ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

আমরা কে প্রতারক নই? 

পলাশ আহসান 

প্রকাশিত : ১২:৪৭ পিএম, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ সোমবার | আপডেট: ১২:৫১ পিএম, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ সোমবার

যেকোনো আত্মহত্যাকে তিন বার 'না' বলে শুরু করছি লেখাটি। কোনো অস্বাভাবিক মৃত্যু আমরা চাই না। কারণ আমরা যে সমাজে বসবাস করি সেটাকে সভ্য সমাজ ভাবতে চাই। আজকে মানুষের সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাসের যে পদ্ধতি, সেটাও এসেছে মানুষের নিরাপত্তার স্বার্থেই৷ আজ রাষ্ট্রের যত তন্ত্রমন্ত্র তাও মানুষের জন্যে। মানুষই যদি নিরাপদ না থাকে, শুধু ভূখণ্ড দিয়ে কী লাভ? এক মানুষ আরেক মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাইবে অথবা আত্মহত্যা চাইবে না এটা খুবই স্বাভাবিক। 

নিজের মাথায় গুলি করার ছবি ছাড়া মহসিন সাহেবের লাইভের দৃশ্যটি আমি দেখেছি। গুলি করার চিত্রটি দেখতে আমার সাহসে কুলোয়নি।কিন্তু তার কথা শুনেছি। সেই কথার কোথাও ন্যূনতম ভুল আছে, মনে হয়নি। বরং তাকেও অনেক সভ্যতাবাদি মানুষ মনে হয়েছে। তিনি আশা করছিলেন, কেউ তার সঙ্গে প্রতারণা করবেন না। তিনি নিজে যেমন কাউকে ঠকান না। কেউ তাকে ঠকাক, সেটা তিনি চাননি। তিনি সমাজবদ্ধ হয়ে আনন্দে বসবাস করতে চেয়েছিলেন । 

আমরা কেউ কি মহসিন সাহেবের নিষ্পাপ চাওয়ার বিপক্ষে? কোনো সাধারণ মানুষ কি খুঁজে পাওয়া যাবে, যিনি নিজেকে এই সরল চাওয়াগুলোর বাইরে রাখতে চান? নিশ্চয়ই নয়। তার চিন্তা তো আর দশজন স্বাভাবিক মানুষের মতই। তাহলে তিনি কেন আত্মহত্যায় গেলেন? তার চেয়ে বড় কথা, আত্মহত্যার মত চরমপন্থী চিন্তাই বা কেন? 

যেকোনো আলোচনায় এই ‘কেন’র উত্তরটাই খুঁজে বের করা সবচেয়ে জরুরি। মহসিন সাহেবের ১৫ মিনিটের লাইভ বক্তৃতায় বার বার প্রতারণার কথা বলেছেন। পাঁচ কোটির বেশি টাকা তিনি মানুষের কাছে পান। তাদের দু’জনের নামও বলেছেন। পারিবারিক বঞ্চনার কথাও বলেছেন। নিজে না খেয়ে খাইয়েছেন এমন লোকও প্রতারণা করেছেন তার সঙ্গে। তিনি কোথাও বিচার চেয়েছেন কী না উল্লেখ করেননি। তবে বিচার যে পাননি, সেটা নিশ্চিত বোঝা যায়। 

পাঠক, আমাদের চারদিকে তাকান, তার এই প্রতারণার গল্প আমাদের প্রত্যেকের জীবনের নিত্য দিনের। চিন্তা করুন, আপনি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে ঠকেন।বাচ্চার স্কুলে ঠকে। বাসা ভাড়া নিয়ে ঠকেন ভাড়াটিয়া। আবার নিজের বাড়ি ভাড়া দিয়ে ঠকেন বাড়িওয়ালা। নিত্যপণ্যের বাজারের কথা কী বলতে হবে? সকালে বাসা থেকে বের হয়ে ঠকতে ঠকতে কাজে যান; ফেরার আগ মুহূর্তে সিএনজিওয়ালার কাছে শেষবারের মত ঠকে বাসায় ঢোকেন।  

সারাদিন যেখানে কাজ করলেন সেখানে কত রকমভাবে ঠকলেন সে চিন্তা করার সময়ও হয়তো পায় না মানুষ। এরপর আসে পরিবারে ঠকার গল্প। একটা বয়সের পর সবাই চূড়ান্ত আত্মকেন্দ্রিক। প্রত্যেকেই চান নিজে ভাল থাকতে। তা সে যেভাবেই হোক। এই যেভাবেই হোক অংশে তৈরি হয় বঞ্চনার গল্প। আমার জন্যে কেউ কষ্ট পাচ্ছে কী না, আমাকে ভালো রাখতে কার অবস্থা কতটুকু খারাপ হতে পারে, সে চিন্তার সময় বেশিরভাগের নেই। ভালো থাকায় একটু হেরফের হলেই ঘুরে দাঁড়াই।

মহসিন সাহেবের আত্মহত্যার পর মহামান্য আদালত নির্দেশ দেয়, লাইভের ওই ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে সরিয়ে নেওয়ার। গণমাধ্যমগুলোকেও ওই ছবি প্রচার করতে নিষেধ করে। এই ভয়ঙ্কর ছবি দেখতে হবে না ভেবে আমি খানিকটা স্বস্তি পাই। কিন্ত খুব ভাবছি, এরকম একটা ছবি তৈরি না হলে কী হতো? এই ছবি তো আমাদের খুব পরিচিত। আমি দেখতে না চাইলে কী হবে ছবি তো তৈরি হচ্ছেই। 

অন্তর্জালের বিভিন্ন সূত্র বলছে সারা বিশ্বে প্রতি বছর আট থেকে ১০ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করেন। বাংলাদেশের বেসরকারি সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের গবেষণা বলছে, আমার দেশে শুধু ২০২১ সালে আত্মহত্যা করেছে ১৪ হাজারের বেশি মানুষ। ২০২০ সালে এই সংখ্যা ছিল ১০ হাজার। ক্রমশ আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। সবচেয়ে সাবধান হওয়ার খবর হচ্ছে, যারা আত্মহত্যা করছেন তাদের মধ্যে শিক্ষিত সচেতন মানুষের সংখ্যাই বেশি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আত্মহত্যা বন্ধ করতে চায়। সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে দেখলাম, গণমাধ্যমের ওপর তাদের সবচেয়ে বেশি চোটপাট। ভাবটা অনেকটা এরকম যে গণমাধ্যম খুব চায় মানুষ আত্মহত্যা করুক। আত্মহত্যার খবর ছাড়া যেন কোনো খবর নেই। আত্মহত্যার পরিসংখ্যান তো দিলাম। পাঠক ভেবে দেখুন প্রতিদিন গড়ে যেখানে ৩৮ জনের বেশি মানুষ আত্মহত্যা করছে তার ক'টা খবর ছাপা হচ্ছে? তার অর্থ কী এই যে গণমাধ্যমের কাছে তথ্য নেই? একজন গণমাধ্যমকর্মী হিসাবে দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, প্রতিদিন আমাদের হাতে বহু আত্মহত্যার গল্প আসে। যার কোনোটিই মোহসিন সাহেবের আত্মহত্যার চেয়ে কম সংবাদবহ নয়। অথচ এর ১০ ভাগের একভাগও প্রচার হয় না। 

বেশিরভাগ আত্মহত্যার কারণ প্রায় একই রকম। ঘুরে ফিরে সেই অর্থনৈতিক বৈষম্য, বঞ্চনা, প্রতারণা এবং অভিমান প্রকাশের গল্প উঠে আসে।

অথচ আত্মহত্যা বন্ধে সামাজিক আন্দোলন সৃষ্টির উদ্যোগ বা প্রণোদনা কোথাও দেখি না। সমাজের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করা তো অনেক দূরের ব্যাপার। তাই সে কথায় যাওয়ার দুঃসাহস দেখাচ্ছি না। কিন্তু প্রতারণার বিচার চেয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিচার না পাওয়ার কথাটা তো বলতেই পারি। কেন মানুষ আত্মহত্যা করে, সেটা সমাজ গবেষকদের বরাত দিয়ে সাংবাদিকদের খবর বানাতে দেখি মাঝে মধ্যে। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে সেই সামাজিক ক্ষত সারিয়ে তোলার উদ্যোগ দেখি না।

আত্মহত্যার খবর ছাপা নিয়ে নানা নির্দেশ দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। আমার বিবেচনায় এসব নির্দেশের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, খবরটি এমনভাবে লিখতে হবে যেন, আত্মহত্যার বিষয়টি কারো জন্যে উৎসাহ মনে না হয়। তার চেয়ে ভয়ঙ্কর তথ্য হচ্ছে, যেকোনো অপচর্চা আমাদের সমাজে খুব দ্রুত ছড়ায়। যদিও এসব বিষয় সামনে আসার অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশের সাংবাদিকরা আত্মহত্যার খবর খুব বিবেচনায় নিয়ে লেখেন। মহসিন সাহেবের ক্ষেত্রেও প্রায় সব গণমাধ্যম বলার চেষ্টা করছেন, আত্মহত্যার কাজটি তিনি ঠিক করেননি।

আমিও দিন শেষে বলছি, আত্মহত্যা ঠিক নয়। যিনি আত্মহত্যা করেন তিনি তার ব্যক্তিত্ব খর্ব করেন। তিনি শুধু নিজের অপমান করেন না; প্রশ্নবিদ্ধ করেন আশপাশের অনেক নিরাপরাধ মানুষকেও। প্রতিবাদের আরো অনেক ভাষা আছে। তারপরেও যে কথাটি না বললেই নয়, সেটা হচ্ছে, মূলত অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে আমাদের চারপাশ দিন দিন যুদ্ধাংদেহী হয়ে উঠছে। সারাক্ষণ অন্যকে হারানোর অনিবার্য যুদ্ধ করছি আমরা সবাই। যুদ্ধে কেউ ক্লান্ত হলে তাকে কী খুব অস্বাভাবিক বলা যাবে? জানি না। সমাজ গবেষকরা নিশ্চয়ই এই উত্তর খুঁজে বের করবেন। আমি শুধু বলতে চাই, আমাদের সার্বিক অনুশীলন হওয়ার দরকার মানুষ কেন্দ্রিক।
লেখক: যুগ্ম প্রধান বার্তা সম্পাদক, একাত্তর টেলিভিশন 
palash_ahasan2003@yahoo.com
এএইচএস/এসএ/