ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

ওমিক্রন দিয়েই কি শেষ হচ্ছে কোভিড মহামারি?

একুশে টেলিভিশন  

প্রকাশিত : ১২:৫০ পিএম, ১৮ জানুয়ারি ২০২২ মঙ্গলবার | আপডেট: ১২:৫১ পিএম, ১৮ জানুয়ারি ২০২২ মঙ্গলবার

"কোভিড মহামারি কবে শেষ হবে?" অথবা "আমি আবার কবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবো?"- গত দু'বছরে এমন প্রশ্ন করেননি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে এখন আশার কথা হল বিজ্ঞানীরা বলছেন, এসব প্রশ্নের উত্তর হবে - "হয়তো খুব শিগগিরই।"

তাদের অনেকে মনে করেন করোনাভাইরাসের ভ্যারিয়েন্টের ওপর প্রচণ্ড চাপ তৈরি হয়েছে এবং তার ফলে এটি দিনে দিনে দুর্বল হয়ে পড়ছে। এছাড়াও সারা বিশ্বে লোকজনকে টিকা দেওয়ার কারণে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে মানবদেহের রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা। এসব থেকে ধরে নেওয়া যায় যে মহামারির সময় ফুরিয়ে আসতে শুরু করেছে।

তারা বলছেন ইতোমধ্যেই কোভিড মহামারি "শেষ হয়ে যেতে শুরু" করেছে। এটি যে এখন শেষ পর্যায়ে তার লক্ষণ স্পষ্ট।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে: মহামারির পরে কী? জীবন কি আগের অবস্থায় ফিরে যাবে, নাকি তৈরি হবে নতুন কোনো পরিস্থিতি? ভাইরাসটি কি এই পৃথিবী থেকে একেবারেই উধাও হয়ে যাবে?

বিজ্ঞানীরা বলছেন, কোনো সন্দেহ নেই যে কোভিড থাকবে, কিন্তু সেটা 'প্যান্ডেমিক' হিসেবে নয়, থাকবে 'এন্ডেমিক' হিসেবে।

অর্থাৎ আমাদের সামনে কোভিড-পরবর্তী নতুন এক বিশ্ব আসন্ন যেখানে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মহামারির মতো এতো মানুষের মৃত্যু না হলেও, এই অসুখটি আর দশটি সাধারণ রোগের মতোই থেকে যাবে।

যুক্তরাজ্যে লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রফেসর জুলিয়ান হিসকক্স বিবিসির স্বাস্থ্য ও বিজ্ঞান বিষয়ক সংবাদদাতা জেমস গ্যালাহারকে বলেছেন, "বলা যায় যে এরকম পরিস্থিতিতে আমরা প্রায় পৌঁছে গেছি। বলতে পারেন মহামারি শেষ হতে শুরু করেছে। অন্ততপক্ষে যুক্তরাজ্যে। আমার মনে হয় ২০২২ সালে আমাদের জীবন প্যান্ডেমিকের আগের অবস্থায় ফিরে যাবে।"

করোনাভাইরাসের দুর্বল ভ্যারিয়েন্ট  ওমিক্রনই তার অন্যতম লক্ষণ। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, এই ভ্যারিয়েন্ট যত বেশি ছড়াবে ভাইরাসটি ততোই দুর্বল হয়ে পড়বে। এবং এর মধ্য দিয়েই অবসান ঘটবে এই শতাব্দীর সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্য সঙ্কটের।

কিন্তু বাংলাদেশের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এস এম আলমগীর মনে করেন না যে খুব শীঘ্রই বর্তমান মহামারির অবসান হচ্ছে।

তিনি বলেন, "গত একশ বছরে শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন ভাইরাসের প্যানডেমিক পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে সেসব মহামারি এক থেকে তিন বছর পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। সেই বিবেচনায় হয়তো বলা হচ্ছে যে এটাই হয়তো শেষ বছর। কিন্তু এখানে অন্য প্রশ্নও রয়েছে।"

"দুটো সম্ভাবনা আছে। আমরা ওমিক্রনের যত মিউটেশন দেখছি সেটি আবার ততোই সংক্রমিত হচ্ছে। যখনই ভাইরাস ব্যাপক ট্রান্সমিশনে থাকে তখন ভাইরাসের আরো বেশি মিউটেশনের সম্ভাবনা থাকে। তখন হয়তো ভাইরাসটি দুর্বল হয়ে যেতে পারে। আবার শক্তিশালীও হতে পারে। একারণে প্যান্ডেমিক শেষ হয়ে যাচ্ছে কীনা সেটা বলার জন্য আরো কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে," বলেন তিনি।

"যেখানে এখনও প্রতিদিন ২০/২৫ লাখের ওপর রোগী হচ্ছে, পাঁচ থেকে সাত হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে সেখানে কোনো ভ্যারিয়েন্ট দুর্বল হয়ে যাচ্ছে- এই ভবিষ্যদ্বাণী করার মতো সময় এখনও আসেনি।"

মহামারি শেষ হওয়ার কারণ

এর পেছনে মূল কারণ দুটো: একদিকে ভাইরাসের দুর্বল হয়ে পড়া এবং অন্যদিকে ভাইরাসের হোস্ট অর্থাৎ মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার বৃদ্ধি।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, গত দু'বছরে পৃথিবীর ৩২ কোটিরও বেশি মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে এবং এর হাত থেকে রক্ষা পেতে বহু মানুষ টিকা নিয়েছে, যার ফলে তাদের দেহে ভাইরাসটি প্রতিরোধ করার জন্য এন্টিবডি তৈরি হয়েছে।

এটিকে প্রতিরোধের জ্ঞানও তৈরি হয়েছে মানুষের দেহে।

চীনের উহান শহরে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে যখন নতুন এই ভাইরাসটির উৎপত্তি হয় তখন দেহের রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থার কাছে এটি ছিল একেবারেই অচেনা অজানা, ছিল সম্পূর্ণ নতুন একটি ভাইরাস এবং এর সাথে কিভাবে লড়াই করতে হবে সেই জ্ঞানও তাদের ছিল না। একইসঙ্গে এর কোনো ওষুধ ছিল না, ছিল না কোনো টিকাও।

কিন্তু এর মধ্যে মানুষের দেহে কোভিড মোকাবেলার ক্ষমতা তৈরি হয়েছে। আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থা এখন ভাইরাসটি সম্পর্কে আগের চেয়ে অনেক বেশি জানে। এটিকে পরাস্ত করার অভিজ্ঞতাও তাদের হয়েছে।

প্রতি মুহূর্তের এই লড়াইয়ের ফলে ভাইরাসটি রূপান্তরিত হতে হতে এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি দুর্বল হয়ে পড়েছে।

এ বিষয়ে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের কথাই উল্লেখ করা যেতে পারে। এটি আগের যেকোনো ভ্যারিয়েন্টের তুলনায় অনেক বেশি সংক্রামক হলেও, রোগীকে আগের মতো কাবু করতে পারে না এবং এই ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি কিংবা মৃত্যুর হারও অনেক কম।

কিন্তু সারা বিশ্বেই কি প্রতিরোধের এই চিত্রটা একই রকম?

পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় দরিদ্র দেশগুলোতে খুব কম সংখ্যক মানুষই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। এসব দেশে টিকাও দেওয়ার হারও অনেক কম।

ফলে দরিদ্র দেশগুলোতেও মহামারি এখন শেষ পর্যায়ে একথা কি বলা যাবে?

মনে রাখতে হবে এসব দেশে মৃত্যুর সংখ্যা কম হলেও মানুষের দেহে ভাইরাসটি প্রতিরোধের ক্ষমতা কিন্তু এখনও সেভাবে তৈরি হয়নি।

আইইডিসিআরের বিজ্ঞানী মি. আলমগীর বলেন, সারা বিশ্বে এখনও কিন্তু সমানভাবে টিকা দেওয়া যায়নি।

"স্বাভাবিক সংক্রমণ থেকে যে এন্টিবডি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয় সেটা কিন্তু বেশিদিন স্থায়ী হয় না। তবে যদি আমরা টিকার পরিমাণ বাড়াতে পারি, বিশ্বের অন্তত ৭০ ভাগ মানুষকে টিকার আওতায় নিয়ে আসতে পারি, তখন পরিস্থিতি অন্যরকম হবে।"

তিনি বলেন, "টিকা সরবরাহের ক্ষেত্রে এখনও যে বৈষম্য তাতে সবাইকে টিকার আওতায় আনতে কতদিন লাগবে সেটা কেউ জানি না। আমেরিকা এবং ইউরোপে প্রচুর টিকা দেওয়া হয়েছে। এশিয়াতে এই সংখ্যা কম, আফ্রিকাতে আরো কম। টিকার সমবন্টন যদি হয়, একসাথে যদি সবাইকে টিকা দেওয়া যায় তাহলে হয়তো ভাইরাসটি প্রতিরোধ করা যাবে। পৃথিবীর এক দেশে বা দুই দেশে কিংবা এক অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ করলেই তো আর মহামারি শেষ হয়ে যায় না। এজন্য সারা পৃথিবীতেই এক সাথে সংক্রমণ ও মৃত্যু দুটোই কমতে হবে।"

মহামারির পরে কী

বিজ্ঞানীরা বলছেন, পৃথিবীর সামনে দুটো সম্ভাবনা: হয় কোভিড পুরোপুরি নির্মূল হয়ে যাবে যেমনটা পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোতে ইবোলো ভাইরাসের বেলায় হয়েছে। অথবা এটি ক্রমশ দুর্বল হয়ে আমাদের মধ্যে দীর্ঘসময় ধরে সাধারণ সর্দি কাশি, এইচআইভি, হাম, ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মার মতো রয়ে যাবে।

বিজ্ঞানীরা মনে করেন কোভিডের বেলাতেও ঠিক সেরকমটাই ঘটতে যাচ্ছে।

ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের ভাইরোলজিস্ট ড. এলিজাবেটা গ্রোপেলি বিবিসিকে বলেছেন, "আমি খুব আশাবাদী যে আমরা খুব শীঘ্রই এমন এক পরিস্থিতিতে পৌঁছাবো যেখানে ভাইরাসটি ছড়াতে থাকবে এবং ঝুঁকিপূর্ণ লোকজনকে রক্ষায় আমাদের কিছু ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু সাধারণ লোকজনের খুব একটা অসুবিধা হবে না।"

মহামারি বিশেষজ্ঞরা একটি রোগকে তখনই 'এন্ডেমিক রোগ' হিসেবে বিবেচনা করেন যখন সেই রোগের মাত্রা স্থিতিশীল থাকে এবং বোঝা যায় এর পর কী পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। কিন্তু যখন কোনো একটি রোগ হঠাৎ আবির্ভূত হয়ে অতিদ্রুত বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে সেটিকে তারা বিবেচনা করেন 'প্যান্ডেমিক রোগ' হিসেবে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা অনলাইন

এসবি/