আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে বাংলা ভাষার অন্তর্ভুক্তি
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৬:৪১ পিএম, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০৯:২১ পিএম, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ সোমবার
আখতার হোসেনের (ছদ্মনাম) বয়স তখন মাত্র ২৮ বছর যখন তিনি একটি দোকানের গুদাম সহকারী হিসেবে যোগদানের জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই -এর উদ্দেশ্যে দেশ ছেড়েছিলেন। তখন তার সংসারে ছিল তার স্ত্রী, এক কন্যা সন্তান, মা-বাবা ও চার ছোট ভাইবোন যাদের খরচ চালাতে তিনি রীতিমত হিমশিম খেতেন। গুদামের কাজকর্ম খুব তাড়াতাড়ি রপ্ত করে নিলেও কাছের মানুষদের সাথে যোগাযোগ করতে না পারায় হোমসিকনেস এবং বিষণ্নতায় ভুগতে শুরু করেন আখতার। মাসে যে টাকা আয় করতেন তা দিয়ে বার বার বাড়িতে ফোন করে টাকা খরচ করা সম্ভব ছিল না। আর ফোন করলেও দুর্বল অডিও এবং ঘন ঘন কল ড্রপ তাকে আরও বেশি হতাশাগ্রস্ত করে ফেলতো। এমন এক সময়ে তার সহকর্মীরা তাকে স্মার্টফোনে ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং অ্যাপের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল।
অবশেষে আখতার বাংলাদেশে ফেলে আসা তার পরিবারের সাথে নিয়মিত কথা বলার একটা দিশা পেল। একমাত্র মেয়ে প্রথম যেদিন দাঁড়াতে শিখলো বা যেদিন প্রথম হাঁটতে শুরু করলো সেটাও হাজার মাইল দূর থেকে ইমোর ভিডিও কলে দেখেছিলেন তিনি। আখতারের বাবা, যিনি ইংরেজি পড়তে বা লিখতে পারেন না তিনিও বাংলা টেক্সট ইনপুট ফিচার ব্যবহার করে এখন তার আর্থিক ব্যবস্থাপনার বিষয়ে ছেলের সাথে নিয়মিত চ্যাট করেন। জীবনের এই একটি সামান্য পরিবর্তন আখতারকে পুনরায় আত্মবিশ্বাসী করে তোলে এবং গুদামঘরের কাজের প্রতি আরও মনযোগী হতে তাকে সাহায্য করে। তিনি এখন ইমো গ্রুপ চ্যাট এবং এইচডি ভিডিও কলের মাধ্যমে মাতৃভাষায় শৈশবের স্মৃতি তাজা করার জন্য বাংলাদেশে অবস্থানরত তার আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুদের সাথেও যোগাযোগ করতে পারেন।
যোগাযোগের ব্যবধান ঘোচাতে পারলে মানুষ মানুষে সম্পর্ক আরো গভীর ও দৃঢ় হয়। এটি পূর্ণতা পায় দেশি ও মাতৃভাষার প্রগাঢ়তা থেকে। আমাদের আশেপাশে তাকালে এর বহু উদাহরণ পাওয়া যাবে। এর কারণ মাতৃভাষা বা মায়ের ভাষার প্রতি আমাদের অকৃত্রিম ভালোবাসা। মায়ের সাথে যুক্ত থাকার গভীর আকাঙ্ক্ষা বোঝার জন্য মাতৃভাষা শব্দটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। কিছুটা নাড়ির বন্ধনের মতো, শুধু একটাই বৈসাদৃশ্য যে এটি কখনো ছেড়া যাবেনা। মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা অর্পণের জন্য ২১শে ফেব্রুয়ারিকে বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ১৯৯৯ সালে জাতির জন্য নিজস্ব মাতৃভাষার স্বাধীনতা ও অখণ্ডতা উদযাপনের লক্ষ্যে ইউনেস্কো এই দিবসটির ঘোষণা করে। এই উদযাপনের ইতিহাসের সাথে বাংলাদেশের একটি উল্লেখযোগ্য সংযোগ রয়েছে।
ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তির ক্রমবর্ধমান গতির সাথে, বছরের পর বছর ধরে দূর করা অনেক বাধাগুলোর মধ্যে একটি হল একক ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের অধীনে একাধিক ভাষার একীকরণ। সেই লক্ষ্যে জনপ্রিয় স্মার্ট প্ল্যাটফর্ম অ্যান্ড্রয়েড এবং আইওএস উভয়েই তাদের প্ল্যাটফর্মে অন্তত একশটি ভিন্ন ভাষা সমর্থন করে। বিভিন্ন চ্যানেল জুড়ে অন্যান্য ডিজিটাল ডিভাইসগুলো তাদের উপলব্ধ ফিচারগুলোকে আরও ভালোভাবে ব্যবহার করার জন্য আরও বেশি ভাষার অন্তর্ভুক্তি করার চেষ্টা করে চলেছে।
ডিজিটালাইজেশনের এই যুগে মাতৃভাষা ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা এবং তাৎপর্যের উপর সঠিকভাবে গুরুত্বারোপ করা অত্যন্ত জরুরী, কারণ এটি মানুষকে তার শিকড়ের কাছাকাছি থাকতে সাহায্য করে। বিদেশে গেলে প্রায়শই দেখা যায় যে আমরা আমাদের দেশীয় মানুষদের খোঁজ করছি। তরুণ আখতারের মতো হাজার হাজার প্রবাসী, অভিবাসী শ্রমিক এবং বিদেশে পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থীরা কথা বলা এবং লেখার সময় দেশীয় ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে সংযুক্ত থাকার এই আকাঙ্ক্ষা অনুভব করে। আর একাধিক ভাষা যুক্ত করার মাধ্যমে ডিজিটাল কমিউনিকেশন প্ল্যাটফর্মগুলো তাদের প্ল্যাটফর্মে স্থানীয় অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির পাশাপাশি এই প্রয়োজনটিকে ভালোভাবে অন্তর্ভুক্ত করছে।
উদাহরণস্বরূপ, ইমো তার অডিও-ভিত্তিক সামাজিক নেটওয়ার্কিং প্ল্যাটফর্ম "ভয়েসক্লাব" এর সাথে আরও এক ধাপ এগিয়ে গেছে। এই প্ল্যাটফর্মে ব্যবহারকারীরা তাদের হৃদয়ের সন্তুষ্টির জন্য রিয়েল-টাইম ভয়েস চ্যাট করতে পারেন। সারাদিন যেখানে শত শত বিদেশী ভাষাভাষী মানুষের সাথে কথা হচ্ছে সেখানে “দেশি” আঞ্চলিক ভাষায় কথা শুনতে পারার অনুভূতি সব কিছুর উর্ধে – এমনটাই বোধ করেন বেশির ভাগ ডিজিটাল যোগাযোগ অ্যাপ ব্যবহারকারীরা যারা বাংলাদেশের বাইরে থাকেন। এবং এটা বলাবাহুল্য যে , আমরা যখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন করি তখন শত শত ক্রোশ দূর থেকে দেশীয় ভাষা শোনার আকাঙ্ক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া অপরিহার্য।
এই ধরনের উন্নত অডিও চ্যাট ফিচারগুলো চালু হওয়ার আগেও, ডিজিটাল ডিভাইসে বাংলা ফন্টে ম্যাসেজ পড়া বা লেখার ক্ষমতা লক্ষ লক্ষ বাঙালির হৃদয়কে উচ্ছ্বসিত করেছে। বেশিরভাগের কাছে, এটি একটি অর্জনের চেয়ে কম কিছু নয়। আবেগ প্রকাশ করার সময় আমরা যতটা সম্ভব সত্য এবং নিখুঁত হওয়ার চেষ্টা করি। প্রবাদ-প্রবচন, কবিতা বা মনের কষ্ট প্রকাশ করার বিষয়ই হোক না কেন সেগুলো আমরা আমাদের মাতৃভাষাতেই জানাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। কারণ আমরা চাই আমাদের মনের মধ্যে যেটা চলছে সেটা যাকে বলছি বা লিখছি সেও যেন ঠিক সেভাবেই বুঝতে পারে। কিন্তু যখন আমাদের চিন্তাভাবনা প্রকাশ করার জন্য সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাষা অর্জনের একটি প্রাথমিক বাধা থাকে, তখন কোনো ধারণা প্রকাশ করার আগেই উত্সাহের জোয়ার মলিন হয়ে যায়।
এখন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীর নাম, পরিচিতি, অ্যাপ্লিকেশন ইন্টারফেস এবং আরও অনেক ডিজিটাল ফিচার বাংলাতে দেখতে পাওয়া আমাদের জন্য খুবই সাধারণ ব্যাপার। কিছু অ্যাপ্লিকেশন বাংলাদেশের মানুষের জন্য জনপ্রিয় এবং পপ সংস্কৃতির রেফারেন্সের সাথে সংযুক্ত আকর্ষণীয় স্টিকারও প্রদান করে, যাতে আর কোনো ধারণা যেন ‘অনুবাদে য়ে না যায়’। তরুণ ও নতুন প্রজন্মের ডেভেলপাররাই যেহেতু পরিবর্তনটি আনছে সেহেতু এই রূপান্তরটিক খুবই ইতিবাচক দিক হিসেবে দেখা যায়। এটি আমাদের মনে আশা জাগায় যে, পৃথিবীতে পদার্পণের প্রথম মুহূর্তে যেই ভাষা আমাদের কানে বেজেছিলো, এখনও আমরা সেই ভাষায় নিশ্চিন্তে অনুভূতি প্রকাশের আবেদন বুঝতে পারি। এটি সেই ভাষা, যে ভাষায় আমরা আমাদের প্রথম ছড়া বলতে শিখেছি, প্রথম গান গাইতে শিখেছি। এখনও যখন স্মার্টফোনের স্ক্রিনে প্রিয়জনের নাম বাংলা অক্ষরে ভেসে ওঠে, আমরা উপলব্ধি করি মাতৃভাষার সৌন্দর্য।
- মাইকেল
অপারেশন্স ডিরেক্টর, ইমো
আরকে//