‘ধানের গোলায় লুকিয়ে রাখা হয়েছিল ৭ই মার্চ ভাষণের রেকর্ড’
দোহার-নবাবগঞ্জ (ঢাকা) প্রতিনিধি
প্রকাশিত : ১১:৩৮ এএম, ৭ মার্চ ২০২২ সোমবার
আমজাদ আলী খন্দকার
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের ভিডিও ধারণ যেমন চ্যালেঞ্জিং ছিল, তেমনি পাকিস্তানি জান্তা সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ভাষণটির ফিল্ম ডেভেলপ ও সংরক্ষণ করা ছিল আরও কঠিন। সেদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেই কাজটি করেছিলেন ৮ জনের একটি দল। তাদেরই একজন ফিল্মস ডিভিশনের ক্যামেরাম্যান আমজাদ আলী খন্দকার।
তিনি জানান, থার্টি ফাইভ মিলিমিটারের সেই ভাষণের ফিল্ম লুকিয়ে রাখা হয়েছিল ধানের গোলায়।
বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস বয়ে নেওয়া বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের ভিডিও ধারণ করা হয়েছিল পাকিস্তান সরকারের ক্যামেরায়। অনেকের চোখ ফাঁকি দিয়ে তা ডেভেলপ করার পর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রক্ষা করা হয় পাকিস্তানি হানাদের থাবা থেকে।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরে কর্মরত কয়েকজন মুক্তিকামী বাঙালির বীরত্বে রক্ষা পেয়েছিল বাঙালির ইতিহাসের এই অমূল্য সম্পদ। ভাষণের মাস খানেকের মাথায় সেটা সচিবালয় থেকে লুকিয়ে নেওয়া হয়েছিল ঢাকার দোহারের একটি বাড়িতে। সেখানে ধানের গোলায় লুকিয়ে রাখার পর নিয়ে যাওয়া হয় ভারতে। নয় মাসের যুদ্ধ জয়ের পর ভিডিও টেপটিও ফিরে আসে নতুন বাংলাদেশে।
পাকিস্তানিদের সেনাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে সচিবালয় থেকে ঢাকার দোহারে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের টেপগুলো নিয়েছিলেন আমজাদ আলী খন্দকার, যিনি সে সময় ছিলেন চলচ্চিত্র বিভাগের ক্যামেরা সহকারী। সেই ভাষণের ভিডিও ধারণ এবং সংরক্ষণ করতে গিয়ে জীবনবাজির গল্প শুনিয়েছেন তিনি।
ডিএফপির ক্যামেরা সহকারী থেকে ক্যামেরাম্যান হয়ে ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে যোগ দেন আমজাদ আলী। ২০০৪ সালে বিটিভির কন্ট্রোলার-চিফ ক্যামেরাম্যান হিসাবে অবসরে যান তিনি। কর্মজীবনে বেশ কয়েকবার আহত হওয়া আমজাদের শরীরের বাঁ দিকের অংশ এখন পক্ষাঘাতগ্রস্ত।
আমজাদ আলী খন্দকার জানান, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা ছিল মিছিলের শহর। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে দলে দলে মানুষ পায়ে হেঁটে, বাস-লঞ্চে কিংবা ট্রেনে চেপে রেসকোর্স ময়দানে সমবেত হয়েছিলেন। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে লাখ লাখ মানুষে ভরে উঠেছিল বিশাল ময়দান।
দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে এই জনসমুদ্রের ভিডিও চিত্র ধারণের কাজ করেন চলচ্চিত্র বিভাগের কর্মীরা। এক ভাগের দায়িত্ব মূল ভাষণ আর অন্য ভাগ ধারণ করে সেখানকার সার্বিক পরিবেশ। এই দুই দলে ছিলেন ক্যামেরাম্যান জেড এম এ মবিন, ক্যামেরাম্যান এম এ রউফ, ক্যামেরা সহকারী আমজাদ আলী খন্দকার, ক্যামেরা সহকারী এস এম তৌহিদ, ক্যামেরা সহকারী সৈয়দ মইনুল আহসান, ক্যামেরা সহকারী জোনায়েদ আলী ও এমএলএসএস খলিলুর রহমান।
সেদিনের স্মৃতিচারণ করে খন্দকার আমজাদ বলেন, “পাকিস্তানিদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কীভাবে ফিল্ম ডেভেলপ করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে হচ্ছিল। ধরা পড়তে পারেন সেই শঙ্কায় ট্যাগ লাইনে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সংশ্লিষ্ট কিছু না লিখে কৌশল লেখা হল ‘সাইক্লোন’। যাতে অন্যরা মনে করে ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড় সংশ্লিষ্ট ফিল্ম এগুলো।”
“তখন বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ফিল্ম ডেভেলপ করে নিয়ে আসব, সে ব্যবস্থা আমাদের ছিল না। এটা করা হতো এফডিসি ল্যাবে। বঙ্গবন্ধুর নাম দেখলে এটা নষ্ট করে ফেলবে সেজন্য আমরা কৌশল করে ‘সাইক্লোন’ চিহ্ন দিয়ে এফডিসি থেকে ডেভেলপ করে নিয়ে আসলাম,” বলেন আমজাদ।
২৫ মার্চের পর বিভিন্ন অফিস-আদালতের দায়িত্ব নেওয়া শুরু করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। চলচ্চিত্র বিভাগের মুক্তিকামী কর্মীরা ধারণা করলেন পাকিস্তানি সেনারা যদি হানা দেয় তাহলে এসব ধ্বংস করে দেবে। সে কারণে কীভাবে এগুলো সচিবালয়ের আর্কাইভ থেকে সরানো যায় সেই পরিকল্পনা করলেন বিভাগের প্রধান মহিবুর রহমান। তিনি আমাকে বললেন, ‘আমজাদ তোমাকে একটা দায়িত্ব দেব। এই মুহূর্তে ফিল্মগুলো নিয়ে ঢাকার বাইরে যেতে হবে তোমাকে।’
সেই কথার পর সদরঘাট থেকে ৪২ ইঞ্চি মাপের ট্রাঙ্ক কিনে আনা হয়।
আমজাদ আলী খন্দকার বলেন, “ট্রাঙ্ক আনার পর মহিবুর রহমান নিজে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, কাজী নজরুল ইসলামের উপর করা ডকুমেন্টারি ফিল্ম ও বঙ্গবন্ধুর আরও ছবি ফিল্ম ঢুকিয়ে দেন। সেই সাথে রেকর্ড নিয়ে পালানোর পরিকল্পনা বুঝিয়ে দেন। সচিবালয় থেকে বের হতে হবে কিন্তু বাইরে বিভিন্ন জায়গায় পাকিস্তানি সেনাদের সতর্ক পাহারা ও টহল। সচিবালয়ে ঢোকার সেকেন্ড গেইট দিয়ে বেরোনোর পরিকল্পনা নেয়া হয়। ওই ফটকের দায়িত্বে থাকা বাঙালি পুলিশ সার্জেন্ট ফরিদও ছিলেন সেই পরিকল্পনায়। বেবি ট্যাক্সিতে করে বড় আকারের ট্রাঙ্ক নিয়ে রওনা হলাম। সংকেত পেয়ে ফটক খুলে দেন ফরিদ।”
“দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ৯ এপ্রিল। সচিবালয়ের টিনশেড থেকে ট্রাঙ্ক নিয়ে বের হয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সেনাবাহিনীর সতর্ক প্রহরায় কিছুটা ভীত হলেও লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে থাকলাম। আর্মির জিপ পেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের পাশ ধরে চাঁনখারপুল থেকে চকবাজার হয়ে সোয়ারিঘাটে পৌঁছলাম। এরপর নৌকায় জিনজিরায় গেলাম। ট্রাঙ্ক নিয়ে বাসের ছাদে চড়ে নবাবগঞ্জের বক্সনগরে গেলাম।”
“ঘোড়ার পিঠে ট্রাঙ্ক উঠিয়ে দিয়ে ঘোড়াওয়ালা একদিকে ধরল, আমি একদিকে। এভাবে চার-পাঁচ কিলোমিটার যাওয়ার পর আমরা পায়ে হেঁটে চলে গেলাম জয়পাড়ায় মজিদ দারোগার বাড়িতে। তাদের বাড়িতে ওটা রাখলাম। ওই সময়ে মহিবুর রহমানও পৌঁছে যান সেই এলাকায়। কিন্তু দারোগা বাড়ির অবস্থান থানার কাছাকাছি হওয়ায় সেখান থেকে ট্রাঙ্কটি সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। চরকুশাই গ্রামের উমেদ খাঁর ধানের গোলার ভেতরে লুকায় রাখলাম।”
ধানের গোলায় মাস খানেক রাখার পর মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় ট্রাঙ্কটি ভারতে নিয়ে যান মহিবুর রহমান। বিজয়ের পরপরই দেশে ফিরিয়ে আনা হয় সেই ভিডিও ফুটেজগুলো। সাদাকালো ওই ভিডিও ভাষণ ২০১৬ সালে রঙিন সংস্করণে রূপান্তরিত করা হয়।
ক্যামেরাম্যান হিসাবে ১৯৭৪ সালে পদোন্নতি পেলেও বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আবার বিপদ নেমে আসার কথা জানান আমজাদ। ১৯৭৯ সালে তাকে চক্রান্ত করে ফিফথ গ্রেড থেকে থ্রিতে নামানো হয়।
তিনি বলেন, “তখন আমি আর জয়েন করলাম না। ছুটি নিয়ে রইলাম নয় মাস। এরপর টেলিভিশনে জয়েন করলাম। তবে ২৬ মাসের বেতন পাইনি।’
এএইচ/