ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

রাতের আঁধারে ভাংচুর-গুলিবর্ষণ, ৯৯৯-এ কল করে প্রাণরক্ষা

কক্সবাজার প্রতিনিধি

প্রকাশিত : ০৫:৫৫ পিএম, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২ শনিবার

খোলা আকাশের নিচে অসহায় রওশনের পরিবার

খোলা আকাশের নিচে অসহায় রওশনের পরিবার

কক্সবাজারের মহেশখালীতে নিজের বসতভিটার জমি রক্ষায় সিসি ক্যামেরা বসিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি অসহায় রওশন আলীর। রাতের আঁধারে হামলা চালিয়ে বসতবাড়ি ভাংচুর, লুটপাট ও ফাঁকা গুলিবর্ষণ করে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে স্থানীয় প্রভাবশালী ও ভূমিগ্রাসী চক্র। আকস্মিক ঘরবাড়ি ভেঙ্গে দেয়ায় কোনও উপায় না পেয়ে ত্রিপল টাঙ্গিয়ে খোলা আকাশের নিচে দিনাতিপাত করছেন রওশন আলীর পরিবার। 

এ নিয়ে মহেশখালী থানায় রওশন আলী বাদি হয়ে একটি অভিযোগ দায়ের করলেও পুলিশ মামলা নেয়নি। পরে ১০ জনকে আসামি করে আদালতে মামলা করলে মামলাটি কক্সবাজার ‘পিবিআই’কে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

মামলার এজাহার ও স্থানীয় সূত্র জানান, গত ১১ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে কক্সবাজারের দ্বীপ উপজেলা মহেশখালী পৌরসভার উত্তর ঘোনারপাড়া গ্রামের হাজী মিয়া হোসনের পুত্র রওশন আলী হাসানের বসতবাড়ি দখলে নিতে মহেশখালী গোরকঘাটা সিকদার পাড়া এলাকার হাশেম সিকদারের পুত্র কায়সার সিকদারের নেতৃত্বে ১৫/২০ জনের একটি সংঘবদ্ধ দল হামলা চালায়। রাতের আঁধারে অস্ত্র, দা, কিরিচ নিয়ে রওশন আলীর মালিকানাধীন বসতবাড়ি ও ভিটায় অবৈধভাবে দখলের উদ্দেশ্যে ভাংচুর করে। এ সময় হামলাকারীরা একাধিক ফাঁকা গুলিবর্ষণ করে ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যেমে রওশন আলীর স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে অস্ত্রধারীরা বসতভিটার চারপাশে স্থাপিত সিসি ক্যামেরা, এনভিআর, সুইসসহ সকল সরঞ্জাম লুটপাট করে ঘেরা বেড়া ভাংচুর করে। 

এসময় রওশন আলীর স্ত্রী রহিমা আক্তার আর্তচিৎকার করলে হামলাকারীরা রহিমা আক্তার ও তার স্কুল পড়ুয়া মেয়ে আয়েশা সিদ্দিকা, ফুফু বেগম খাতুন ও ভগ্নিপতি আব্দুল আজিজকে মারধর করে। ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে লুটপাট করা মালামাল নিয়ে যাওয়ার সময় প্রাণনাশেরও হুমকি দেয়। ভুক্তভোগী রওশন আলী জানমাল রক্ষার্থে ৯৯৯-এ কল করলে দ্রুত সময়ের মধ্যে থানা পুলিশ উপস্থিত হয়ে উক্ত ঘটনা সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। 

এসময় এলাকাবাসী এগিয়ে এসে আহতদের উদ্ধার করে মহেশখালী হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে উক্ত ঘটনায় জমির মালিক রওশন আলী বাদী হয়ে মহেশখালী থানায় একটি এজাহার দায়ের করলেও প্রভাবশালীদের চাপের মুখে পুলিশ মামলা নিতে অপারগতা প্রকাশ করে। 

এতে নিরাপত্তাহীনতায় থাকা রওশন আলীর পরিবার নিরুপায় হয়ে কায়সার সিকদারকে প্রধান আসামি করে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ১০ জনের বিরুদ্ধে মহেশখালী সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা দায়ের করেন। পরে আদালতের বিচারক বাদী পক্ষের আইনজীবীর শুনানী শেষে ঘটনাটি আমলে নিয়ে পিবিআই কক্সবাজারকে তদন্তের জন্য নির্দেশ দেয়।

এদিকে, ঘটনাস্থল সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখা যায়, সংঘঠিত ঘটনায় বসতভিটার আঙ্গিনার এক পাশে খোলা আকাশের নিচে স্কুল পড়ুয়া সন্তানদের নিয়ে বসে আছেন রওশন আলী হাসান ও তার স্ত্রী রহিমা আক্তার। চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ। ভীতসন্ত্রস্ত স্কুল পড়ুয়া সন্তানরা কাঁদছে ভিটে হারানোর ভয়ে। দ্বিতীয় হামলার ভয়ে-আতঙ্কে ও উৎকণ্ঠায় রওশন আলী ও তার স্ত্রী রহিমা আক্তার।

খোলা আকাশের নিচে বসা রওশন আলীর স্ত্রী রহিমা আক্তার বলেন, ‘দ্বীপ উপজেলায় এখন জমির দাম বেড়েছে। আমার স্বামীর জমিটির মূল্য আকাশচুম্বী হওয়ায় মহেশখালী উপজেলার গোরকঘাটা এলাকার হাশেম সিকদারের পুত্র কায়সার সিকদারের লোলুপ দৃষ্টি পড়ে। প্রথমে বিক্রির জন্য চাপ সৃষ্টি করে। কিন্তু আমাদের একমাত্র সহায় সম্বল বসতভিটা বিক্রি করব না বলে জানালে রাতের আঁধারে দখলের জন্য হামলা চালায়। এসময় বাড়িঘর ও ভিটার সীমানা প্রাচীর ভাংচুর করে এবং লুটপাট চালায়। ফাঁকা গুলি করে ভীতি সঞ্চার করে। এরপর থেকে আতঙ্ক ও ভয়ে আমার স্কুল পড়ুয়া ছেলে-মেয়েরা কাঁদছে।’

ভুক্তভোগী রওশন আলী হাসান বলেন, ‘মহেশখালী উপজেলার গোরকঘাটা মৌজার ২৪৫২-৬২ খতিয়ানের ৬০ শতক জমি ক্রয়সূত্রে মালিক আমি। কিন্তু জমিটি বিক্রি করতে বার বার চাপ দেয় স্থানীয় প্রভাবশালী ভূমিগ্রাসী চক্র কায়সার সিকদার। বিক্রি না করলে জোরপূর্বক দখল করবে বলেও হুমকি দেয়। ফলে আমি আমার বসতভিটা রক্ষায় বাড়িতে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করি। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে রাতের আঁধারে বসতভিটা দখলে নিতে হামলা চালায় তারা। এসময় একের পর এক যখন ফাঁকা গুলিবর্ষণ করে, তখন ৯৯৯ নাম্বারে কল দিলে ঘটনাস্থলে পুলিশ আসে এবং আমরা জানে রক্ষা পায়। কিন্তু পরের দিন সকালে পুলিশ আমাদের মামলাটি গ্রহণ করেনি। পুলিশ বলছে, উপর মহলের চাপ রয়েছে। তাই মামলা নিতে তারা অপারগ। এরপর আদালতে মামলা করি। মামলা করায় ক্ষিপ্ত হয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে গোরকঘাটা বাজারে কায়সার বাহিনী আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে (লিয়াকত স্টোর) হামলা চালায়। বর্তমানে পরিবার নিয়ে আমি আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠায় জীবনযাপন করছি। যে কোনো সময় কায়সার সিকদার ও তার লোকজন হামলা করতে পারে।’ 

প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় মোহাম্মদ হোসেন ও আব্দুল হাসেম বলেন, জমিটি রওশন আলী হাসানের। দীর্ঘদিন ধরে পরিবার নিয়ে সেখানে বসবাস করছেন তিনি। স্থানীয় নজু মিয়ার ছেলে আব্দুল আজিজের সঙ্গে জমি নিয়ে রওশন আলীর বিরোধের কথা শোনা গেলেও কায়সার সিকদারের কোনো স্বত্ব নেই। কায়সার সিকদার ও তার বাহিনী নিয়ে জমি দখলের চুক্তি করে আব্দুল আজিজের মেয়ে ওয়ারিশ নামধারী মাবিয়ার সঙ্গে। এ কারণে কায়সার সিকদার দখলবাজ হিসাবে ভাড়ায় হামলা চালায় রওশন আলীর বসতভিটায়। রাতে একাধিক গুলিবর্ষণের শব্দে এলাকাবাসী আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে।’

এর আগে উক্ত ঘটনা মিমাংশার জন্য গঠিত ৪ জন স্থানীয় শালিসকারদের মধ্যে একজন গোরকঘাটা ইউনিয়নের সাবেক চেয়াম্যান শামশুল আলম। তিনি বলেন, ‘মহেশখালী পৌর মেয়র মকছুদ মিয়ার অনুরোধে আমরা ঘটনাস্থলে যাই এবং জমিটির কাগজপত্রাদি পর্যালোচনা করি। এতে দেখা যায়, জমিটির মালিক পূর্বে বিক্রি করে দেয়ায় ওয়ারিশগণ কোনো জমির অংশীদার থাকে না। এ কারণে জমিটির দখলস্বত্ব ও জমির মালিকানা রওশন আলী হাসানের রয়েছে। সেখানে অভিযুক্ত কায়সার সিকদার ও তার পক্ষের কোনো জমি নেই। বরং কায়সার সিকদার একটি বাহিনী গঠন করে জমিতে রাতের আঁধারে প্রবেশ করে এবং গোরকঘাটা বাজারে রওশন আলী পক্ষের লোকজনের উপর দফায় দফায় হামলা চালায়। কায়সার সিকদার এখানে প্রভাব বিস্তার করছে।’  

জমির ওয়ারিশ নামধারী মাবিয়া বলেন, ‘এটি আমার পৈত্রিক সম্পত্তি। এ জমি আমাদের। এ নিয়ে স্থানীয়ভাবে বিচার চলছে। কিন্তু কারও বিচার মানছেন না রওশন আলী। আমরা কোনোভাবে তার বসতবাড়িতে হামলা করিনি। মিথ্যা মামলা করছে রওশন আলী।’ 

এ ব্যাপারে অভিযুক্ত কায়সার সিকদার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘রওশন আলীর বসতবাড়িতে আমি কেন হামলা করব? এখানে কি আমার কোনো স্বত্ব আছে? আমি উক্ত বিরোধপূর্ণ জমিটির স্থানীয় শালিসকারদের একজন। রওশন আলী কারও বিচার মানে না। থানায় নিজে অভিযোগ করে হাজির হয়নি। আবার পৌর মেয়র মকছুদ মিয়ার কাছেও অভিযোগ করে দুটি স্ট্যাম্প সই করে হাজির হচ্ছে না। বরং আদালতে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে। মামলাটি এখনও তদন্তাধীন। এছাড়াও এ জমিটির ব্যাপারে স্থানীয় তহসীল অফিসের তদন্ত চলছে।’

মহেশখালী ঘোরকঘাটার তহসীলদার মোহাম্মদ উল্লাহ জানান, ‘উক্ত জমিটি ভূমি অফিস থেকে আমার বরাবরে পাঠানোর পর পরিমাপ করে সার্ভেয়ার একটি প্রতিবেদন উপজেলা ভূমি অফিসে পাঠিয়ে দিয়েছে। সেখানে কি রয়েছে আমার জানা নেই।’

মহেশখালী থানার ওসি মো: আব্দুল হাই জানান, ‘থানায় মামলা না নেয়ার অভিযোগটি সত্য নয়। এই রকম যদি কোনো ঘটনা ঘটে থাকে তাহলে অবশ্যই পুলিশ ব্যবস্থা নিবে। রওশন আলীর বিষয়টি এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না। খোঁজ নিতে হবে।’

এ ব্যাপারে জানতে মহেশখালী পৌর মেয়র মকছুদ মিয়ার মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। 

এনএস//