শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জন্মদিন
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৮:৪৪ এএম, ২৯ ডিসেম্বর ২০২১ বুধবার
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের ১০৮তম জন্মবার্ষিকী ২৯ ডিসেম্বর। এই গুণী শিল্পী ১৯১৪ সালের এ দিনে তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহুকুমার কেন্দুয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। বিংশ শতাব্দীর একজন বিখ্যাত বাঙালি চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিন। বাংলাদেশে চিত্রশিল্প বিষয়ক শিক্ষার প্রসারে আমৃত্যু প্রচেষ্টা চালিয়েছেন তিনি।
আলোকবর্তিকা হয়ে শিল্পের পথ দেখিয়েছেন প্রকৃতি ও মানুষের ছবি আঁকা এই চিত্রকর। বিশ্বসভায় তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের শিল্প ও সংস্কৃতি। শুধু তাই নয়, বাংলার চারুশিল্প আন্দোলনেও রেখেছেন পথিকৃতের ভূমিকা। তার বিখ্যাত চিত্রকর্মের মধ্যে রয়েছে দুর্ভিক্ষ-চিত্রমালা, সংগ্রাম, সাঁওতাল রমণী, ঝড়, কাক, বিদ্রোহী ইত্যাদি। ১৯৭০ সালে গ্রামবাংলার উৎসব নিয়ে আঁকেন তাঁর বিখ্যাত ৬৫ ফুট দীর্ঘ ছবি নবান্ন।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের বাবা তমিজউদ্দিন আহমেদ ছিলেন পুলিশের দারোগা (সাব-ইন্সপেক্টর), মা জয়নাবুন্নেছা গৃহিণী। নয় ভাইবোনের মধ্যে জয়নুল আবেদিন ছিলেন সবার বড়। খুব ছোটবেলা থেকেই তিনি ছবি আঁকতে পছন্দ করতেন। পাখির বাসা, পাখি, মাছ, গরু-ছাগল, ফুল-ফল এঁকে মা-বাবাকে দেখাতেন। ছেলেবেলা থেকেই শিল্পকলার প্রতি তার গভীর আগ্রহ ছিল লক্ষ্যণীয়। মাত্র ষোল বছর বয়সে বাড়ি থেকে কলকাতায় পালিয়ে ছিলেন গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস দেখার জন্য।
কলকাতা গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস ঘুরে আসার পর সাধারণ পড়াশোনায় জয়নুল আবেদিনের মন বসছিল না। তাই ১৯৩৩ সালে মাধ্যমিক (ম্যাট্রিক) পরীক্ষার আগেই স্কুলের পড়ালেখা বাদ দিয়ে কলকাতায় চলে যান এবং মায়ের সমর্থনে গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস-এ ভর্তি হন। জয়নুল আবেদিনের আগ্রহ দেখে তাঁর মা নিজের গলার হার বিক্রি করে ছেলেকে কলকাতার আর্ট স্কুলে ভর্তি হতে সাহায্য করেন।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে একটি চিত্রকলা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন অনুভব করেন জয়নুল আবেদিন। সে লক্ষ্যে তাঁরই উদ্যোগে ১৯৪৮ সালে পুরান ঢাকার জনসন রোডের ন্যাশনাল মেডিকেল স্কুলের একটি জীর্ণ কক্ষে গভর্নমেন্ট আর্ট ইন্সটিটিউট স্থাপিত হয়। সূচনায় এর ছাত্র সংখ্যা ছিল মাত্র ১৮। জয়নুল আবেদিন ছিলেন এ প্রতিষ্ঠানের প্রথম শিক্ষক।
১৯৫১ সালে এই আর্ট ইন্সটিটিউট সেগুনবাগিচার একটি বাড়িতে স্থানান্তরিত হয়। ১৯৫৬ সালে আর্ট ইন্সটিটিউটটি শাহবাগে স্থানান্তরিত হয়। ১৯৬৩ সালে এটি প্রথম শ্রেণির সরকারি কলেজ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে এবং এর নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর এই প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘বাংলাদেশ চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়’। জয়নুল আবেদিন ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
জয়নুল আবেদিনের আগ্রহ ও পরিকল্পনায় ১৯৭৫-এ নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে লোকশিল্প জাদুঘর ও ময়মনসিংহে জয়নুল সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠা করে সরকার।
জয়নুল আবেদিন ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ চিত্রমালার জন্য বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন। এ ছাড়াও তার বিখ্যাত শিল্পকর্মগুলো হল: ১৯৫৭-এ নৌকা, ১৯৫৯-এ সংগ্রাম, ১৯৭১-এ বীর মুক্তিযোদ্ধা, ম্যাডোনা প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর দীর্ঘ দুটি স্ক্রল ১৯৬৯-এ অঙ্কিত ‘নবান্ন’ এবং ১৯৭৪-এ অঙ্কিত ‘মনপুরা-৭০’ জননন্দিত দুটি শিল্পকর্ম। তিনি চিত্রাঙ্কনের চেয়ে চিত্রশিক্ষা প্রসারের ওপর অনেক বেশি সময় ব্যয় করেছেন। অনুমান করা হয় তার চিত্রকর্মের সংখ্যা তিন হাজারেরও বেশি।
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংগৃহীত তার শিল্পকর্মের সংখ্যা ৮০৭। বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের সংগ্রহে আরও প্রায় পাঁচশত চিত্রকর্ম সংরক্ষিত আছে। তাঁর পরিবারের কাছে সংরক্ষিত আছে চার শতাধিক চিত্রকর্ম। ময়মনসিংহের সংগ্রহশালায় রক্ষিত চিত্রকর্মের সংখ্যা ৬২। এছাড়া পাকিস্তানের বিভিন্ন সংগ্রহশালায়ও তাঁর বিপুল পরিমাণ চিত্রকর্ম সংরক্ষিত আছে।
পূর্ববঙ্গে তথা বাংলাদেশে চিত্রশিল্প বিষয়ক শিক্ষার প্রসারে আমৃত্যু প্রচেষ্টার জন্য তিনি শিল্পাচার্য উপাধী লাভ করেন। বাংলাদেশের চিত্রকরদের মধ্যে তিনি শিল্পগুরু বিবেচিত। তাঁর নামে চারুকলা অনুষদে একটি গ্যালারি রয়েছে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ৩৫ নম্বর গ্যালারিটিকে শিল্পচার্য জয়নুল আবেদিন চিত্রশালা হিসাবে সজ্জিত করে।
ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন কর্তৃক ৯ জুলাই ২০০৯ বুধ গ্রহের একটি জ্বালামুখ তার মানবসভ্যতায় মানবিক মূল্যবোধ ও উপলদ্ধিকে গভীরতর করার প্রেক্ষিতে আবেদিন জ্বালামুখ নামে নামকরণ করা হয়।
বিশ্বের প্রাচীনতম ও সর্ববৃহৎ ব্রিটিশ নিলামকারী প্রতিষ্ঠান বনহামসে তার স্কেচ বিক্রয় হয়। তিনি ১৯৫৮ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের সবচেয়ে বড় খেতাব হেলাল-ই-ইমতিয়াজ, ১৯৬৮ সালে ঢাকা আর্ট কলেজের ছাত্রদের তরফ থেকে ‘শিল্পার্চায’ উপাধী এবং ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে জাতীয় অধ্যাপকের সম্মান লাভ করেন।
১৯৭৬ সালের ২৮ মে ৬১ বছর বয়সে ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন জয়নুল আবেদিন।
এসএ/