পেটে কাঁচি নিয়ে বাচেনা খাতুনের ২০ বছর
মেহেরপুর প্রতিনিধি
প্রকাশিত : ০৯:১৪ এএম, ৪ জানুয়ারি ২০২২ মঙ্গলবার
এক্স-রে রিপোর্টের পর কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন বাচেনা খাতুন
ভুল অপারেশনে পেটে কাঁচি নিয়ে বাচেনা খাতুনের কেটে গেছে ২০টি বছর। নানা জায়গায় চিকিৎসা করিয়েও সুস্থ্য হতে পারছিলেন না তিনি। শেষ সহায় সম্বল বিক্রি করে চিকিৎসার জন্য যান রাজশাহী। সেখানে তার পেটে পাওয়া গেল সার্জিক্যাল কাঁচি। চিকিৎসকের ভুলে বাচেনাকে খেসারত দিতে হয়েছে দীর্ঘ কুড়ি বছর।
সোমবার রাজশাহীর রাজা ক্লিনিকে বাচেনার পেটে কাঁচি থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন চিকিৎসকরা। এর আগে রোববার রাজশাহী মেডিকেল কলেজের এক্স-রে রিপোর্টেও বিষয়টি ধরা পড়ে।
বাচেনা খাতুন চুয়াডাঙ্গা জেলার আলম ডাঙ্গা উপজেলার নওদা হাপানিয়া গ্রামের আব্দুল হামিদের স্ত্রী।
বাচেনার পরিবার জানায়, ২০০২ সালে মেহেরপুর গাংনীর রাজা ক্লিনিকে চিকিৎসার জন্য যান বাচেনা। ওষুধপত্র ও অপারেশন ফি বাবদ ২০ হাজার টাকার চুক্তিতে বাচেনার পিত্তথলিতে পাথর অপারেশন করেন সার্জারি বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মিজানুর রহমান। তার সহকারি হিসেবে ছিলেন রাজা ক্লিনিকের পরিচালক ডাক্তার পারভিয়াস হোসেন রাজা ও এ্যানেস্থেসিয়ায় ছিলেন ডাক্তার তাপস কুমার।
অপারেশনের একসপ্তাহ পর বাচেনা খাতুনকে প্রেসক্রিপশন করে ছুটি দেয়া হয়।
তবে অপারেশনের পরেও তিনি সুস্থ হননি। বার বার রাজা ক্লিনিকে গিয়েও সুফল পাননি বাচেনা। বাধ্য হয়ে সুস্থ্যতার জন্য বিভিন্ন এলাকায় চিকিৎসা নেন বাচেনা খাতুন। এভাবে অসুস্থতা নিয়ে ২০টি বছর কাটে তার।
গত রোববার স্থানীয়দের পরামর্শে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের নিউরোমেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ রেজা নাসিমের কাছে চিকিৎসা নিতে গেলে বাচেনা খাতুনকে এক্স-রে করানো হয়। এক্স-রে রিপোর্টে পেটের মধ্যে ৪-৫ ইঞ্চির একটি কাঁচির সন্ধান মেলে।
বাচেনা খাতুনের এক্স-রে প্লেট
কুড়ি বছর পর পেটের মধ্যে কাঁচির সন্ধান পাওয়ায় হতাশ ও কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন বাচেনা খাতুন। এ খবর গ্রামে ছড়িয়ে পড়লে সকাল থেকেই বাচেনা খাতুনের বাড়িতে ভিড় জমায় এলাকার মানুষ।
বাচেনা খাতুন জানান, সহায় সম্বল বিক্রি করে মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার বাজার এলাকায় রাজা ক্লিনিকে পিত্তথলির পাথর অপারেশন করিয়েছিলাম। অপারেশনের পর থেকে আজ পর্যন্ত সুস্থ্য হতে পারনি। পেটের ব্যাথার অসহ্য যন্ত্রণায় বছরের পর বছর বিভিন্ন ডাক্তারের কাছে ছুটেছি। চিকিৎসা করাতে যেয়ে খুইয়েছি অর্থ সম্পদসহ সব কিছু। এখন রাজশাহী গিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কুড়ি বছর পর পেটে মিলল অপারেশন কালে ডাক্তারের রেখে দেয়া কাঁচি।
সোমবার (৩ জানুয়ারি) রাজা ক্লিনিকে পুনরায় এক্স-রে করালে এখানকার চিকিৎসকরাও বাচেনার পেটে কাঁচি দেখতে পান। তারা বাচেনার চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছেন।
বাচেনার স্বামী আব্দুল হামিদ বলেন, ‘গত রোববার আমার স্ত্রীকে রাজশাহীতে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে স্ত্রীর পেটের মধ্যে কাঁচি মিলেছে। আমি নিঃস্ব মানুষ, কি দিয়ে তার অপারেশন করাবো। আমার আর কিছুই নাই। কার কাছে গেলে সহযোগিতা পাবো তাও জানিনা। আমি এর সুষ্ঠু বিচার চাই।’
পরিবারের সঙ্গে বাচেনা খাতুন
স্থানীয় ইউপি সদস্য সুজন আলী বলেন, ‘সহায় সম্বল বিক্রি করেও যখন তার চিকিৎসা হচ্ছিল না তখন বাচেনার চিকিৎসার জন্য গ্রামের অনেক মানুষ আর্থিকভাবে সহযোগিতা করেছেন। গতকাল জানতে পারলাম বাচেনার পেটের মধ্যে একটি কাঁচি রেখেই সেলাই দিয়েছে ডাক্তার। ক্লিনিক মালিকের কাছে এর প্রতিকার চাইবো। এর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
রাজা ক্লিনিকের সত্বাধিকারী ডাক্তার পারভিয়াস হোসেন রাজা বলেন, ‘আমি অপারেশনের বিষয়টি স্বীকার করছি। আমিও ওই অপারেশনের সময় সহকারি হিসেবে ছিলাম। মানুষ মাত্রই ভুল হতে পারে। এটি অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল। কুড়ি বছর বাচেনাকে কষ্ট পেতে হয়েছে। তার সব দায়িত্ব আমি নিব।’
বাচেনার অপারেশনের চিকিৎসক মিজানুর রহমানের সাথে বিভিন্নভাবে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। জানা গেছে, তিনি এখন খুলনায় অবসর জীবন যাপন করছেন।
মেহেরপুর সিভিল সার্জন মোঃ জওয়াহেরুল ইসলাম বলেন, ‘বিষয়টি এখন শুনলাম, আমাকে জানানো হয়নি। যদি রোগীর লোকজন লিখিত অভিযোগ করেন, তবে নিয়ম ও আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
এএইচ/