ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

ইউক্রেনের ভোগান্তির শুরু যেভাবে

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১২:১৩ এএম, ৬ মার্চ ২০২২ রবিবার | আপডেট: ০৯:১১ এএম, ৬ মার্চ ২০২২ রবিবার

সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ১৯৯১ সালে স্বাধীন হওয়া ইউক্রেনের একপাশে রাশিয়া অন্য পাশে পশ্চিমা বিশ্ব। স্বাভাবিকভাবেই দুই পক্ষই প্রভাব রাখতে চায় কৃষি ও শিল্পে সমৃদ্ধ দেশ ইউক্রেনে। এদিকে ইউক্রেনের রাশিয়া সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বহু রুশ নাগরিকের বাস। দেশটির অপর প্রান্তের নাগরিকরা পশ্চিমা মতাদর্শ তথা ন্যাটো ও ইউরোপিয় ইউনিয়ন ঘেঁষা। 

ইউক্রেনীয়দের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব অনেকটা চাপা থাকলেও ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্বের টানাটানি কিন্তু চরম প্রকাশ্য এবং তা দীর্ঘদিন ধরেই।

সাদা চোখে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের কারণ বিবেচনা করতে গেলে প্রথমেই চলে আসে ইউক্রেনের ইউরোপিয় ইউনিয়ন প্রীতি এবং ন্যাটোভুক্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা। এজন্য অনেকে যুক্তরাষ্ট্রকেও দুষছেন, যে যুক্তরাষ্ট্রই ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত হওয়ার ইন্ধন যুগিয়েছে। কিন্তু এছাড়াও রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের আর কোনও কারণ আছে কি? 

ইউক্রেনের ইতিহাস ঘাঁটলে প্রথমেই চোখে পড়বে, প্রতিবেশী হলেও রাশিয়ার সাথে দেশটির কখনই সুসম্পর্ক ছিল না। 

১৯১৭ সালে ভ্লাদিমির লেনিনের বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বে রুশ সাম্রাজ্যের পতন ঘটে এবং কমিউনিস্ট বিপ্লব হয়। যার ফলশ্রুতিতে তাত্ত্বিক দর্শনের ভিত্তিতে প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন সৃষ্টি হয় ১৯১৮ সালে।
এই সোভিয়েত ইউনিয়নের আওতায় ছিল ইউক্রেন, বেলারুশ, এস্তোনিয়া, লাটভিয়াসহ রাশিয়ার আশপাশের পুরো অঞ্চল। আর এই পুরো অঞ্চলের মোড়ল ছিল রাশিয়া। আর সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বেসর্বা নেতা ছিলেন লেনিন। বলা যায়, ইউক্রেনের পথচলা লেনিনের হাত ধরেই। 

স্নায়ুযুদ্ধকালীন সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী।

১৯২২ থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত লেনিনের দিকনির্দেশনায় সোভিয়েত ইউনিয়ন চলে। এরপর ১৯২৪ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান নেতা হন জোসেফ স্ট্যালিন। 

এ সময় স্ট্যালিনের কিছু চাপিয়ে দেওয়া নীতির কারণেই গৃহযুদ্ধের কবলে পড়ে পুরো সোভিয়েত ইউনিয়ন। 

সে সময় যৌথ খামার নীতি বাস্তবায়নে বলতে গেলে অনেকটাই কঠোর হয়েছিলেন স্ট্যালিন। এই নীতির মতাদর্শ ছিল, সব সম্পত্তির মালিক হবে রাষ্ট্র। কোনো ধনী-গরিব থাকবে না। সবাই সমান খাবে, সমান পরবে। 

এই সূত্রে কৃষকদের জমি ও পশুর মালিকানা চলে যায় রাষ্ট্রের হাতে। সাধারণ কৃষক শুধু নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে জমিতে কাজ করবেন। 

এই নীতির প্রতিবাদ করেছিল ইউক্রেনের নাগরিকরা। এজন্য মাশুলও দিতে হয়েছিল দেশটিকে। 

১৯৩২-৩৩ এই এক বছরে সোভিয়েত নেতার দমন-পীড়ন আর এর কারণে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে ইউক্রেনে মৃত্যু হয়েছিল কোটি মানুষের। ইউক্রেনের ইতিহাস থেকে আজও মুছে যায়নি সেই স্মৃতি। 

অবশ্য শেষ পর্যন্ত মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি যৌথ খামার নীতি। ফলস্বরূপ ১৯৯১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ভেঙে যায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। সৃষ্টি হয় ১৫টি আলাদা রাষ্ট্রের। 

ইউক্রেনীয়দের মতে, এই সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা রাশিয়ার বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন ইউক্রেনের জন্ম। এ থেকে বোঝাই যায় রাশিয়ার সাথে ইউক্রেনের অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর নয়।

স্বাধীন হয়েও বিপদ কাটেনি ইউক্রেনের। কারণ দেশটির রাশিয়া সীমান্তবর্তী এলাকা লুহানস্ক ও দনেতস্ক অর্থাৎ দুটি একসাথে ডনবাস অঞ্চলে রয়ে যায় বহু রুশ নাগরিক। সেইসঙ্গে কিছু রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন, যাদেরকে ইন্ধন দিতে থাকে রাশিয়া। 

২০০৫ সালে ভিক্টর ইউশেংকো ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন ইউরোপিয় ইউনিয়নপন্থী। যে কারণে ২০০৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ইউশেংকোর শাসনকালে ইউক্রেনের ইইউ প্রীতি বেড়ে যায়, দেশটি ঝুঁকতে থাকে ন্যাটোর প্রতিও। 

বিষয়টি অপর প্রান্তে থাকা প্রতিবেশী রাশিয়া ভালোভাবে নেয়নি। 

এ সময় ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ। তিনি আবার রুশপন্থী। তাই ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চল ক্রিমিয়ায় সহজেই ঘটে রুশ অনুপ্রবেশ। ফলে সাধারণ ইউক্রেনীয়দের কাছে অপ্রিয় হয়ে ওঠেন ইয়ানুকোভিচ। 

ভাবমূর্তি রক্ষায় ইউরোপিয় ইউনিয়নের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করে ফেললেন ইয়ানুকোভিচ। এতে ঘটে আরেক মুশকিল, কারণ বিষয়টি একবারেই পছন্দ করেননি পুতিন। তাই পুতিনকে খুশি করতে ওই বাণিজ্য চুক্তি থেকে আবার বেরিয়েও যান তিনি। 

এমন নড়বড়ে প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে ক্ষেপে ওঠে ইউক্রেনের মানুষ। এক পর্যায়ে ইয়ানুকোভিচ পালিয়ে রাশিয়ায় আশ্রয় নেন এবং শোনা যায় এখনও তিনি সেখানেই আছেন।

সুযোগ বুঝে ঠিক এ সময় অর্থাৎ ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল করে নেয় রাশিয়া। অর্থাৎ ইউক্রেন দখলের পথে এক ধাপ এগোয় দেশটি। এতে খুব স্বাভাবিকভাবেই রাশিয়ার প্রতি তিক্ততা বাড়ে ইউক্রেনের। 

এদিকে একইসময় ডনবাসের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ওই অঞ্চলকে স্বাধীন হিসেবে ঘোষণা দেয়। যদিও সে সময় আর কেউ তাদের স্বীকৃতি দেয়নি। এটিকেই গুঁটি হিসেবে রেখে দেয় রাশিয়া। 

এরপর দুইবার নির্বাচন হয়েছে ইউক্রেনে। ২০১৪ সাল থেকে ছিলেন পেত্রো পোরোশেংকো এবং সবশেষ ২০১৯ থেকে এখন পর্যন্ত ভলোদিমির জেলেনস্কি। এরা দুজনেই আবার পশ্চিমাঘেঁষা। তাই এই দুই শাসনআমলে আবারও পশ্চিমা প্রীতি বাড়ে ইউক্রেনের, যা রাশিয়ার মাথাব্যাথা বাড়িয়ে দেয়। 

ইউক্রেন ন্যাটোভুক্ত হলে রাশিয়ার নিরাপত্তায় ব্যাঘাত ঘটবে, এটি যতটা সত্য, ঠিক ততটাই সত্য রাশিয়ার ইউক্রেন দখলের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে ন্যাটো এবং পশ্চিমা বিশ্ব। 

তাহলে বলাই যায় যে, ইউক্রেন ন্যাটোভুক্ত না হলেও রাশিয়া ইউক্রেন দখলের পথেই হাঁটত, এমনটা মনে করছেন বিশ্ব রাজনীতির গবেষকরাও। 

পোল্যান্ডের ওরসলোর ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ লজিস্টিক অ্যান্ড ট্রান্সপোর্টের অধ্যাপক এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গবেষক হুসেইন আলম বলেন, “ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা রাশিয়ার আগ্রাসনের একটি কারণ, যা একেবারেই প্রকাশ্য। তবে আরও কারণ রয়েছে। তার মধ্যে দ্বিতীয়টি হল, রাশিয়া মনে করে ইউক্রেন আলাদা রাষ্ট্র হলেও এর জন্ম লেনিনের হাতে, সুতরাং এটি রাশিয়ারই অংশ।“ 

এছাড়া আরও একটি বিষয়কে এই আগ্রাসনের কারণ এসেছে গণমাধ্যমে। সেটি হল, এই যুদ্ধ পুরোটাই পুতিনের পাগলামি। যদিও এই বিষয়টির কোনও যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। 

তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পথে বিশ্ব? 

ইউক্রেনের পক্ষে থাকার ব্যাপারে প্রথম থেকেই ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যসহ ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো। সেই আশাতেই বিশাল রুশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি। তবে শেষ পর্যন্ত যখন রাশিয়া হামলা করেই বসল তখন পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর পক্ষ থেকে কার্যকর কোনও সাড়া পাওয়া গেল না। তখন সবাই ধরেই নিয়েছিল, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কায় সরাসরি ইউক্রেনের পক্ষে মাঠে নামছে না পশ্চিমারা।

তবে বিশ্লেষকদের মতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, তবে তা ভিন্ন ধারায়। 

গবেষক হুসেন আলম বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে রাশিয়ার যুদ্ধ কিন্তু আর শুধু ইউক্রেনের বিরুদ্ধে নেই, এই যুদ্ধ ন্যাটোর বিরুদ্ধে, ইউরোপিয় ইউনিয়নের বিরুদ্ধে, পশ্চিমা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে।“ 

একইভাবে রাশিয়া একাই লড়ে যাচ্ছে, বিষয়টি তা নয়, রাশিয়ার আগ্রাসনের পক্ষে রয়েছে উত্তর কোরিয়া এবং চীন। সুতরাং এটি স্পষ্ট, বিশ্বের বেশিরভাগ রাষ্ট্র দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। 

বেলারুশ কেন রাশিয়ার পক্ষে?

পোল্যান্ড, ইউক্রেন এবং রাশিয়া তিন দেশের সঙ্গেই সীমান্ত রয়েছে বেলারুশের। তাহলে পোল্যান্ড এবং ইউক্রেনকে রেখে রাশিয়াকে সমর্থন করছে কেন দেশটি?

এর কারণ যতটুকু জানা যায়, বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকেশেংকো আর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন দুজনে খুব ভালো বন্ধু। আপাতত এই কারণটিই স্পষ্ট। বাকি কারণ থেকে থাকলে তা ক্রমশ প্রকাশ্য। 

রাশিয়া ইউক্রেন দখল করে ফেললে কী হবে?

রাশিয়া ইউক্রেন দখল করে বর্তমান সরকার সরিয়ে আবারও বিতর্কিত ইয়ানুকোভিচকেই চেয়ারে বসাবে বলে ধারণা অনেকের। তবে সেটি হোক কিংবা নাই হোক, ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেললেও রাশিয়ার সমস্যার সমাধান হবে না বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

এসবি/এএইচএস/কেআই