ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

বাংলা ভাষা ইস্যুতে প্রায়ই উত্তপ্ত হয় আসাম (ভিডিও)

মুহাম্মদ নূরন নবী

প্রকাশিত : ১২:০৬ পিএম, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ রবিবার

এখনও শেষ হয়নি ভারতের আসামে বাঙালিদের বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে শুধু সরকারি ভাষার স্বীকৃতিই মিলেছে। কিন্তু প্রায় সময়ই ভাষার ইস্যুতে উত্তপ্ত হয় আসাম। এটি ভাষাগত বৈষম্যের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকেনি, জাতিগত পরিচয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থানকেও নাড়া দিয়ে যাচ্ছে।

আদম শুমারী ১৯৩১’র পরিসংখ্যান বলছে, অবিভক্ত ভারতে আসাম ও তৎকালীন শ্রী-হট্ট বা সিলেটের বাঙালির সংখ্যা শতকরা ৯৮ ভাগ। ১৯৪৭-এ দেশভাগে পূর্ব বাংলার সনাতন ধর্মের বেশিরভাগেরই গন্তব্য ছিল এই আসাম। এমনকি, জুতসই না হওয়া পূর্ব পাকিস্তানে আসা মুসলমানদের স্বাচ্ছন্দের ঠিকানাও এখানে খুঁজেছেন। এসব কারণেই আসাম বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠই থেকে যায়। 

ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য গড়ার সময়ে সূচনা এই বিপত্তির। প্রাদেশিক ভাষা অসমীয় করার নিদের্শনা দেয় সরকার। প্রতিবাদে রাজপথে নামে বাঙালিরা। গঠিত হয় গণসংগ্রাম পরিষদ। চলে শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন। অচল হয়ে যায় আসাম। 

আসামের কবি ও ভাষার গবেষক সুকুমার বগচী বলেন, “অসমীয়দের জন্য একটা উদ্বেগের কারণ যে, আমরা বোধহয় আবার সংখ্যালঘু হয়ে যাই নিজের রাজ্যে। এই ভয়টা কারও কারও মনে কাজ করে। কারা অসমীয়া এই কথাটাই গোলমেলে। বাঙালিরা বাংলা ভাষায় কথা বলেন, মারাঠি যারা তারা মারাঠি ভাষায় কথা বলেন। এখানে মুশকিলটা হল যে, যারা অসমীয়া ভাষায় কথা বলেন তারাই যদি শুধু অসমীয়া হয়, সেটা তো অনেকেই মানতে চাইছেন না।”

১৯৬১ সালে বোরাকের শীলচর স্টেশনে আন্দোলন থামাতে সাধারণ মানুষের ওপর গুলি চালায় ‘আসাম প্যারা মিলিটারি’। ঘটনাস্থলেই ৯ জনসহ প্রাণ হারান ১১ জন। 

উত্তর ও উত্তর-পূর্ব ভারতের বিবিসি প্রতিনিধি প্রত্যুষা মুখার্জী বলেন, “শীলচর রেলওয়ে স্টেশন থেকে সেই আন্দোলন শুরু হয়েছিল এবং ১৯ মে একটি রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম হয়েছিল। যার পরিণাম হিসেবে ১১ জন তরতাজা যুবক প্রাণ দিয়েছিলেন।”

সুকুমার বগচী বলেন, “সেখানেই ১৯৮৬ সালে পুলিশের গুলিতে দুজন শহীদ হন অসমীয়া। একটা নির্দেশিকা জারি করা হয়েছিল ১৯৭২ সালে, তখনও আন্দোলন হয়। সেই সময়ও শহীদ হয়েছিল। মোটামুটি বলা হয়, প্রত্যক্ষভাবে অন্তত ১৬ জন বাঙালি শহীদ হয়েছেন ভাষার জন্য অসমে। আসলে প্রত্যক্ষ শহীদ হয়েছেন মোট ১৮ জন। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে বাঙালিদের উপর আক্রমণ হয়েছে তখন নিহত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।”

পুরো ভারতজুড়ে ওঠে নিন্দা-সমালোচনার ঝড়। বাধ্য হয়েই পিছু হটে রাজ্য সরকার। প্রত্যাহার হয় সিদ্ধান্ত। সরকারি ভাষা হিসেবে তালিকাভূক্ত হয় বাংলা। সরকারি এই নির্দেশনা মেনে নেয়নি অসমীয়রা। এখনও ভাষার দাবিতে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে আসাম। উঠে আসে বৈষমের বিষয়গুলো। 

সুকুমার বগচী বলেন, “মাঝে মাঝেই কোন কোন সরকারি কর্তারা সেখানে গিয়ে অসমীয়া প্রচারপত্র, বিজ্ঞপ্তি, হোল্ডিং ইত্যাদি দেন এবং তার ফলে আবার প্রতিবাদ হয়। বলা হয়, আমাদের এখানে সরকারি ভাষা বাংলা, কেন অসমীয়টা এখানে দিচ্ছ। এটা যে একেবারেই শেষ হয়ে গেছে একথা বলা যাবে না।”

পরিসংখ্যান বলছে, সরাসরি ভাষার জন্যই এ পর্যন্ত প্রাণ দিয়েছেন ১শ’ ৩০ জন। আর পরোক্ষভাবে প্রাণ গেছে ১০ হাজারেরও বেশি। 

আসামের কবি ও ভাষার গবেষক সুকুমার বগচী, “শহীদ তীর্থ বরাক একটা বই প্রকাশ করেছেন। যেখানে সমস্ত শহীদের নাম, পরিচয় দেওয়া আছে। সবগুলো আন্দোলনের প্রেক্ষাপটের বিবরণ দেওয়া হয়েছে। সেখানে কমপক্ষে ১৩০ জন শহীদ হবে বলে দাবি করা হয়েছে। তাদের নামদামও দেওয়া আছে, কোথাকার তারা, কবে হয়েছিল এ ঘটনাগুলো। সেইগুলো যদি ধরা হয় তাহলে ১৯৬০ থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার বাঙালি নিহত হয়েছেন নানাভাবে।”

বিশ্লেষকদের মতে, সংখ্যায় বেশি হলেও বাঙালিদের নাগরিকত্ব ইস্যুসহ অর্থনৈতিক প্রবঞ্চনার মুখোমুখি হতে হচ্ছে এই ভাষার জন্যই। 

এএইচ/