ঘৃণা
দেলোয়ার আরজুদা শরফ
প্রকাশিত : ০৫:৫১ পিএম, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ বুধবার | আপডেট: ০৬:৫২ পিএম, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ বুধবার
ঘৃণা একটি নেতিবাচক শব্দ। শব্দটি ক্ষুদ্র হলেও সমুদ্র সমান শক্তি। এক বিন্দু ঘৃণার-জল এক সিন্ধু জলকে নষ্ট করে দিতে পারে খুব সহজেই। বিষধর সাপের বিষের চেয়েও ঘৃণার-বিষ বেশি বিষাক্ত।
ঘৃণা মানব মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্রের খুব ক্ষুদ্র একটি জায়গায় অবস্থান করে, ঘৃণা বিচরণ করে মানবের সরল চিন্তায় চেতনায় ভাবনায় ও মননে। ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটে দুর্ব্যবহার ঈর্ষা হিংসা রাগ ক্রোধ অহম ও ধ্বংসলীলায়।
একটি নবজাতক নিষ্পাপ ঘৃণাহীন হয়েই পৃথিবীতে আসে কিন্তু স্বার্থেন্বেষী ব্যক্তি পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্র তাকে ঘৃণা শেখায়, তাকে পরিণত করে ঘৃণার-মানুষ হিসেবে! একে অন্যের প্রতি ঘৃণা, বংশের প্রতি ঘৃণা, কর্মের প্রতি ঘৃণা, ধর্মের প্রতি ঘৃণা, এক ধর্মের মানুষ আরেক ধর্মের মানুষকে প্রচন্ড ঘৃণা করে, অন্যের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি প্রচন্ড ঘৃণা, নাস্তিকের প্রতি আস্তিকের ঘৃণা আবার আস্তিকের প্রতি নাস্তিকের ঘৃণা, এক সম্প্রদায় আরেক সম্প্রদায়কে ঘৃণা করে, এক জাতি আরেক জাতিকে ঘৃণা করে, এক হুজুর আরেক হুজুরকে একদম সহ্য করতে পারে না প্রচন্ড ঘৃণা করে, এক পুরোহিত আরেক পুরোহিতকে ঘৃণা করে,এক মানুষ আরেক মানুষকে ঘৃণা করে, এক মেয়ে আরেক মেয়েকে ঘৃণা করে, এক ছেলে আরেক ছেলেকে ঘৃণা করে, এক প্রতিবেশী আরেক প্রতিবেশীকে ঘৃণা করে, এক ভাই আরেক ভাইকে ঘৃণা করে, এক বোন আরেক বোনকে ঘৃণা করে। একই পেশার মানুষ একজন আরেকজনকে ঘৃণা মিশ্রিত ঈর্ষা করে। কেউ এমনি এমনি ঘৃণা করে।
জীবজন্তুর প্রতি ঘৃণা, গরু ছাগল শূকর নামের প্রতি ঘৃণা কিন্তু গরু ছাগল শূকরের মাংস খেতে কোনো ঘৃণা নেই । কুকুর বিড়াল বা কুত্তা- বিলাই নামের প্রতি ঘৃণা কিন্তু কুকুর বিড়াল পালনে কোনো ঘৃণা নেই। অনেক চাষার প্রতি ঘৃণা, অনেক ভাষার প্রতি ঘৃণা। অনেক নামের প্রতি ঘৃণা।
যে সুন্দর মেধাবী ভালো তাকে ঘৃণা করে আবার যে কদর্য বেটে কালো তাকেও ঘৃণা করে। ধনীর প্রতি দরিদ্রের ঘৃণা আবার দরিদ্রের প্রতি ধনীর ঘৃণা, অফিসে বা বাসায় অফিস সহকারী বা গৃহকর্মীর প্রতি রাগ মিশ্রিত ঘৃণা। গৃহকর্তা বা গৃহকর্ত্রী একবারও ভাবেন না তিনি পৃথিবীতে নাই আর তাঁর অবর্তমানে তাঁর নিজ সন্তান দু'মুঠো অন্নের জন্যে অন্যের বাসায় দিন-রাত পরিশ্রম করছে, সামান্য ভুলের জন্যে গৃহকর্তা বা গৃহকর্ত্রীর হাতে পাশবিকভাবে নির্যাতিত হচ্ছে বা পিটুনি খাচ্ছে, তখন তাঁর কেমন লাগতো, তিনি একবারও ভাবেন না! নির্মম সত্য হচ্ছে , যে বাসায় গৃহকর্মী নির্যাতিত হয় সে বাসায় প্রাচুর্য থাকতে পারে কিন্তু সুখ থাকে না।
কবি লেখক সাংবাদিক, দার্শনিক সুফি-সাধক, মুনি-ঋষি, পীর-মুরিদ, উকিল-মুক্তার, ড্রাইভার-হেলপার,গার্মেন্টসকর্মী ও মালিক, দারোয়ান-দোকানদার, মুচি, নাপিত, জেলে, কামার-কুমার, ধোপা, জনগণ, মেম্বার, চেয়ারম্যান, সাংসদ, মন্ত্রী যন্ত্রী নেতা-নেত্রী সবাই ঘৃণায় ঘৃণাময়।
ঘৃণা করা মানুষের স্বভাব, অনেক অভাব পূরণ হলেও মানুষের ঘৃণার অভাব পূরণ হয়না, ঘৃণার রাজ্যে সবাই যেন অতি দরিদ্র ঘৃণাধর প্রজা, ঘৃণার কাছে সবাই যেন দাস৷ ঘৃণার কারাগারে সবাই বন্দি। ঘৃণা মানুষকে মুক্তি দিতে চায় কিন্তু ঘৃণাকে মানুষ মুক্তি দেয়না । এই ঘৃণাকে কেউ কেউ পরম যত্নে বুকে আগলে রাখে। সময় সুযোগ বুঝে ঘৃণার বিষ ছড়িয়ে দেয় এক থেকে দশক শতক সহস্র লক্ষ কোটিতে। ঘৃণা করা কারো পেশা আবার কারো নেশা । ঘৃণায় ঘৃণা বাড়ে, ঘৃণা নিজেও নিজেকে ঘৃণা করে, আর এই ঘৃণাকে মানুষ কবর পর্যন্ত নিয়ে যায় আবার চিতায় পোড়ে পরম আনন্দে!!
ঘৃণা মনকে দূষিত করে দেহকে করে রোগগ্রস্ত। ঘৃণা অন্যের ক্ষতির চেয়ে নিজেরই বেশি ক্ষতি করে। ঘৃণায় মন আক্রান্ত হলে অসুখ বাসা বাঁধে মনে, দুঃখ হতাশা অশান্তি ব্যর্থতা নেমে আসে জীবনে।
ঘৃণার প্রতিষেধক ; অন্তরের ভালোবাসা ও মমতা।
দেলোয়ার আরজুদা শরফ
লেখক : গীতিকবি