গদখালিতে এবার ২৫ কোটি টাকার ফুল বিক্রির আশা
জামাল হোসেন, বেনাপোল থেকে
প্রকাশিত : ০৫:৪১ পিএম, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২ রবিবার
ঋতু অনুযায়ী শীতের বিদায় ঘন্টা বাজবে একদিন পরেই। দরজায় কড়া নেড়ে হাতছানি দিচ্ছে ঋতুরাজ বসন্ত। ইংরেজী এমাসেই পড়বে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দিবস। পহেলা ফাল্গুন বা বসন্তবরণ, বিশ্ব ভালবাসা দিবস আর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
এই তিনটি দিবসেই ফুল অতি প্রয়োজনীয়। পহেলা ফাল্গুন বসন্তকে বরণ করে নিতে রঙিন ফুলের জুড়ি নেই। বিশ্ব ভালবাসা দিবসে প্রিয়জনকে দেয়া গোলাপের সুঘ্রাণে ভালবাসা বেড়ে যায় বহুগুন। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ভাষা শহিদদের স্মরণে দেয়া হয় পুস্পার্ঘ। একারণে ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে ফুলের রাজধানী খ্যাত যশোরের গদখালী জুড়ে উৎসবের আমেজ বয়ে চলে। ফলে তিন দিবস ঘিরে গদখালী ফুলের বাজার জমজমাট হয়ে উঠেছে। এতে করে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান ও করোনার ক্ষতি পুষিয়ে লাভের স্বপ্ন দেখছে ফুলচাষিরা।
তাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে ফুলের রাজধানী খ্যাত যশোরের গদখালীর বাজার। সব ধরনের ফুলের দাম বেড়েছে। মানভেদে প্রতিটি গোলাপ বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ টাকা, যা মাসখানেক আগেও ছিল মাত্র ১ থেকে ৩ টাকা। জারবেরা বিক্রি হচ্ছে প্রকারভেদে ৮ থেকে ১২ টাকায়। গাঁদা ফুল প্রতি হাজার পাঁচ থেকে ৭শ’ টাকা পর্যন্ত। যা আগে ছিলো দুইশ’ থেকে তিনশ’ টাকা। পহেলা ফাল্গুনসহ তিন দিবসে ফুলের বাজার চাঙায় প্রায় দুই বছর পর মুখে হাসি ফুটেছে গদখালীর চাষিদের।
তারা বলছে, এই তিন দিবস যত কাছে আসবে ফুলের দামও তত বাড়বে। আশা করছেন গত দুই বছর ধরে করোনায় লাগাতার যে ক্ষতির শিকার হয়েছেন তারা, এ বছর ফুল বিক্রি করে কিছুটা পুষিয়ে নিতে পারবেন।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির তথ্যমতে, যশোরে ফুলচাষি রয়েছে প্রায় ৬ হাজার। তারা অন্তত ১৫শ’ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন প্রকার ফুল চাষ করেন। ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী, পানিসারা, নাভারণ, নির্বাসখোলার বিভিন্ন মাঠে অন্তত ১১ ধরনের ফুল উৎপাদন করেন। বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধা, গোলাপ, জারবেরা, গাঁদা, জিপসি, রডস্টিক, কলনডালা, চন্দ্র মল্লিকাসহ বিভিন্ন ধরনের ফুল শোভা পাচ্ছে।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে শীত প্রধান দেশের ফুল টিউলিপ চাষের মাধ্যমে গদখালীতে যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা। বসস্ত উৎসব ও ভালোবাসা দিবসকে ঘিরে প্রতিবছরই গদখালীর ফুলচাষিরা নতুন জাতের ফুল উপহার দিয়ে থাকেন। গোলাপ, জারবেরা, গাঁদা, গ্লাডিওলাস, লং স্টিক রোজের পর এবারের ভালোবাসা দিবসে ফুলপ্রেমীদের জন্য নতুন উপহার দিচ্ছে টিউলিপ। এই অঞ্চলের ফুলচাষিরাই দেশের ৭০ভাগ ফুলের চাহিদা মেটায়।
এলাকায় উৎপাদিত ফুল বিক্রির জন্য গদখালীতে রয়েছে দেশের বৃহত্তম ফুলের বাজার। চলতি সপ্তাহে কাকডাকা ভোর থেকে ক্রেতা-বিক্রেতাদের উপস্থিতিতে সরব হয়ে ওঠে ফুলের বাজার। গোলাপ, রজনীগন্ধা, গাঁদা, গ্লাডিওলাস, জারবেরা ফুলের পসরা সাজিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে শত শত ফুলচাষী। কেউ ভ্যান, কেউ সাইকেল বা ঝুড়ির মধ্যে ফুল রেখে ঢাকা ও স্থায়ীয় ব্যবসায়ীদের সাথে ফুলের দাম নিয়ে হাঁক-ডাকে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। গত দুদিন ধরে ফুলের চাহিদা বাড়তি থাকায় পাইকারি ব্যবসায়ীরা অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশি ফুল কিনছে। একই সাথে বেশি দাম পাওযায় ফুল চাষীরাও বাজারে দ্বিগুণ ফুল এনেছে। সবমিলিয়ে উৎসবের এই মাসে ফুল-বেচাকেনায় জমে উঠায় ফুলচাষি কিংবা ব্যবসায়ীদের মনে এখন উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে।
পটুয়াপাড়া গ্রামের ফুলচাষি রিজাউল ইসলাম চার বিঘা জমিতে গোলাপের চাষ করেছেন। তিনি বলেন, ফুল যাতে দেরিতে ফোটে সেজন্য গোলাপের কুঁড়িতে ক্যাপ পরিয়ে রাখা হয়। এজন্য বাড়তি তিন থেকে চার টাকা খরচ হয়। ভালবাসা দিবসকে টার্গেট করে সেই ফুল বিক্রি করতে পারলে বেশি দামে বিক্রি করা যায়।
হাড়িয়া নিমতলা এলাকার তরুণ ফুলচাষি রাসেল হোসেন জানান, তাদের দেড় বিঘা জমিতে গোলাপের চাষ রয়েছে। আগে থেকেই কুঁড়িতে ক্যাপ লাগিয়ে রাখার কারণে ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই ফুল বিক্রি করা হচ্ছে। বর্তমানে গোলাপের দামও অনেক ভাল। তাদের অন্তত এইবার এক লাখ টাকা লাভ হবে।
গদখালীর ফুলচাষি জাহিদুল ইসলাম জানান, তিনি প্রায় ৩ বিঘা জমিতে বিভিন্ন প্রজাতির ফুল চাষ করেন। এবার অন্য বছরের তুলনায় বেচাকেনা অনেক ভাল। ফুলের দামও ভাল পাওয়া যাচ্ছে। স্কুল-কলেজ খোলা থাকলে বেচাকেনা আরও বেশি হতো।
পানিসারা গ্রামের ফুল ব্যবসায়ী মনিরুজ্জামান জানান, ফুলের দাম বেশি। পাইকারী বাজারে চাহিদাও অনেক বেশি।
গদখালীতে প্রথমবারের মতো টিউলিপ চাষ করেছেন পানিসারার ইসমাইল হোসেন। তার পাঁচশতক জমিতে ফুঠেছে বিভিন্ন রঙের সাত প্রকারের টিউলিপ ফুল। তিনি জানান, জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে তার জমিতে টিউলিপ ফোটা শুরু করেছে। ভালোবাসা দিবসে এসব টিউলিপ বিক্রি করা হবে। করোনা আর ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের রেশ কাটিয়ে চাষিরা আশার আলো দেখছিলেন। তবে অসময়ের বৃষ্টিতে অনেক ফুল নষ্ট হয়ে গেছে। বর্তমানে ফুলের যে দাম আগামি তিন দিবস পর্যন্ত থাকলে সব ক্ষতি কাটিয়ে উঠবে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সাবেক সভাপতি আব্দুর রহিম জানান, বিভিন্ন কারণে এবার ফেব্রুয়ারিতে ফুল বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে তিন দিবসে অন্তত বিশ থেকে পঁচিশ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হতে পারে।
তিনি আরো জানান, অসময়ের বৃষ্টিতে অনেক ফুল নষ্ট হয়ে গেছে, গোলাপের পাপড়ি ঝরে পড়ছে। এজন্য চাহিদা অনুযায়ী ফুল সরবরাহে ত্রুটি হতে পারে। বাজারে এখন দামও অনেক ভাল। পহেলা ফাল্গুন, ভালবাসা দিবস ও ২১ ফেব্রুয়ারি যত নিকটে আসবে ফুলের দামও তত বাড়বে।
ঝিকরগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাসুদ হাসান পলাশ জানান, গদখালীকে বলা হয় ফুলের রাজধানী। এই অঞ্চলের ফুল ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার মানুষের মনের খোরাক মেটাচ্ছে। এই অঞ্চলের ফুলচাষিরাই দেশের ৭০ভাগ ফুলের চাহিদা মেটায়। সরকারিভাবে ফুলচাষিদের বিভিন্ন ভাবে সহায়তা করা হচ্ছে। নতুন নতুন জাতের ফুল চাষের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে টিউলিপ চাষে সফলতা এসেছে।
এসি