কোভিড: শঙ্কার আবর্তে সফলতা
রিজাউল করিম
প্রকাশিত : ০৮:৫০ এএম, ১ জানুয়ারি ২০২২ শনিবার
নতুন বছর ২০২২ শুরু। বিদায় নিয়েছে ২০২১। বিভিন্ন কারণে ২০২১ সাল মহাকালের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। করোনাভাইরাস সংক্রমণে মৃত্যুর মিছিল, লকডাউন, টিকার প্রত্যাশা, ওমিক্রনের প্রাদুর্ভাব ইত্যাদি।
বছরজুড়ে করোনার ঝুঁকি পিছু ছাড়েনি। ঝুঁকি কখনও কমেছে, আবার কখনও বেড়েছে। ঝুঁকি মোকাবেলায় নেওয়া হয়েছে নানা পদক্ষেপ। যার ফলে নিয়ন্ত্রণে এসেছে করোনায় মৃত্যুর হার। বলা হচ্ছে, বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় কোভিড নিয়ন্ত্রণে সফল বাংলাদেশ। তবে বছর শেষে ওমিক্রনের চোখ রাঙানিতে সৃষ্টি হয়েছে নতুন শঙ্কা। শঙ্কার আবর্তে থেকেই বছরটিতে ছিল আমাদের কিছু অর্জন, হতাশা, বেদনা, প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা।
বছরের শুরুতে করোনাভাইরাস
শূন্যের কোঠায় না নামলেও বছরের শুরুতে দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কম ছিল। মার্চের মাঝামাঝি সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি দৃশ্যমান হয়। তারপর থেকে সেই প্রবণতা জুলাইয়ের শেষ পর্যন্ত ছিল।
দেশে প্রথম কোভিড রোগী শনাক্ত হয় ২০২০ সালের ৮ মার্চ। এর ১০ দিন পর ১৮ মার্চ ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়ে ৭০ বছর বয়সী একজন পুরুষ মারা যান। এরপর বাড়তে থাকে শনাক্ত ও মৃত্যুর হার। ২০২০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫ হাজার ৭ জনে। এই সময়ে গড়ে ৩৯ জনের মৃত্যু হয়। পাঁচ হাজার মানুষ মারা যাওয়ার পর সেই সংখ্যা ১০ হাজারে যেতে সময় লাগে ছয় মাস ২২ দিন। তবে এ সময় শনাক্ত এবং মৃতের হার ছিল অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু ২০২১ সালের ১৫ এপ্রিল করোনাভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় ১০ হাজার ৮১ জনে। এই সময়ে গড় মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ২৫ জন।
লকডাউন
এরপর রাজধানীসহ সারা দেশের বিভিন্ন জেলায় লকডাউন দেওয়া হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয় আন্তঃজেলা গণপরিবহন। পাশাপাশি সংক্রমণ ঠেকাতে সারাদেশের সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগ বন্ধ করতে ট্রেন এবং সব ধরনের যাত্রীবাহী নৌযানও বন্ধ করে দেওয়া হয়।
সরকারিভাবে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার পরও সাধারণ মানুষকে ঠেকানো যায়নি। লাগাম টানা যায়নি রাজধানী ছেড়ে যাওয়া, এক জেলা থেকে আরেক জেলায় যাতায়াত। বিকল্প উপায়ে নানা বাহানায় লোকজন রাজধানী ছেড়েছে, আবার ফিরেছে।
ভাইরাসের ভারতীয় ধরনের দাপট
সীমান্ত খোলা থাকায় বৈধ-অবৈধ উপায়ে মানুষ ভারতে যাওয়া-আসার মাধ্যমে করোনার ভারতীয় ধরনটি ছড়িয়েছে সারা দেশে। ঢাকায় আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা কমে গেলেও সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে তা ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে রাজধানীর বাইরে ক্রমেই সংক্রমণ ও মৃত্যু আশঙ্কাজনক হারে বাড়তে থাকে।
মৃত্যুর সর্বোচ্চ রেকর্ড
চলতি বছরের ১৫ এপ্রিল যেখানে মৃতের সংখ্যা ছিল ১০ হাজার ৮১ জন, সেখানে মাত্র দুই মাস ১৯ দিনে (৭৯ দিন) ১০ হাজার থেকে বেড়ে করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫ হাজার ৬৫ জন। এই সময়ে গড়ে মৃত্যু হয় ৬৩ জনের। ৩ জুলাই করোনায় মৃতের সংখ্যা ছিল ১৫ হাজার ৬৫ জন। সেদিন থেকে ৫৫ দিনের মধ্যে পাঁচ হাজার বেড়ে এই সংখ্যা হয় ২০ হাজার ২৫৫ জন। এই সময়ে গড়ে ৯৪ জনের মৃত্যু হয়।
এর ২৩ দিন পর (২২ আগস্ট) মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২৫ হাজার ২৮২ জনে। এবার মাত্র ২৩ দিনে মারা যায় পাঁচ হাজার ২৭ জন মানুষ। গড়ে এসময় মারা গেছেন ২১৯ জন করে। এটাই করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর থেকে গড় মৃত্যুর সর্বোচ্চ রেকর্ড। ২৩ আগস্টের পর থেকে আবারও কমতে শুরু করে মৃতের সংখ্যা। সেদিন থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ ১৩০ দিনে মারা যায় দুই হাজার ৭৫৬ জন। এ সময়ে গড়ে ২১ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ভাইরাসের শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত (৮ মার্চ ২০২০ থেকে ১৫ ডিসেম্বর ২০২১) ১ বছর নয় মাস সাত দিনে দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১৫ লাখ ৮০ হাজার ৩০২ জন। মারা গেছে ২৮ হাজার ৩৮ জন। সুস্থ হয়েছে ১৫ লাখ ৪৪ হাজার ৯৩৩ জন।
মহামারী নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ
কোভিডের চিকিৎসায় বিভিন্ন হাসপাতালে ১৮ হাজার শয্যা তৈরি করেছে সরকার। ১২০টি হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা হয়েছে, যেখানে কয়েক হাজার শয্যার সঙ্গে অক্সিজেন সংযোগ দেয়া আছে। সারা দেশে ৮০০ ল্যাব স্থাপিত হয়েছে। সরকারি উদ্যোগে প্রায় বিনামূল্যে (১০০ টাকায়) সারা দেশে করোনাভাইরাসের পরীক্ষা করানো হচ্ছে। নিয়োগ হয়েছে ১৫ হাজার ডাক্তার, ২০ হাজার নার্স।
কূটনৈতিক তৎপরতা
২০২১ সালের শুরু থেকেই টিকা পাওয়ার জন্য বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালায় সরকার। বিশেষ করে, চীন, ভারত, রাশিয়া, জাপান, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব প্রভৃতি দেশের কাছে টিকা পাওয়ার জন্য যোগাযোগ শুরু করে। সরকারের সে উদ্যোগ সফলও হয়। এছাড়াও কোভ্যাক্সের আওতায় বেশ কয়েকটি দেশ থেকে টিকা আনার জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ছিল চোখে পড়ার মতো।
টিকা কার্যক্রমের শুরু
প্রাণঘাতী ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণে সফলতা এসেছে ধীরে ধীরে। সংক্রমণ ধরা পড়ার (৮ মার্চ, ২০২০) ১১ মাস পর চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি সরকারিভাবে টিকাদান কার্যক্রম শুরু হয়। প্রথমে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি টিকা দিয়ে এ কার্যক্রম শুরু হয়। শুরুতে টিকা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে শুধুই ভারতের ওপর নির্ভর করেছিল বাংলাদেশ। ২১ জানুয়ারি দেশে প্রথম ভারতের উপহারের টিকা আসে। ২৫ জানুয়ারি আসে কেনা টিকা। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী ভারত থেকে টিকা না পাওয়ায় একপর্যায়ে টিকাদান কর্মসূচি হোঁচট খায়। সমস্যা কাটিয়ে উঠতে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায় চীন। চীনের সিনোফার্মের টিকা এখন পর্যন্ত প্রধান উৎস হয়ে আছে। এরই মধ্যে ভারত, চীন, জাপানসহ বেশ কয়েকটি দেশ থেকে বাংলাদেশ উপহার হিসেবে টিকা পেয়েছে। পাশাপাশি কোভ্যাক্স থেকেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে টিকা দেশে এসেছে। দেশে এখন পাঁচ প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত টিকা দেওয়া হচ্ছে। এগুলো হলো- অ্যাস্ট্রাজেনেকা, ফাইজার, সিনোফার্ম, মডার্না ও সিনোভ্যাক।
টিকা প্রাপ্তি
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, ইতোমধ্যে দেশের মোট জনসংখ্যার ৩৭ শতাংশের বেশি মানুষ এক ডোজ করে টিকা পেয়েছেন। পাশাপাশি ২২ শতাংশের বেশি মানুষ দুই ডোজ করে টিকা পেয়েছেন। চলতি বছরের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত সাত কোটি ৪৫ লাখ ৩৬ হাজারের বেশি মানুষ কোভিড-১৯ টিকার জন্য নিবন্ধন করেছেন। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮০ শতাংশ অর্থাৎ ১৩ কোটি ৮২ লাখ ৪৭ হাজার ৫০৮ জন মানুষকে করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করেছে সরকার। পাশাপাশি বর্তমানে ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদেরও টিকার আওতায় আনা হয়েছে।
টিকা নিবন্ধনে জটিলতা
টিকা পাওয়ার নিবন্ধনের ক্ষেত্রে শুরু থেকে যে জটিলতা ছিল, বছর শেষেও তা রয়ে গেছে। ছয় কোটির মতো মানুষ এখনো নিবন্ধন করেননি। নিবন্ধন করেছেন এমন প্রায় ৫০ লাখ মানুষ এখনো টিকার প্রথম ডোজই পাননি। বিপুলসংখ্যক মানুষ নিবন্ধন না করা, নিবন্ধন করেও টিকা না পাওয়া মূলত স্বাস্থ্য বিভাগের যথাযথ উদ্যোগের ঘাটতির কারণ বলে মনে করছেন অনেকে।
ওমিক্রনের প্রাদুর্ভাব
দেশে করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রন আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় গত ১১ ডিসেম্বর। ওমিক্রন শনাক্ত হওয়া ওই দু’জনই বাংলাদেশ জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের সদস্য। সর্বশেষ ৫৬ বছর বয়সী এক ব্যক্তির ওমিক্রন শনাক্তের খবর পাওয়া গেছে। যার নমুনা গত ২৩ ডিসেম্বর সংগ্রহ করা হয়।
বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স ডেটা গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা ডেটা (জিআইএসএআইডি) প্রতিষ্ঠান এ তথ্য দিয়েছে।
বুস্টার ডোজ
ওমিক্রন নিয়ন্ত্রণে ইতোমধ্যে দেশে বুস্টার ডোজ কার্যক্রম শুরু করেছে সরকার। ১৯ ডিসেম্বর থেকে রাজধানীর মহাখালী বিসিপিএসএ প্রতিষ্ঠানে বয়স্ক এবং ফ্রন্টলাইনাদের (চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ান, গণমাধ্যমকর্মী) দিয়ে এ কার্যক্রম শুরু হয়। পর্যায়ক্রমে সারা দেশেই বুস্টার ডোজ দেওয়া হবে।
বিশ্বের অনেক দেশ যখন করোনার ভয়াল থাবায় জর্জরিত, সেখানে অনেকটাই সফল বাংলাদেশ। পৃথিবীর সব দেশের সঙ্গে এদেশেও পাল্লা দিয়ে বেড়েছিল মৃত্যু-সংক্রমণ। তবে সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় করোনা নিয়ন্ত্রণে অনেকটাই সফল দেশ। এর নেপথ্যে আছে ধারাবাহিক টিকাদান কর্মসূচি। ফলে ভাইরাসটির তৃতীয় ঢেউ সামলে মৃত্যুর সংখ্যা এখন এক অঙ্কে পৌঁছেছে। যদিও নতুন করে আফ্রিকান ধরন ওমিক্রন চোখ রাঙাচ্ছে। সেদিকেও সতর্ক দৃষ্টি আছে বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দাবি।
আরকে/এসএ/