ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

দ্বিতীয়বার গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেলেন দৃষ্টিহীন ঋতু

রাজশাহী বিভাগীয় প্রতিনিধি

প্রকাশিত : ০৯:২২ এএম, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ শুক্রবার | আপডেট: ১০:২১ এএম, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ শুক্রবার

মুনিরা ইয়াসমিন ঋতু একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। এবার এইচএসসি পরীক্ষায় তিনি গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়েছেন। এর আগে ২০১৯ সালের এসএসসি পরীক্ষায়ও রাজশাহী বোর্ড থেকে ঋতু গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন। 

ঋতুর এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে বহু ত্যাগ-তিতিক্ষার গল্প। জন্ম থেকে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ঋতুর পথ চলা মোটেও সহজ ছিল না। তার চোখের জ্যোতি একেবারেই কম। চিকিৎসার জন্য দেশ-বিদেশের বিভিন্ন চিকিৎসকের কাছে ছুটলেও কোন সুসংবাদ পাওয়া যায়নি।

তার চোখের কোনো চিকিৎসা নেই। চশমা পরিধান করে থাকলেও তা কোনোই কাজে আসে না। বাকি জীবন এভাবেই চলতে হবে তাকে। যতটুকু দেখতে পান তা সূর্যের আলো আর পড়ার জন্য প্রখর আলোসম্পন্ন টেবিল ল্যাম্পের মাধ্যমে। দিনের বেলাতেও চার দেয়ালের ভেতরে এলে লাগে টেবিল ল্যাম্প। পরীক্ষার সময় কেন্দ্রে যেখানে অন্যান্য শিক্ষার্থীরা স্বাভাবিক আলোতে লিখতে পারেন সেখানে ঋতু শুধু মানুষের ছায়া ছাড়া আর কিছুই দেখতে পান না।

কেন্দ্রে যাতে পরীক্ষা দিতে পারেন সেজন্য সব সময় টেবিল ল্যাম্প সঙ্গে নিয়ে নিয়ে ঘোরেন ঋতু। সূর্যের আলোতে দেখলেও তা কেবলই সামান্য। হাঁটার সময় সে খুব সাবধানে পা ফেলে। পরিচিত জায়গায় চলতে সুবিধা হলেও অপরিচিত জায়গায় একেবারেই হাঁটতে পারেন না।

২০০৯ সালে ঋতুর একাডেমিক শিক্ষাজীবন শুরু হয় রাজশাহীর পিনাকল স্টাডি হোমের মাধ্যমে। পরে শাহিন স্কুল লক্ষ্মীপুর শাখায় ভর্তি হন দ্বিতীয় শ্রেণিতে। সেখানে তৃতীয় শ্রেণিতে মেধা বৃত্তি পান। তারপর রাজশাহীর ভদ্রা এলাকার সাইদুর রহমান একাডেমিতে ভর্তি হন চতুর্থ শ্রেণিতে। সেখানে চতুর্থ শ্রেণিতে বৃত্তি এবং পঞ্চম শ্রেণিতে পান বোর্ড বৃত্তি। এরপর ভদ্রা এলাকার অক্ষর একাডেমিতে ভর্তি হন ষষ্ঠ শ্রেণিতে।

সেখানে সফলতার সঙ্গে পড়াশোনা করে ২০১৬ সালের জেএসসি পরীক্ষায় রাজশাহী বোর্ড থেকে পান জিপিএ-৫। ২০১৯ সালের এসএসসি পরীক্ষায় পেয়েছিলেন গোল্ডেন জিপিএ-৫। সর্বশেষ ২০২২ সালে প্রকাশিত এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলেও পেলেন গোল্ডেন জিপিএ-৫। 

কিন্তু সে যখন প্রাইমারি স্কুলে পড়তে যায় তখন অনেকেই বলেছে মুনিরা দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। তার দ্বারা পড়াশোনা হবে না। সে যখন টেবিল ল্যাম্পের মাধ্যমে লেখাপড়া করতো তখন বন্ধুরা খুব হাসাহাসি করত।

ঋতু রাজশাহী নগরের ভদ্রা এলাকায় পরিবারের সাথে বসবাস করেন। তবে তাদের বাড়ি নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলার তেঘরিয়া গ্রামে। বাবা স্থানীয় একটি হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। মা মেরিনা পারভীন রিনা একজন গৃহিণী ছিলেন। সম্প্রতি তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। 

মুনিরা ইয়াসমিন ঋতুর একের পর এক এই সফলতার গল্পটা শুরু তার মা মেরিনা পারভীন রিনার হাত ধরেই। গত বছরের ১১ জুন মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত মেয়েকে সাহস জুগিয়েছেন তিনি। সুস্থ্য থাকা অবস্থায় সংসারের সব ঝামেলা সামলে ঋতু নিয়ে চলে গেছেন স্কুলে বা কোচিং-এ। 

ঋতুর ছায়াসঙ্গী ছিলেন তার মা। তার অদম্য ইচ্ছাশক্তি মাকে স্বপ্ন দেখিয়েছিল। মা-হারা এই অদম্য দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী কিশোরী তার স্বপ্নগুলোকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে চান।

ঋতু শুধু পড়াশোনাতেই না তার রয়েছে নানান সব প্রতিভা। সে ড্রয়িং করতে পারে যেকোনো কিছু। কবিতা, ছোটগল্প লিখাতেও সে পটু। দৃষ্টিহীনতা পেরিয়ে জীবনের নানা জটিলতাকে জয় করার ইচ্ছার কথা জানান ঋতু। বড় হয়ে সে দৃষ্টিহীনদের জন্য কিছু করতে চান। 

ঋতু বলেন, ‘আমাকে নিয়ে অনেকেই হাসাহাসি করেছে। আমি জানি এটা কত কষ্টের। প্রতিষ্ঠিত হয়ে প্রতিবন্ধীদের জন্য একাডেমি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাদেরকে ব্যবহারিক জ্ঞান দিতে চাই।’

এএইচ/