পাকিস্তানের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সমীকরণ
অধ্যাপক ডাঃ মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)
প্রকাশিত : ০১:২৬ পিএম, ১ জানুয়ারি ২০২২ শনিবার
বাংলাদেশকে নিয়ে ইদানিং পাকিস্তানীদের উৎসাহের মাত্রাটা একটু দৃষ্টিকটূ রকমেরই বাড়াবাড়ি। গত কয়েক বছর ধরেই এই ফেনোমেননটি বিশেষভাবে চোখে পড়ার মতো। বিগত বছরজুড়ে বাংলাদেশে আমরা যখন ব্যস্ত ছিলাম মুজিববর্ষ আর বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের ব্যস্ততায়, ঠিক সেই সময়টায় পাকিস্তানের পক্ষ থেকে আমরা দু’রকম উদ্যোগ লক্ষ করেছি। একদিকে পাকিস্তানের লক্ষ্য ছিল তাদের এদেশীয় দালাল এবং এজেন্টদের কাজে লাগিয়ে আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় দুটি উৎসবকে কলংকীত করা। যে কারণেই মুজিববর্ষের শুরুতেই একজন অর্বাচিন মাওলানাকে আমরা দেখলাম বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে বুড়িগঙ্গায় ছুড়ে ফেলার হুমকি দিয়ে মাঠ দাপাতে।
ঠিক একইভাবে মুজিববর্ষ উদযাপনের মূল আনুষ্ঠাকিতার সময়টায় মুক্তিযুদ্ধের অকৃত্রিম বন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে জল ঘোলা করার কম প্রচেষ্টাও আমরা দেখিনি। কোন কারণ ছাড়াই সাম্প্রদায়িক উসকানিতে একদিকে যেমন কালি লেপে দেয়া হয়েছে এবারের শারদীয় উদযাপনে, তেমনি বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর ঠিক আগ দিয়ে পাকিস্তান ক্রিকেট দলের ঢাকায় ফ্ল্যাগ উড়িয়ে অনুশীলন কিংবা এদেশের কিছু নির্লজ্জ যুবক-যুবতীর পাকিস্তানের সমর্থনে ঢাকার গ্যালারিতে বেলেল্লাপনাও আমাদের মাথা হেঁট করে দিয়েছে। একথা এখন আর অস্বীকার করার কোনই জো নেই যে, আজ থেকে পঞ্চাশ বা একশ বছর পর আমাদের উত্তরসূরীরা যখন মুজিববর্ষ কিংবা বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর ইতিহাস লিখতে বসবেন তখন তাদের এই কলংকজনক বাস্তবতাগুলোকে বাদ দিয়ে সেই ইতিহাসকে বিধৃত করার কোনই সুযোগ থাকবে না।
এর পাশাপাশি মুদ্রার আরেকটি পিঠও আছে। পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর এখন একটি অন্যতম এজেন্ডা এখন হচ্ছে একাত্তরে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এদেশে যে জঘন্য মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছে, তার প্রতি বিশ্বের যে ক্রমবর্ধমান আগ্রহ সেদিন থেকে বিশ্বাবাসীর নজর অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়ার। শুরু থেকেই একাত্তরের ব্যাপারে পাকিস্তানী ন্যারেশানটা ছিল এরকম যে, বাংলাদেশ স্বাধীনচেতা বাঙ্গালীর দুই যুগেরও বেশি সময়ের স্বাধীকার আন্দোলনের কোনো ফসল নয়, বরং তা পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করার ভারতীয় চক্রান্তের সফল বাস্তবায়নমাত্র। যে কারণে তারা শুরু থেকেই বাংলাদেশ-পাকিস্তান ভাই-ভাই জাতীয় নাটক মঞ্চায়নের অশুভ চক্রান্তে লিপ্ত আছে। এরই ধারাবাহিকতায় এই মুজিববর্ষেই আমরা দেখেছি ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানের ‘নাটুকে’ হাই কমিশনারকে ঢাকার একটি অনুষ্ঠনে বঙ্গবন্ধুর ফটো অ্যালবাম প্রকাশের ঘোষণা দিতে কিংবা ঢাকার আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানী সমর অধিনায়ক লেফটেনেন্ট জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজীর ভ্রাতুষ্পুত্র, বর্তমান পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান নিয়াজীকে মুজিববর্ষে ভুল বানানে বঙ্গবন্ধুর নাম লেখা শুভেচ্ছা বার্তা পাঠাতে।
বিগত বছরের শেষ দিকে নভেম্বরের আট তারিখে পাকিস্তানের সবগুলো রাজনৈতিক দলের যুব সংগঠনগুলোর উদ্যোগে সেদেশে আয়োজন করা হয়েছিল একটি পাক-বাংলা মৈত্রি সম্মেলনের। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়ানো হয়েছিল এই সম্মেলনটির আদ্যপান্ত। শোনা যায় লন্ডনে আত্মগোপনে থাকা এদেশের একজন রাজনৈতিক নেতার অর্থায়ন আর প্রত্যক্ষ সমর্থন ছিল এই সম্মেলনটির পেছনে। এরই ধারাবাহিকতায় নতুন বছরের শুরুতেই জানুয়ারির দুই তারিখে লাহোরে আয়োজন করা হয়েছে আরেকটি পাকিস্তান-বাংলা মৈত্রি সম্মেলনের। এটির আয়োজক জামহুরি ওয়াতান পার্টি নামে পাকিস্তানের একটি রাজনৈতিক দলের যুব সংগঠনটি। সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে থাকছে পাকিস্তানের পাঞ্জাবের প্রাদেশিক গভর্নর। গত মৈত্রি সম্মেলনটির মূল প্রতিপাদ্য ছিল বঙ্গবন্ধু ‘গাদ্দার’ ছিলেন কি ছিলেন না। সেখানে দাবি জানানো হয়েছিল পিটিভির বাংলা সম্প্রচার চালু করার এবং বিটিভির উর্দু সার্ভিস চালু করে তা পাকিস্তানে প্রচারের ব্যবস্থা করার। কত বড় ঔদ্ধত্য! এবারের সম্মেলনের প্রতিপাদ্যও জানা কথা ফেসবুকে ছড়ানো হবে খুবই দ্রুততার সাথে।
পাকিস্তানীদের এই যে এতসব নানামুখী তৎপরতা একাত্তরকে ঘিরে, অথচ একাত্তরের মূল জায়গাটায় তাদের নিরবতাটা দৃষ্টিকটূ রকমের। আজ পর্যন্ত পাকিস্তানের কোনো সরকার একাত্তরের বাংলাদেশ আর বাঙ্গালীর বিরুদ্ধে তাদের সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা তো দূরে থাক, এজন্য দুঃখ প্রকাশের ন্যূনতম শিষ্টাচারটুকুও প্রদর্শন করেনি। সিমলা চুক্তি অনুযায়ী পাকিস্তান তাদের যুদ্ধাপরাধী ১৯৩ জন সেনাসদস্যের বিচারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অথচ সে বিষয়েও কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। যেমন উদ্যোগ নেয়া হয়নি বাংলাদেশে আটকে পড়া বহু লক্ষ পাকিস্তানী নাগরিককে নিজ দেশে ফিরিয়ে নেয়ার কিংবা বাংলাদেশের ন্যায্য পাওনা কয়েক হাজার কোটি টাকা পরিশোধের।
পাকিস্তানীরা বোঝে না যে, বাঙ্গালীর মধ্যে হয়তো কিছু দালাল ঠিকই আছে, কিন্তু তারা সংখ্যায় লঘিষ্ট। সংখ্যাগুরু বাঙ্গালীর নিরংকুশ সমর্থন বাংলাদেশের প্রতি। একাত্তর পূর্ববর্তী চব্বিশ বছরে আর একাত্তরের ন’টি মাসে আমাদের পূর্বসূরীদের উপর পাকিস্তান আর তার এদেশীয় দোসরদের সীমাহীন শোষণ আর নির্যাতন ভোলেনি বাংলাদেশ। কাজেই বাঙ্গালীকে বোকা ভেবে ঘোল খাওয়ানোর চেষ্টা করলে সে ঘোল নিজেকেই গিলতে হবে। পাকিস্তানকে আমরা ওয়ালাইকুম সালাম বলে দিয়েছি আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগেই। এখন তাদের বুকে টেনে নেয়া তো দূরে থাক, সামান্যতম সখ্য স্থাপনের সুযোগও আমাদের আর নেই। কারণ তা হবে ত্রিশ লক্ষ শহীদ আর তিন লক্ষ বিরাঙ্গনার সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতারই সামিল।
লেখক: বিভাগীয় প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
এএইচএস/এসএ/