ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

৭ ও ৮ মার্চের টুকরো ভাবনা

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

প্রকাশিত : ০৯:৫০ এএম, ৯ মার্চ ২০২২ বুধবার

এবারে ৭ মার্চ উদযাপনের দিক থেকে ভিন্ন একটা মাত্রা পেয়েছে। এবারের আয়োজনে সাড়ম্বর ছিল বরাবরের চেয়ে বেশি। শহরের উঁচু অট্টালিকাগুলো সেজেছিল জাতীয় পতাকার লাল-সবুজে। কারণটাও সঙ্গত। ৭ মার্চ এখন বাংলাদেশের জাতিয় দিবস আর ৭ মার্চের ভাষণটি শুধু যে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ তাই নয়, মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তে ‘জয় বাংলা’ এখন আমাদের জাতীয় স্লোগানও। 

দুই
বয়স পঞ্চাশ পেরুলে বন্ধু-বান্ধবের সংখ্যা বাড়ে আর বাড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নানা গ্রুপে নতুন নতুন বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ। পঞ্চাশোর্ধ্বআমার জীবনেও এটি এখন নতুন এক ফেনোমেনন। এমনি এক গ্রুপে কদিন আগে জনৈক বন্ধু জয় বাংলাকে জাতীয় স্লোগান হিসেবে ঘোষণার গেজেট নোটিফিকেশনটি শেয়ার করেছেন। তাই দেখে আরেক বন্ধুর মন্তব্য, ‘মনে হচ্ছে হীরক রাজার দেশে আছি’। 

স্বাধীন বাংলাদেশে পঞ্চাশ বছর পরেও এমন মন্তব্য করার মানুষ আছে দেখে প্রথমে কিছুটা বিস্ময় মাখানো বিবমিষাবোধ জাগ্রত হলেও পরে ধাতস্থ হয়েছি দ্রুতই। হাজার হোক আমারাইতো সম্ভবত পৃথিবীতে একমাত্র দেশ যেখানে রাজনীতির মাঠে স্বাধীনতার পক্ষের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তিও থাকে। পৃথিবীর যেকোনো দেশেই অনেক রাজনৈতিক দল থাকতে পারে, কিন্তু তারা কেউই আর যাই হোক দেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে আপস করে না। অথচ এই অভাগা দেশে তাই চলে।

তিন
দেশের স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তির ঝাণ্ডাবাহী একটি রাজনৈতিক দল এবারের ৭ মার্চ দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত তাদের নেত্রীর কারাবরণ দিবস পালন করেছে। গত বছর তারা অবশ্য ৭ মার্চ উদযাপন করেছিল। তখন ভিড়মি খাওয়ার যোগাড় হলেও এবার আমার তেমনটি হয়নি। বরং তারা তাদের আদর্শিক জায়গায় ফিরে এসেছে দেখে স্বস্তি পেয়েছি। 

চার
একটি জাতীয় দৈনিকের ৮ মার্চের সংখ্যায় প্রথম পাতার লিড নিউজটি দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত। তবে সেই খবরের পেটের মধ্যে ছাপানো ছবিটা দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ৭ মার্চ পরিবেশবাদী একটি সংগঠন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের লেকে কাগজের নৌকা ভাসিয়ে দিবসটি উদযাপন করেছেন। উদ্যোগটি এতটাই দৃষ্টি কেড়েছে যে দ্রব্যমূল্য সংক্রান্ত খবরের মধ্যেই তাদের সেই ছবিটি পত্রিকাটির পাতায় জায়গা করে নিয়েছে। ইদানিং যখন ইমেইল আসে, তখন প্রায়ই মেইলের শেষে অনুরোধ থাকে পরিবেশ সংরক্ষণের স্বার্থে মেইলটির প্রিন্ট আউট না নেয়ার জন্য। কারণ শেষমেষ ওই গাছ কেটেই কাগজ বানানো হয় পরিবেশের বারোটা বাজিয়ে। পরিবেশেবাদীদের অমন ৭ মার্চ উদযাপনে তাই কিছুটা হলেও অবাক না হয়ে পারিনি। 

পাঁচ
৭ মার্চ সন্ধ্যায় তুরস্কের আঙ্কারায় অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের উদ্যোগে আয়োজিত একটি ওয়েবিনারে আলোচক হিসেবে সংযুক্ত ছিলাম। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধিকাংশ কর্মকর্তাই ক্যারিয়ার ডিপ্লমেট। আবেগ অনুভূতির ঊর্ধ্বে উঠে বিদেশের মাটিতে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য তাদের বিশেষভাবে তৈরি করা হয়। তাদের ৭ মার্চ উদযাপনেও আবেগের চেয়ে আনুষ্ঠানিকতার প্রাধান্যই তাই আমার কাছে প্রত্যাশিত ছিল। তবে অভিজ্ঞতাটা হলো ঠিক বিপরীত। আনুষ্ঠানিকতার চাপে চিড়েচ্যাপ্টা হয়নি আবেগ, বরং পুরো অনুষ্ঠান জুড়েই ছিল বাঙালিয়ানা আর বাঙালিত্বের ছোঁয়া, মান্যবর রাষ্ট্রদুত জনাব মসুদ মান্নানের স্বকন্ঠে ৭ মার্চ নিয়ে লেখা কবিতার আবৃত্তি, যা অন্য মার্গে উন্নীত হয়েছিল।

ছয়
এবারের ৭ মার্চের টুকরো টুকরো কিছু অভিজ্ঞতা নিয়ে এই লেখার উদ্দেশ্য একটাই- এটাই বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশটা কারো কাছে ‘হীরক রাজার বাংলাদেশ’ তো কারো কাছে ‘অপরাধীর অভয়াশ্রমের বাংলাদেশ’। অন্যদিকে আরো কিছু মানুষ আছেন যারা তাদের সবটুকু আবেগ দিয়ে ধারণ করেন ৭ মার্চ আর বঙ্গবন্ধুকে। একান্নতম ৭ মার্চে আমরা এগয়েছি অনেক দূর। নিশ্চিত হয়েছে আমাদের রাজনৈতিক মুক্তি। আমরা এগিয়ে চলেছি ঠিকঠাকমতই আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের পথেও। আর মুক্তির যেটুকু বাকি আছে, আমার ধারণা সেটুকুও অর্জন হয়ে যাবে যদি আমরা সবাই মিলে এই দেশটাকে এখনও যারা ‘হীরক রাজার দেশ’ হিসেবে দেখতে ভালোবাসে সেই কুলাঙ্গারগুলোকে ঝেঁটিয়ে বঙ্গোপসাগরে ডুবিয়ে দিতে ওই আবেগী মানুষগুলোর হাতকে শক্তিশালী করতে পারি।
লেখক: বিভাগীয় প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
 এসএ/