ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কালজয়ী কিছু গান...    

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৫:৪৮ পিএম, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ বুধবার | আপডেট: ০৫:৪৯ পিএম, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ বুধবার

আধুনিক বাংলা গানের জগতে কিংবদন্তি হয়ে উঠেছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। তবে শাস্ত্রীয় সংগীত, রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল গীতি, হিন্দি গানসহ উপমহাদেশের সংগীতের প্রায় সবকটি জায়গায় স্বাক্ষর রেখেছেন ‘গীতশ্রী’ উপাধি পাওয়া এই সংগীতশিল্পী।

৯০ বছর বয়সে মঙ্গলবার কলকাতার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।

বাংলা সংগীত জগতের স্বর্ণযুগের প্রায় সব সুরকারের সুরে গান গেয়েছেন সন্ধ্যা। শচীন দেব বর্মন, অনুপম ঘটক, রবীন চট্টোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরীর মতো দিকপালদের সুরে গলা দিয়েছেন যেমন, আবার নতুন প্রজন্মের সংগীতকার কবীর সুমনের কথা ও সুরেও গেয়েছেন।

অসংখ্য জনপ্রিয় বাংলা গানের মধে শ্রোতাপ্রিয় কিছু গান ও টুকরো কথা পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল।

গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু

সন্ধ্যা মুখার্জির নিজের ভাষায়, “আমাদের (সুচিত্রা সেন ঠোঁট মিলিয়েছিলেন) প্রথম হিট গান ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’। পর্দায় ওর (সুচিত্রা) লিপ দেওয়া দেখে আমি হাঁ হয়ে গেছিলাম। এত নির্ভুল! অমর হয়ে গিয়েছিল ওই গানটা।”

অনুপম ঘটকের সুরে এই গান প্রকাশ পাওয়ার পরপরই সাড়া পড়েছিল শ্রোতার হৃদয়ে। এই গানের ‘মিতা মোর কাকলী কুহু…’ লাইনে ‘কুহু’ শব্দটা সন্ধ্যা যেভাবে গেয়েছেন তা সাড়া ফেলেছিল। ‘অগ্নিপরীক্ষা’ সিনেমার পরিচালক ছিলেন অগ্রদূত গোষ্ঠী। ১৯৫৫ সালে সিনেমাটি মুক্তি পায়।

সন্ধ্যার কথা, “অনুপম ঘটক যখন সুর করেছিলেন, তখন ডিরেক্টর বিভূতি লাহা একেবারেই খুশি হতে পারেননি। উনি রীতিমতো হম্বিতম্বি করে মিউজিক ডিরেক্টরকে বললেন, এটা কী গান হয়েছে? তখনকার দিনের মিউজিক ডিরেক্টরদের যথেষ্ট মেরুদণ্ড ছিল। আজকালকার মতো নয়। উনি পাল্টা ডিরেক্টরকে বললেন, আপনি কী করবেন আপনি ভাবুন। আমি এটা নিয়ে যথেষ্ট কনফিডেন্ট। ছবির রেকর্ডিস্ট খুব সম্ভবত ছিলেন যতীন দত্ত। উনিও বললেন, ওঁর ভাল লেগেছে। গানের একটা জায়গায় ছিল ‘কুহু কুহু’। ওঁরা ডিরেক্টরকে বললেন, এই জায়গায় সন্ধ্যার গলার কাজটা দেখুন। কী করে বলছেন গানটা কিছু হয়নি? ডিরেক্টর শেষ পর্যন্ত মেনে নিলেন। বাকিটা ইতিহাস।”
 
উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা

কবি বিমল ঘোষের লেখা আর সলিল চৌধুরীর সুরে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা’ গানটি নন-ফিল্ম গানের জগতে একটি অবিস্মরণীয় গান। ১৯৫৩ প্রকাশ হওয়া এই গান আজকের শ্রোতাদেরও মন ছুঁয়ে যায়।

আয় বৃষ্টি ঝেঁপে

সলিল চৌধুরীর লেখা ও সুরে সন্ধ্যার গাওয়া ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে’ গানটি ১৯৫৩ সালে প্রকাশ পায়।

ঘুম ঘুম চাঁদ

১৯৫৬ সালে মুক্তি পায় উত্তম-সুচিত্রা অভিনীত ‘সবার উপরে’ সিনেমা। এতে ছবি বিশ্বাসের অভিনয়ের প্রশংসার পাশাপশি জনপ্রিয় হয়েছিল সুচিত্রার ঠোঁটে সন্ধ্যার গান ‘ঘুম ঘুম চাঁদ/ ঝিকিমিকি তারা…।”

তুমি না হয় রহিতে কাছে

‘পথে হলো দেরি’ সিনেমায় সুচিত্রা সেনের কণ্ঠে ‘তুমি না হয় রহিতে কাছে’ গান শোনেনি এমন শ্রোতা বোধহয় কমই পাওয়া যাবে। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা আর রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সুরে গানটি তুমুল জনপ্রিয় পায়। অগ্রদূত পরিচালিত ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৫৭ সালে।
 
এ শুধু গানের দিন

পথে হল দেরি সিনেমার ‘এ শুধু গানের দিন’ গানটিও তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। এখনকার শিল্পীদের মধ্যে অনেকেই এখনও এই গানটি গেয়ে থাকেন। অনেকের মতে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের এই গানটি শীর্ষ জনপ্রিয় গান।

হয়ত কিছুই নাহি পাব

শিল্পী শ্যামল মিত্রের সুরে এবং গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা ‘হয়ত কিছুই নাহি পাব’ গানটি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের একটি অবিস্মরণীয় গান। বাংলা আধুনিক এই গানটি তৎকালীন এইচএমভি থেকে ১৯৫৫ সালে প্রকাশ পায়।

মধু মালতী ডাকে আয়

১৯৫৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘হারজিৎ’ সিনেমার ‘মধু মালতী ডাকে আয়’ এখনও শ্রোতাদের মুখে মুখে ফেরে। প্রণব রায়ের লেখা আর রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সুরে গানটি বাঙালির প্রেমের গানে শীর্ষে অবস্থান করছে এখনও। গানটিতে ঠোঁট মিলিয়েছিলেন অভিনেত্রী অনিতা গুহ।

চন্দন পালঙ্কে শুয়ে

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের জনপ্রিয় এই গানটি লিখেছেন তার স্বামী শ্যামল গুপ্ত।

মায়াবতী মেঘে এল তন্দ্রা

কিংবদন্তি সুরকার নচিকেতা ঘোষের সুরে শিবদাস বন্দোপাধ্যায়ের লেখা ‘মায়াবতী মেঘে এল তন্দ্রা’ সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া অন্যতম জনপ্রিয় গান। ১৯৬৩ সালে আধুনিক এই গানটি প্রকাশিত হয়। এই গানে রাধাকান্ত নন্দীর তবলার ছন্দের মূর্ছনা শ্রোতাদের হৃদয়ে দোলা তোলে।

তুমি তোমার গল্প বলো

গত শতাব্দীর শেষ দিকে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় গান গেয়েছেন কবীর সুমনের সুরে। কবীর সুমনের লেখা ১২টি গান রেকর্ড করেছিলেন সন্ধ্যা। তার সুরে গাওয়া সম্পর্কে সুমন বিভিন্ন অনুষ্নঠানে স্মৃতিচারণ করে বলেছেন, “সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় আমাকে বলেছিলেন, ‘সুমন আমি আর সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় থাকতে চাই না। আমার ডিপার্চার করিয়ে দাও’। এরকম কথা বলতে গেলে একজন সন্ধ্যা মুখার্জি হওয়া লাগে।”

১৯৯৭ সালে এইচএমভি থেকে বেরোয় কবীর সুমনের কথা ও সুরে ‘তুমি তোমার গল্প বল’।

১৯৯৯ সালে প্রকাশিত হয় ‘আসছে শতাব্দীতে’ গানটি।

প্রজাপতি মন আমার পাখায় পাখায়

নচিকেতা ঘোষের সুরে আর গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় ‘প্রজাপতি মন আমার’ গানটি এখনও শ্রোতাপ্রিয়। বাংলা আধুনিক এই গানটি ১৯৫৭
সালে এইচএমভি থেকে প্রকাশ পায়।
 
রাগ ভাটিয়ারে খেয়াল

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গুরুদের মধ্যে যামিনী গঙ্গোপাধ্যায়, ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি, চিন্ময় লাহিড়ী, এ কানন, ডিটি যোগী, গণপত রাও, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, এবং সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী। বড়ে গোলাম আলির কাছে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের বাড়িতে নাড়া বেঁধে শিষ্যা হয়েছিলেন সন্ধ্যা।

এই পথ যদি না শেষ হয় 

রোম্যান্টিক বাংলা সিনেমা, উত্তম কুমার সুচিত্রা সেন জুটি, প্রেমের জোয়ার আর একগুচ্ছ নস্টালজিয়া, এই সবকিছুর একটাই নাম, সপ্তপদী। বাংলা ও বাঙালীর মননে যদি সূর্যের মতই অমর কিছু থেকে থাকে তা হল বাইকে করে আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে কৃষ্ণেন্দু আর রিনা ব্রাউনের সেই গান'এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হত তুমি বলত'। এই গানটি মূলত ছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়য়ের কণ্ঠে। কিন্তু সেখানে যদি আদর্শ রিনা ব্রাউনের কণ্ঠ কেউ হয়ে থাকেন তিনি নিঃসন্দেহে গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। ১৯৬১ সালের এই ছবি এখনও বাংলা চলচ্চিত্রে অন্যতম শ্রেষ্ঠ। সারেগামা-র ব্যানারে এই গানের সুরকার ছিলেন স্বয়ং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।

চম্পা চামেলি গোলাপেরই বাগে 

খুব কোন গান রয়েছে যা বাংলার দুই কিংবদন্তী শিল্পী মান্না দে ও গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের যৌথ সঙ্গীত। তার মধ্যে একটি হল 'অ্যান্টেনি ফিরিঙ্গী' ছবির গান চম্পা চামেলি। উত্তম কুমার তনুজা অভিনীত সুনীল বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত ১৯৬৭ সালের এই সিনেমায় অভিনয় করার জন্য প্রথম জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন মহানায়ক। গানের সুরকার ছিলেন অনিল বাগচি। কেন এ হৃদয় মহানায়ক উত্তম কুমার ও অঞ্জনা ভৌমিক অভিনীত সুপারহিট ফিল্ম 'নায়িকা সংবাদ'। এই চলচ্চিত্রের অন্যতম জনপ্রিয় গান 'কেন এ হৃদয় চঞ্চল হল কে যেন ডাকে বারে বারে' অগ্রদূত পরিচালিত এই সিনেমা সেই বছর অর্থাৎ ১৯৬৭ সালে জুবিলি হিট হয়েছিল। এস মা লক্ষ্মী সনাতন বাংলার সেরা ঐতিহ্য হল কোজাগরী লক্ষ্মী পুজো। আর লক্ষ্মী পুজো মানেই প্রতিটি ঘরে ঘরে একটাই গান ভেসে আসে। তা হল 'শঙ্খ বাজিয়ে মা কে ঘরে এনেছি। এস মা লক্ষ্মী বসো ঘরে।' ৭০-এর দশকে পুজর গানের রমরমায় এই গান সেই সময়ের সেরা হিট ছিল। 

রাগ যে তোমার মিষ্টি

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের অন্যতম সুপারহিট গান 'রাগ যে তোমার মিষ্টি ওগো অনুরাগের চেয়ে'। ১৯৬৯ সালের জুবিলি হিট এই সিনেমায় প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন স্বরূপ দত্ত ও তনুজা। সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন পবিত্র চট্টোপাধ্যায়। এ গানে প্রজাপতি উত্তম কুমার তনুজা অভিনীত সুপারহিট সিনেমা 'দেয়া নেয়া'তে একটি গানই গেয়েছিলেন গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। আর সেই গানটিই পরবর্তীতে এই ছবির সেরা গান হিসেবে জনপ্রিয় হয়। 'এ গানে প্রজাপতি পাখায় পাখায় রঙ ছড়ায়'। আর এবার সীমানা ছাড়িয়ে চিরদিনের মত অজানার উদ্দেশ্যে হারিয়ে গেলেন গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।
কেআই//