ঢাকা, বুধবার   ০৯ অক্টোবর ২০২৪,   আশ্বিন ২৩ ১৪৩১

বছরজুরে খবরের পাতায় হাজী দানেশ বিশ্ববিদ্যালয় 

মো. তানভির আহমেদ, হাবিপ্রবি প্রতিনিধি

প্রকাশিত : ০১:৫৬ পিএম, ৩১ ডিসেম্বর ২০২১ শুক্রবার

করোনা ভাইরাসের প্রকোপ ঠেকাতে ২০২১ সালের আড়াই মাস বাদে পুরোটা সময় বন্ধ ছিলো দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। তবে বছরজুরে নানা আলোচিত, বিতর্কিত সেইসঙ্গে সাফল্যজনক ঘটনায় সংবাদের শিরোনাম হয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি। বছরজুরে হাবিপ্রবিতে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে আজকের আয়োজন।

মধ্যরাতে উপাচার্যের ক্যাম্পাস ত্যাগ
চাকরির দাবিতে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের অবস্থান কর্মসূচির পর মঙ্গলবার (১২ জানুয়ারি) দিবাগত রাত আনুমানিক ৩টার দিকে হঠাৎ ক্যাম্পাস ছাড়েন সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মু. আবুল কাসেম। হঠাৎ গভীর রাতে ক্যাম্পাস ত্যাগ করার বিষয়ে জানতে চাইলে কোষাধ্যক্ষ বিধান চন্দ্র হালদার সেসময় বলেছিলেন, ‘উপাচার্য স্যার বলেছিলেন উনার স্ত্রী অসুস্থ ছিলেন, তার চিকিৎসা প্রয়োজন ছিল। তবে তিনি কবে ফিরে আসবেন এটা ঠিক করে বলা যাচ্ছে না। এছাড়া স্যারের মেয়াদেরও শেষ সময় চলে এসেছে।’ দীর্ঘ ১০ মাস উপাচার্য নিজ বাসভবনে নিজে থেকে অবরুদ্ধ থাকার পর মঙ্গলবার (১২ জানুয়ারি) মধ্যরাতে হঠাৎ বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যাওয়ার ঘটনা অনেককেই বিস্মিত করেছে। অনেকের ধারণা চাকরি প্রত্যাশিদের চাপের ফলেই ভিসি ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। সাবেক উপাচার্যের মেয়াদ শেষ হয় ফেব্রুয়ারিতে।

আবাসিক হলে পুকুর চুরি
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রড, ইন্টারনেট ক্যাবল চুরির পাশাপাশি ডরমিটরি-২ হলের গণরুমে ব্যাপক চুরির অভিযোগ পাওয়া যায়। গত বৃহস্পতিবার (১৫ অক্টোবর) ডরমিটরি -২ হলে গণরুমের শিক্ষার্থীরা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আনতে গিয়ে প্রথম চুরির ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন। সেসময় সরেজমিনে পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, গণরুমের সব কিছু লন্ড ভন্ড অবস্থায় পরে রয়েছে। ট্রাঙ্ক এবং টেবিলের ড্রয়ার ভেঙে ফেলা হয়েছে। ল্যাগেজ, ব্যাগ, বই, জামা-জুতা, রান্না করার হাড়ি-পাতিল পর্যন্ত চুরি হয়েছে অনেক শিক্ষার্থীর। খোয়া গেছে বিভিন্ন সার্টিফিকেট এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আইডি কার্ডও। পড়ে রয়েছে শুধু লেপ, তোষক আর বালিশ! ক্ষতিগ্রস্থ শিক্ষার্থীরা এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের হল প্রশাসনকেই দুষেছেন। বন্ধ ক্যাম্পাসে বন্ধ হলে নিরাপত্তা কর্মী থাকা অবস্থায় কিভাবে এমন বৃহৎ চুরির ঘটনা ঘটলো এমন প্রশ্ন তুলে সেসময় ক্ষতিপূরণ দাবি করে ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীরা। পরে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও আর কোন অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায়নি। এরপর আবারও সেই একই হলের কয়েকটি কক্ষের তালা ভেঙে চুরি হয় জিনিসপত্র। সেসময় একজনকে আটক করে হল প্রশাসন। এরপর বঙ্গবন্ধু হল এবং শেখ রাসেল হলেও চুরির অভিযোগ করেন কয়েকজন শিক্ষার্থী। গেলো ২৬ জুন নির্মাণাধীন দশ তলা ভবনের গ্রাউন্ড ফ্লোরের স্টোর রুম থেকে ২৪৬ কয়েল ইলেকট্রিক তার চুরি হয়, যার আনুমানিক বাজার মূল্য প্রায় ১০ লাখ টাকা।

শিক্ষার্থীদের সাফল্য
চাকুরীর পরিক্ষায় সাফল্য দেখান এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। পুলিশ, প্রশাসনসহ মোট প্রায় ২০ জন ক্যাডার সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায় ৩৮তম বিসিএস পরীক্ষায়। একসাথে বাংলাদেশ পুলিশের ৩৮তম বহিরাগত ক্যাডেট এসআই (নিরস্ত্র) পদে নিয়োগ পান বিভিন্ন বিভাগের সাবেক ২৯ শিক্ষার্থী। পূর্ব আফ্রিকার দেশ সোমালিয়ার হিরশাবিল অঙ্গরাজ্যের এমপি নির্বাচিত হন কৃষি অনুষদের জেনেটিক্স অ্যান্ড প্লান্ট ব্রীডিং বিভাগ থেকে ২০১৮-১৯ সেশনে মাস্টার্স ডিগ্রী সম্পন্ন করা সাকারিয়া সোলাইমান। নৌবাহিনীর ডিও-২০২১ ব্যাচে সফলভাবে ট্রেনিং সম্পন্ন করে শ্রেষ্ঠ ডাইরেক্ট এন্ট্রি অফিসার হিসেবে ‘বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন স্বর্ণপদক’ লাভ করেন ইইই বিভাগের ১৪তম ব্যাচের সাবেক শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান তুহিন। আট বছর বিরতি দিয়ে পর্দা ওঠা বঙ্গবন্ধু নবম বাংলাদেশ গেমসে ৫০ মিটার প্রোন ম্যান জুনিয়র ইভেন্টে ব্রোঞ্জ পদক জিতেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৯ ব্যাচের আবু সুফিয়ান। এছাড়া বিভিন্ন পদক ও  গবেষণার কাজে সফলতা দেখান হাবিপ্রবিয়ানরা।

গবেষণায় হাবিপ্রবি
গেলো দুই বছর হাবিপ্রবিতে বেশ করেকটি গবেষণা কর্ম সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে বন্যা ও লবণাক্ততা সহিষ্ণু উচ্চফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় হতে ৩০টি গবেষণা প্রকল্পে ৬০জন শিক্ষকের ফেলোশিপ প্রাপ্তি, কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের পিএইচডি গবেষক ফররুখ আহমেদ-এর গবেষণায় এবং প্রফেসর ড. মো. হাসানুজ্জামান ও প্রফেসর ড. ভবেন্দ্র কুমার বিশ্বাস এর তত্ত্বাবধানে করলার দু’টি নতুন জাত ‘HSTU-1’ ও ‘HSTU-2’ উদ্ভাবন, ইত্যাদি অন্যতম। ভৌতবিজ্ঞান, খাদ্য ও কৃষি বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিজ্ঞান এই তিন ক্যাটাগরিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মোট ৩ হাজার ২৪৯ জনের মধ্যে হাবিপ্রবি থেকেই ফেলোশিপের জন্য মনোনীত হয়েছেন ১৩৯ শিক্ষার্থী। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের গবেষণা প্রকল্পের আওতায় ২০২০-২১ অর্থবছরে জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি (এনএসটি) ফেলোশিপ প্রদান করা হয়। ডিসেম্বরে প্রকাশিত এডি সাইন্টিফিক ইনডেক্স র‍্যাঙ্কিংয়ে হাবিপ্রবির ১৪ গবেষকের নাম রয়েছে। পাশাপাশি সূর্যমুখী ফুল নিয়েও গবেষণা চলে বিশ্ববিদ্যালয়ে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা আন্দোলন 
বছরজুড়ে আলোচনায় ছিলো করোনায় দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার আন্দোলন। বছরের শুরুতে অনলাইন পরীক্ষার দাবি এবং করোনা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হওয়ায় সশরীরে পরীক্ষার দাবিতে থেমে থেমে বেশ কয়েকটি মানববন্ধন ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করে শিক্ষার্থীরা। দেশজুড়ে বিভিন্ন সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার দাবিতে হওয়া আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করায় ছাত্রসমাজের কাছে প্রশংসিত হন হাবিপ্রবির এসব শিক্ষার্থীরা।

হাবিপ্রবির নতুন উপাচার্য নিয়োগ 
দীর্ঘ পাঁচ মাস পর ৩০ জুন নতুন উপাচার্য পায় হাবিপ্রবি। সপ্তম উপাচার্য হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে যোগদান করেন অধ্যাপক ড. এম কামরুজ্জামান। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতাকালে এই নিয়োগ পান।

প্রশাসনের উল্লেখযোগ্য কর্মকান্ড
বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে বাড়ি ফেরা
২০২১ সালের জুন মাসে পরীক্ষার ঘোষণায় বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ভোগান্তিতে পড়েছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের  প্রায় আট হাজার শিক্ষার্থী। দিনাজপুর সদর উপজেলা লকডাউন ঘোষিত হওয়ায় ২১ জুন পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত পূর্ব ঘোষিত সকল পরীক্ষা স্থগিত করে দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা এসব শিক্ষার্থীরা পরেন বিপাকে। এদিকে সারাদেশের বেশিরভাগ জেলা লকডাউনের আওতায় থাকায় বাড়ি ফেরা নিয়েও শঙ্কা তৈরি হয়েছিলো শিক্ষার্থীদের মাঝে। এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব পরিবহন দিয়ে শিক্ষার্থীদের বাড়ি পৌঁছে দেয় বিশ্ববিদ্যালয়। 

বোর্ডবৃত্তিপ্রাপ্তদের ক্রেডিট ফি মওকুফ
হাবিপ্রবি সাংবাদিক সমিতি কর্তৃক আয়োজিত  এক লাইভ অনুষ্ঠানে  বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম কামরুজ্জামানের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন বোর্ড বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বোর্ড বৃত্তিপ্রাপ্তদের ক্রেডিট ফি মওকুফের সিদ্ধান্ত নেয়। 

করোনাকালীন সেশনজট নিরসনে উদ্যোগ
উপাচার্যের সভাপতিত্বে ৫ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৮তম অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলে শিক্ষার্থীদের অ্যাকাডেমিক ক্ষতি পুষিয়ে দিতে সেমিস্টার ৬ মাস থেকে কমিয়ে ৪ মাসে সম্পন্ন এবং প্রতি ৫০ মিনিটের ক্লাসের সময় ২০ মিনিট বাড়িয়ে ৭০ মিনিট করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। তবে ঘোষণার প্রায় তিন মাসেও বিভিন্ন বিভাগে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি প্রতীয়মান হয়নি।

স্বাস্থ্যবিমা সুবিধা
নিয়মিত শিক্ষার্থীদেরকে স্বাস্থ্য ও জীবনবিমা প্রকল্পের আওতায় প্রত্যেক শিক্ষার্থী হাসপাতালে ভর্তির ক্ষেত্রে বার্ষিক সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা বিমা-সুবিধা পাবেন। এর মধ্যে হাসপাতালে থাকাকালীন কেবিন বা ওয়ার্ডের ভাড়া, হাসপাতাল সেবা, অস্ত্রোপচারজনিত ব্যয়, চিকিৎসকের পরামর্শ ফি, ওষুধ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিল বাবদ দৈনিক সর্বোচ্চ তিন হাজার টাকা চিকিৎসা ব্যয় পাবে একজন শিক্ষার্থী।

বিজয়ের মাসে মাসব্যাপী কর্মসূচি
মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সূবর্ণ জয়ন্তীর সন্ধিক্ষণে বিজয়ের মাসকে স্মরণীয় করে রাখতে মাসব্যাপী নানা কর্মসূচী ঘোষণা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বিজয়ের মাসের প্রথম দিনে পহেলা ডিসেম্বর (বুধবার) মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তীর লোগো সম্বলিত ফেস্টুন-ব্যানার ও আলোকসজ্জার মাধ্যমে বিজয়ের মাস উদযাপনের শুভ সূচনা করা হয়। এছাড়াও অন্যান্য কর্মসূচীর মধ্যে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক গুরুত্বপূর্ণ আলোকচিত্র, চলচ্চিত্র ও পোস্টার প্রদর্শনী, ‘শিক্ষার্থীর ভাবনায় আগামীর বাংলাদেশ’ শীর্ষক রচনা প্রতিযোগিতাসহ অনুষদভিত্তিক ছাত্রদের অংশগ্রহণে ‘মুজিববর্ষ ফুটবল টুর্নামেন্ট’ এবং ছাত্রীদের অংশগ্রহণে বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেসিয়ামে ‘বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্ট’, ক্রিকেট টুর্ণামেন্ট ইত্যাদি। সাথে ছিলো সন্ধ্যা থেকে টিএসসির সামনে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক মাসব্যাপী চলচিত্র প্রদর্শনী যা দর্শক স্বল্পতায় কিছুদিন চলার পর বন্ধ হয়ে যায়। মুজিব স্মারক গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচনের মধ্যে দিয়ে শেষ হয় হাবিপ্রবির মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তী উদযাপন অনুষ্ঠান।
এসএ/