করা হয়। মেরিন ড্রাইভ আল্ট্রা গর্ব করে বলতে পারে তাঁদের নান্দনিক ফিনিশার্স মেডেলগুলো দেশীয় থিমে দেশী কারিগরদের হাতে দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি করা হয়। এবারের ফিনিশার মেডেল বিশেষভাবে ডিজাইন করা এবং হ্যান্ড ক্র্যাফটিং এর মাধ্যমে তৈরিকরা হয়েছে। মেডেলের ডিজাইনে কক্সবাজারের ঐতিহ্যবাহী চাঁদ নৌকার (মুন বোট) এমব্লেম রাখা হয়েছে। মেডেলের রিবন হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে রাখাইনদের ঐতিহ্যবাহী পোষাক থামি-র ফেব্রিক ও ডিজাইন।  

মেরিন ড্রাইভ আল্ট্রা স্থানীয় কৃষ্টি ও ঐতিহ্যকে বিশ্বের সামনে তুলে পাশাপাশি চেষ্টা করেছে পুরো ইভেন্টের সাথে স্থানীয় মানুষদের সম্পৃক্ত করতে। তিন দিন ব্যাপী চলা এই বিশাল কর্মযজ্ঞের সম্ভাব্য সকল কিছু স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনা করা হয়েছে। স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সামাজিক, আর্থিক ও সাংস্কৃতিকভাবে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে কমিউনিটি বেইসড ট্যুরিজম উন্নয়নে ট্রাভেলার্স অফ বাংলাদেশ(টিওবি) সব সময় সচেষ্ট থাকে। মেরিন ড্রাইভ আল্ট্রাতেও সেই প্রচেস্টার প্রতিফলন ঘটিয়েছে টিওবি। 

কক্সবাজারে বিশ্বের দীর্ঘতম সমূদ্র সৈকতের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া আমাদের এই মেরিন ড্রাইভ অসাধারণ সুন্দর একটি রাস্তা। বাংলাদেশ ব্যান্ডিং, অর্থাৎ বাংলাদেশকে ইতিবাচকভাবে বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে মেরিন ড্রাইভের এই মনোরম পথে আল্ট্রা-ম্যারাথনের মতো প্রেস্টিজিয়াস ম্যারাথনের আয়োজন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে আমাদের বিশ্বাস। মেরিন ড্রাইভ আল্ট্রা একদিন সারা বিশ্বের আল্ট্রা-ম্যারাথনারদের কাছে পরিচিত হয়ে উঠবে - এই আমাদের স্বপ্ন। একদিকে আরাকান ইয়োমা পর্বতশ্রেণীর শেষাংশ আরেকিকে বঙ্গপোসাগরের সুনীল জলরাশি। এর মাঝদিয়ে উত্তর-দক্ষিন বরাবর চলে গেছে পিচ ঢালা মসৃণ এর সুদীর্ঘ রাজপথ। সেই পথ ধরে দৌড়ে যাচ্ছে একদল আল্ট্রা-ম্যারাথনার। মাঝে মাঝে তাঁরা পার হয়ে যাচ্ছেন ইতস্তত ঘন ঝাউবন, খোলা প্রান্তর, সৈকত জুড়ে রঙবেরঙ এর নিশান উড়িয়ে বিশ্রাম নেয়া সব চাঁদ নৌকা, সাদা বালিয়ারি জুড়ে লাল কাকড়াদের ছুটোছুটি আর সামূদ্রিক কচ্ছপদের অভয়ারণ্য, পাহাড়ের নিচের ক্ষেতগুলোতে সোনালী ফসল কাটার ধুম, জেলেপল্লীতে নৌকা এসে ভিড়লে উৎসাহী জনতার ভীড় আর ৪/৫ লিকোমিটার পর পর মেরিন ড্রাইভ আল্ট্রার ভলান্টিয়ার ক্যাম্প। যারা রাতের অন্ধকারেও দৌড়েছেন ১০০ কিলোমিটার ও ১০০ মাইল দূরত্ব সময়ের মধ্যে পাড়ি দেয়ার লক্ষ্যে, তাঁদের জন্য আকাশজুড়ে বিছানো ছিল রাশি রাশি নক্ষত্ররাজি। এমন বৈচিত্র্যময় পথের সাথে একাত্ম হয়ে চলতে পারা সকল রানার ও ক্রুদের জন্য সত্যিকার অর্থেই ছিলো ওয়ান্স ইন আ লাইফ টাইম এক্সপেরিয়েন্স। 

মেরিন-ড্রাইভ আল্ট্রায় কেউ ফার্স্ট বা সেকেন্ড হন না। এখানে সবার আগে শেষ করা ম্যারাথনারদের জন্য কোনো পোডিয়াম থাকে না। এবার নানা জনের কাছে বারবার একই প্রশ্ন শুনতে হয়েছে। এরা কেন এভাবে দৌড়াচ্ছে? অনেক বড় পুরস্কার আছে বুঝি? ফার্স্ট সেকেন্ড থার্ডের জন্য? আমরা বলেছি না ভাই, এখানে এমন কোন পুরষ্কার নেই। নিজের সামর্থকে চুড়ান্ত চ্যালেঞ্জ করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ৫০ কিলোমিটার, ১০০ কিলোমিটার বা ১০০ মাইল দূরত্ব অতিক্রম করে ফিনিশার হওয়াই এখানে সবচেয়ে বড় পুরস্কার। সকল ফিনিশারই এখানে সমান। অন্যের সাথে প্রতিযোগীতা নয়, বরং নিজেকে চ্যালেঞ্জ করে নিজের কমফোর্ট জোনের বাইরে গিয়ে নিজের সামর্থের সীমানাকে অতিক্রম করার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়কে অনুপ্রাণিত করাই আমাদের এই আল্ট্রা-রানের উদ্দেশ্য। ফিনিশ লাইনে এসে মেডেল নেবার সময় এই অনুপ্রেরণাকেই উদযাপন করেছেন মেরিন ড্রাইভ আল্ট্রা ২০২১ এর ফিনিশার ম্যারাথনাররা।

এসি