সিলেটে প্রথম ট্রান্সআর্টারিয়াল কোমোএম্বোলাইজেশন সম্পন্ন
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৫:৫৮ পিএম, ২৫ জানুয়ারি ২০২২ মঙ্গলবার
এ দেশে ক্যান্সার জনিত মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ লিভারের ক্যান্সার। বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি বছর যে পরিমান মানুষ নানা ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করেন তাদের মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয় লিভার ক্যান্সারের কারণে। এদেশে লিভার ক্যান্সারের কারণ নানাবিধ। সবার আগে চলে আসবে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের নাম। পাশাপাশি হেপাটাইটিস সি ভাইরাস আর ফ্যাটি লিভারও আমাদের দেশে লিভার ক্যান্সারের অন্যতম প্রধান কারন।
লিভার ক্যান্সারের চিকিৎসা আর দশটি ক্যান্সারের চিকিৎসার চেয়ে একেবারেই আলাদা। প্রচলিত অর্থের কেমোথেরাপী আর রেডিওথেরাপী এই ক্যান্সারে অচল। এখানে আমরা ব্যবহার করি মুখে খাওয়ার কেমোথেরাপী আর হালের সর্বশেষ সংযোজন ইমিউনোথেরাপী। আশার কথা এই সবগুলো ওষুধ তৈরী হয় বাংলাদেশেই আর এগুলো কাজও করে প্রচলিত কেমো আর রেডিওথেরাপির চেয়ে অনেক বেশি। সমস্যা হচ্ছে ওষুধগুলো দেরীতে প্রয়োগ করলে ততটা ভালো ফল পাওয়া যায় না, আর আমাদের দেশে বেশিরভাগ লিভার ক্যান্সার রোগীই অনেক দেরিতে আমাদের কাছে আসেন। ফলে তারা এসব ওষুধগুলোর পূর্ণ সুফলও পান না।
এই সব রোগীদের জন্য সুখবরটা হলো ‘টেইস’, যার পুরো নাম ট্রান্সআর্টারিয়াল কেমোএ্যাম্বোলাইজেশন। হার্টের বিশেষজ্ঞরা যেভাবে ক্যাথল্যাবে হার্টের বøক হওয়া ধমনীতে স্টেন্ট পরিয়ে রক্ত চলাচল পুনরায় চালু করে দেন, আমরা লিভার বিশেষজ্ঞরাও একইভাবে ক্যাথল্যাবে লিভারের ধমনীর মাধ্যমে লিভার ক্যান্সারের টিউমারগুলোতে সরাসরি কেমোথেরাপী প্রয়োগ করি আর তারপর সেই রক্তনালীগুলোকে বøক করে দেই। এতে কেমোথেরাপীটা শুধু লিভার ক্যান্সারের টিউমারের মধ্যেই থেকে যায়, ছড়াতে পারে না শরীরের অন্য কোথাও। ফলে রোগীর চুল পড়া, খাওয়ায় অরুচি ইত্যাদি কেমোথেরাপীজনিত কোন সাইড এফেক্টই হয় না। অন্যদিকে রক্তনালীগুলো ব্লক করে দেয়ায় লিভার ক্যান্সারের টিউমারগুলোয় রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফলে টিউমারগুলো ক্রমেই আরো নির্জীব হয়ে পড়ে। টেইস করার কারণে এভাবে টিউমারগুলো ছোট হয়ে আসলে, পরে লিভার ক্যান্সারের রোগীদের মুখে খাওয়ার কেমোথেরাপী কিংবা ইমিউনোথেরাপীর মাধ্যমে চিকিৎসা করা সম্ভব হয়। এমনকি অনেক সময় অপারেশন করে লিভার ক্যান্সারের টিউমার অপসারনও করা যায়।
গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে নিয়মিত টেইস হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভার বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমানে ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশনের প্রতিষ্ঠাতা ডিভিশন প্রধান অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)-এর নেতৃত্বে একটি টিম এ পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রায় আড়াই শতাধিক লিভার ক্যান্সারের রোগীকে টেইসের মাধ্যমে চিকিৎসা করেছে এবং এই অভিজ্ঞতা আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশিতও হয়েছে। টেইসে বাংলাদেশের সাফল্য আশপাশের দেশগুলোর সমতুল্য আর খরচও প্রতিবেশিদের তুলনায় অনেক বেশি সাশ্রয়ী।
আজ মঙ্গলবার (২৫ জানুয়ারি) প্রথমবারের মত বাংলাদেশে ঢাকার বাইরে টেইস সম্পাদন করা হলো। ঢাকা থেকে অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)-এর নেতৃত্বে লিভার বিষেশজ্ঞদের একটি টিম আজ সিলেটের একটি বেসরকারী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রথমবারের মত একজন লিভার ক্যান্সার রোগীর উপর টেইস করেন। প্রসিডিউরটি আজ সকালে সফলভাবে সম্পাদন করা হয়। প্রসিডিউর শেষে রোগী সুস্থ আছেন এবং আগামীকাল ছুটি নিয়ে বাসায় যাবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
টিমের অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হেপাটোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শেখ মোহাম্মদ নূর-ই-আলম ডিউ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল হেপাটোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফয়েজ আহমেদ খন্দকার, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল হেপাটোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. রোকসানা বেগম, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল হেপাটোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আহমেদ লুৎফুল মুবিন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হেপাটোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক দুলাল চন্দ্র দাস ও শেখ হাসিনা বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারী ইন্সটিটিউট এন্যাসথেসিওলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. ইকরামুল হক।
অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল) বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং বেসরকারীখাতে লিভার ক্যান্সারের চিকিৎসায় টেইস এবং লিভার সিরোসিসের চিকিৎসায় অটোলোগাস হেমোপয়েটিক স্টেম সেল ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন (স্টেম সেল থেরাপী)-এর মত আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো প্রবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। আজ সিলেটে টেইসের সূচনা হলো। এর মধ্যে দিয়ে ঢাকার বাইরে এই অত্যাধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিটির যাত্রা শুরু হলো। সামনে সিলেটে লিভার সিরোসিসের চিকিৎসায় স্টেম সেল থেরাপীও শুরু হবে।
লিভার ক্যান্সার মানেই শুধুই হতাশা আর নিশ্চিত মৃত্যু এমন কথা এখন আর সত্যি নয়। এই কথাটি এতদিন শুধু মাত্র ঢাকাবাসীর জন্য প্রযোজ্য হলেও এখন থেকে সিলেটবাসীও এই অত্যাধুনিক চিকিৎসা সুবিধা সিলেটে বসেই গ্রহন করার সুযোগ পাবেন।
আরকে//