প্রবাসীর স্ত্রীকে ধর্ষণের পর ৬ টুকরো, ফের রিমান্ডে ৩ আসামি
সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি
প্রকাশিত : ০৫:৩৪ পিএম, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ রবিবার | আপডেট: ০৫:৩৬ পিএম, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ রবিবার
তিন আসামি জিতেশ, অনজিৎ ও অসীত গোপ
সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে সৌদি প্রবাসীর স্ত্রী শাহনাজ পারভীন জ্যোৎস্নাকে (৩৫) পালাক্রমে ধর্ষণ ও ছয় টুকরো করে লাশ গুমের চেষ্টার অভিযোগে গ্রেফতারকৃত তিন আসামির আবারও ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। রোববার দুপুরে সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর জোনের জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বেগম ইসরাত জাহান এ রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এদিন, ওই তিন আসামিকে আদালতে হাজির করে প্রত্যেকের ৭ দিন করে রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডির) পরিদর্শক লিটন দেওয়ান। শুনানি শেষে প্রত্যেক আসামির ৩ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।
আসামিদের রিমান্ড মঞ্জুর হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পুলিশের সুনামগঞ্জ আদালত পরিদর্শক মো. বদরুল আলম তালুকদার। রিমান্ড মঞ্জুর হওয়ার পর আসামিদের সিআইডি নিজের হেফাজতে নিয়েছে বলে জানান তিনি।
এ মামলার আসামিরা হলেন- জগন্নাথপুরের অভি মেডিকেল হল ফার্মেসির মালিক জিতেশ চন্দ্র গোপ (৩০), একই এলাকার মুদি দোকানদার অনজিৎ চন্দ্র গোপ (৩৩) ও অরূপ ফার্মেসির মালিক অসীত গোপ (৩৬)।
এর আগে গত ২০ ফেব্রুয়ারি ওই তিন আসামিকে ৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছিলেন সুনামগঞ্জের চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আব্দুর রহিম।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক লিটন দেওয়ান বলেন, ‘শাহনাজ পারভীন জ্যোৎস্না হত্যাকাণ্ডে গ্রেফতারকৃত তিন আসামি ৮ দিনের রিমান্ডে বেশকিছু তথ্য দিয়েছে। তাই অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আরও ৭ দিন করে রিমান্ড চাওয়া হয়েছিল। আদালত ৩ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। ঘটনার প্রকৃত রহস্য বের করতে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’
জানা যায়, ঘটনার মূল হোতা ফার্মেসির মালিক জিতেশ চন্দ্র গোপ কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার সইলা গ্রামের যাদব গোপ ও অনিতা রানী গোপের ছেলে। গত ১০ বছর ধরে জগন্নাথপুর বাজারে একটি ঔষধের দোকানে চাকরি করেন তিনি। এরপর গত এক বছর ধরে ওই মার্কেটেই অভি ফার্মেসি নামে নিজে একটি ঔষধের দোকান দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন।
অপর দুই আসামি অনজিৎ চন্দ্র গোপ কিশোরগঞ্জের ইটনার মৃত রসময় চন্দ্র গোপ ও উত্তরা রানী গোপের ছেলে এবং অসীত গোপ নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের পতিত পাবন গোপ ও অঞ্জলি রানী গোপের ছেলে। জিতেশকে রাজধানীর ভাটারার নূরের চালা এলাকা থেকে এবং জগন্নাথপুর পৌর এলাকা থেকে অনজিৎ ও অসীতকে গ্রেফতার করে সিআইডি।
সিআইডি ও থানা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, হত্যার শিকার শাহানাজ পারভীন জ্যোৎস্নার স্বামী ছুরুক মিয়া দীর্ঘদিন ধরে সৌদি প্রবাসী। ছুরুক মিয়ার গ্রামের বাড়ি উপজেলার রানীগঞ্জ ইউনিয়নের নারিকেলতলা গ্রামে। আর জ্যোৎস্নার বাবার বাড়ি একই উপজেলার আশারকান্দি ইউনিয়নের শেওড়া গ্রামে। শাহনাজ পারভীন জ্যোৎস্না ২০১৩ সাল থেকে জগন্নাথপুর পৌরসভার পেছনের কলোনিতে নিজ মালিকানাধীন বাসায় ২ ছেলে ও ১ মেয়েকে নিয়ে বসবাস করে আসছিলেন।
পৌর পয়েন্টের ব্যারিস্টার মির্জা আব্দুল মতিন মার্কেটের জিতেশ গোপের ‘অভি মেডিকেল হল’ নামের ফার্মেসি থেকে পরিবারের সদস্যদের জন্য ঔষধ কেনার সুবাদে জিতেশের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। শাহনাজ পারভীন নিজেও কিছুদিন ধরে বেশ কিছু শারীরিক গোপনীয় সমস্যায় ভুগছিলেন। এ সমস্যার সমাধানে পরামর্শের জন্য গত ১৬ ফেব্রুয়ারি বিকেলে জিতেশের ফার্মেসিতে গেলে ফার্মেসির ভিতরে প্রাথমিক চিকিৎসা কক্ষে তাকে দীর্ঘক্ষণ বসিয়ে রাখা হয়। কাস্টমারের ভিড় কমলে তার সঙ্গে কথা বলে সমস্যা সমাধানের জন্য সঠিক ওষুধ তাকে দেওয়া হবে বলে জিতেশ সময়ক্ষেপণ করেন। এরপর জিতেশ চন্দ্র গোপ তার বন্ধু মুদি দোকানদার অনজিৎ গোপ (৩৩) ও পাশের অরূপ ফার্মেসির মালিক অসিত গোপকে (৩৬) নিয়ে শাহনাজ পারভীনকে ধর্ষণের পরিকল্পনা করেন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, জিতেশ শাহনাজ পারভীনকে চিকিৎসার কথা বলে ঘুমের ঔষধ খাওয়ালে তিনি ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। এরপর তাকে ফার্মেসির ভিতরে রেখেই জিতেশ বাইরে তালা দিয়ে চলে যান। রাতে আশপাশের সব দোকান বন্ধ হলে ফার্মেসি খুলে ভেতরে প্রবেশ করে এনার্জি ড্রিংকস পান করেন। এরপর তারা শাহনাজ পারভীনকে পালাক্রমে ধর্ষণ করেন।
ধর্ষণের বিষয়টি শাহনাজ তার পরিবারের সদস্য ও অন্যদের কাছে প্রকাশ করার কথা বললে, জিতেশসহ অন্য দুইজন তাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন এবং শাহনাজ পারভীনকে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে এবং বিশ্রাম কক্ষে থাকা বালিশ দিয়ে মুখ চেপে ধরে হত্যা করেন। হত্যার পর ফল কাটার ধারালো ছুরি দিয়ে লাশটি মাথা, দুই হাত, দুই পা এবং বুক-পেটসহ ৬টি অংশে বিভক্ত করে ফেলে। দোকানে থাকা ঔষধের কার্টন দিয়ে খণ্ডিত অংশগুলো ঢেকে রেখে ফার্মেসি তালা দিয়ে চলে যায়। পরে সুবিধাজনক সময়ে শাহনাজ পারভীনের লাশের খণ্ডিত অংশগুলো মাছের খামারে ফেলে দেয়ার পরিকল্পনা ছিল তাদের। কিন্তু ভোর হয়ে যাওয়ায় এবং লোকজন চলে আসায় তারা কাজটি করতে পারেননি।
এদিকে গত বুধবার বিকেলে ঔষধ কেনার কথা বলে ঘর থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হওয়া শাহানাজ পারভীন জ্যোৎস্নার আত্মীয়-স্বজন রাতে অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তাকে না পেয়ে স্বজনদের সন্দেহ হলে ফার্মেসির মালিকের বাসায় খোঁজ করে জানতে পারেন, তিনি পরিবার নিয়ে ভোরে পালিয়েছেন। পরদিন গত ১৭ ফেব্রুয়ারি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সাজেদুল ইসলামের উপস্থিতিতে পুলিশ অভি ফার্মেসির তালা ভেঙে ভেতরে বিছানার চাদর দিয়ে মোড়ানো শাহানাজের খন্ডিত লাশ উদ্ধার করে।
একইদিন এই ঘটনায় নিহতের ভাই হেলাল উদ্দিন বাদী হয়ে জগন্নাথপুর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। সিআইডি গত ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানী ও সুনামগঞ্জে অভিযান চালিয়ে শাহনাজ হত্যার মূল তিন আসামিকে গ্রেফতার করে।
এনএস//