দু’হাত ভরেই পেলেন আইপিএল বঞ্চিত তাসকিন!
নাজমুশ শাহাদাৎ
প্রকাশিত : ০৮:২১ পিএম, ২৪ মার্চ ২০২২ বৃহস্পতিবার
ম্যাচ ও সিরিজ সেরার ট্রফি হাতে তাসকিন আহমেদ।
ক্রিকেটটা তেমন একটা অনুসরণ করেন না, এমন যে কারোরই চমকে ওঠার কথা! প্রায় সব জাতীয় পত্রিকার প্রথম পাতায় বিশাল করে প্রধান খবর- ‘বাংলাদেশের দক্ষিণ আফ্রিকা জয়’ বা সিরিজ জয়ের কথা।
সিরিজ জিতলে প্রথম পাতায় খবর প্রকাশ হয়। তাই বলে এতো বিরাট বিরাট ছবি, এতো বড় বড় লেখা! একটু যেন সন্দেহ তৈরি হয়, আসলেই কী দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে তাদের বিপক্ষে সিরিজ জয়, এতো বড় ঘটনা? আসলেই কী এটা বাংলাদেশের এ যাবৎকালের সেরা ক্রিকেটীয় অর্জন!
জবাবটা অবশ্যই হ্যাঁ, যার পুরোটাই এসেছে একজনের হাত ধরে। আর তিনি হলেন প্রত্যাবর্তনের মহানায়ক পেসার তাসকিন আহমেদ। প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না! আমি বলব- মোটেও না। তার কারণটাও জানাব।
দুর্দান্ত গতিতে বল করতে পারতেন শুরু থেকেই, বল হাতে কারিকুরি করার ক্ষমতাও ছিল। আর এসবের সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে আগের চেয়ে অনেক পরিণত ক্রিকেট-মস্তিষ্ক। সব মিলিয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের পেস বোলিংয়ের বড় এক অস্ত্র।
বলছি প্রত্যাবর্তনের মহাকাব্য লেখা বাংলাদেশি ফাস্ট বোলার তাসকিন আহমেদের কথা। এশিয়ার স্লো উইকেটে মুস্তাফিজুর রহমান হয়তো পেস বোলিংয়ের নেতা, তবে দেশের বাইরে বিশেষ করে, SENA (দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া) কন্ডিশনের গতিময় উইকেটে সেই স্বীকৃতিটা পাওয়ার ক্ষেত্রে তাসকিনই থাকবেন সবার আগে।
গতি দিয়ে যে কোনো ব্যাটারকে ভড়কে দেয়া, বলের মুভমেন্টে অস্বস্তিতে ফেলা, ড্রেসিংরুমে বা গ্যালারিতে ‘এই বুঝি কিছু ঘটে গেল’ -এমনই চাপা উত্তেজনা সৃষ্টি; সবকিছুতেই এখন পটু হয়ে উঠেছেন সেই বোকাসোকা তাসকিন। শুরুর তাসকিনেও এগুলো ছিল, তবে এখন তাতে মাথা খাটানোটাও যোগ হয়েছে।
তাসকিন এখন তাই পরিপূর্ণ এক ফাস্ট বোলার। কন্ডিশন কিংবা পরিসংখ্যানকে পাশে রেখে এখন যাকে নিয়ে ভাবতে হয় প্রতিপক্ষকে।
ক্রিকেট-মস্তিষ্কটা যে পরিণত হয়েছে, ম্যাচ পরিস্থিতি বুঝে সে অনুযায়ী বল করতে পারার ক্ষমতা, যা তার মধ্যে জন্মাচ্ছে -তার প্রমাণ প্রত্যাবর্তনের শুরু থেকেই দেখাচ্ছেন তাসকিন। তবে আরো স্পষ্টভাবে, রীতিমতো দর্শকদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজের পারফরম্যান্স দিয়েই বুঝিয়ে দিলেন- তিনি প্রস্তুত বাংলার ফাস্ট বোলিং জাহাজের ক্যাপ্টেন হওয়ার জন্য।
সিরিজের প্রথম ম্যাচে ৩৬ রানে ৩ উইকেট; তবে সাকিব, লিটন, ইয়াসির, মিরাজদের ভিড়ে একটু যেন পিছিয়েই ছিলেন তাসকিন। তবে যার রক্তে মিশে আছে ঘুরে দাঁড়ানোর তান, তাকে দমিয়ে রাখবে কে! সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ব্যাটারদের ভুলে লড়াইয়ের পুঁজি না পেলেও তৃতীয় ওয়ানডেতে দেখিয়ে দিলেন নিজের সামর্থ্য। সব আলো কেড়ে নিলেন একাই। ৯ ওভার হাত ঘুরিয়ে ৩৫ রান খরচায় একে একে তুলে নিলেন পাঁচ-পাঁচটি উইকেট। ভেঙ্গে দিলেন প্রোটিয়া ব্যাটিংয়ের মেরুদন্ড, গুড়িয়ে দিলেন স্বাগতিকদের।
শুধু সংখ্যায় নয়, নিয়ন্ত্রিত লাইন-লেন্থ আর বাউন্সারে ব্যাটারদের জন্য যেন যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি করেছিলেন। প্রতিটা বল গোলার মত ছুড়ে দিচ্ছিলেন প্রোটিয়া ব্যাটারদের দিকে। পাঁচজনের মধ্যে চারজনকেই উইকেটের পিছনে মুশফিকের গ্লাভসে বন্দী করেন তাসকিন।
তবে শুরুটা ছিল কাইল ভেরেইন্নেকে বোল্ড করার মধ্য দিয়ে। তাসকিন একাই সেঞ্চুরিয়নে তৈরি করে দেন বাংলাদেশের সিরিজ জয়ের মঞ্চ। যার সুন্দর সমাপ্তি টানেন তামিম-লিটন-সাকিবরা। তবে সেরাদের সেরা হয়ে পুরস্কারে নিজের দুহাত ভরেন আইপিএলে আমন্ত্রণ পেয়েও যেতে না পারা এই টাইগার পেসার।
বল হাতে লাইন-লেন্থ, গতি ছাড়াও আগ্রাসন, উদযাপন; সবমিলিয়ে তাসকিন ছিলেন পারফেক্ট ফাস্ট বোলার। একজন এশিয়ার বোলার হয়ে SENA কন্ডিশনে এতটা দাপট দেখাবে, বিশেষ করে বাংলাদেশি কেউ- তা হয়তো কল্পনায়ও ছিল না কারোই। তবে সেই অকল্পনীয় ব্যাপারটাই সত্যি করে দেখালেন ২৭ বছরের এই পেসার।
এর আগের ফাইফারটি পেয়েছিলেন ২০১৪ সালে; ওয়ানডে অভিষেকে। দুর্দান্ত বোলিংয়ে সেদিন ওয়ানডে ক্যারিয়ার শুরু করা তাসকিন এরপর মাশরাফির সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সামলেছিলেন বাংলাদেশের পেস আক্রমণের দায়িত্ব।
২০১৫ বিশ্বকাপে দলের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী হয়ে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন কাণ্ডারী হওয়ার। ভারত সিরিজেই মোস্তাফিজের আবির্ভাবের পর যদিও দুজনের জুটিকে ঘিরে স্বপ্ন দেখা হয় দুর্দান্ত কিছুর। তবে একদিকে মুস্তাফিজ যত এগিয়েছেন, ব্যস্তানুপাতে পিছিয়ে পড়েন তাসকিন।
দেশের গণ্ডি ছাপিয়ে মুস্তাফিজ যখন ক্রিকেটের বিরলতম বোলারদের একজন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন, সেখানে তাসকিন জাতীয় দল থেকেই হারিয়ে যান। ২০১৮ সালের পর টানা ৩৪ মাস দর্শক হয়েই দলের খেলা দেখতে হয়েছে তাসকিনকে। এতে দুর্ভাগ্যেরও ভূমিকা ছিল অবশ্য।
ওয়ানডে বিশ্বকাপে তার সুযোগ না পাওয়ায় ভূমিকা রেখেছে নির্বাচকদের দূরদর্শিতার অভাব। ঘরোয়া ক্রিকেটে দুর্দান্ত ফর্মে ফিরে যখন ডাক পেয়েছেন, তারপরই চোটে পড়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে তাসকিনের ক্ষেত্রে।
এদিকে, গত দশ বছর দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে সফরকারী পেসারদের মধ্যে ওয়ানডেতে একমাত্র তাসকিন আহমেদই এক ম্যাচে শিকার করেন পাঁচ উইকেট। সেই ২০১৪ সালের ফাইফার আর এই ২০২২-এর; মাঝখানে কত কি হলো। অফ ফর্ম, ইনজুরি আবার বোলিং অ্যাকশন নিষিদ্ধ; হয়তো ক্রিকেট বিধাতা সে সময় তাসকিনের ওপর নিজের সমস্ত রাগ ঢেলেছিলেন।
বারবার পুড়ে যেমন খাঁটি হয়ে উঠা যায় তেমন তাসকিনও নিজেকে পুড়িয়ে অবশেষে খাদহীন হয়ে নিয়েছেন। ফিটনেসে ব্যাপক উন্নতি আর পারফরম্যান্স দেখিয়েই ফিরেছেন জাতীয় দলে। নবাগত শরিফুল আর মুস্তাফিজের সঙ্গে মিলে তৈরি করেছেন লাল-সবুজের পেস আক্রমণ। কিউই পাখির দেশে প্রথম টেস্ট জয় কিংবা আফ্রিকার মাটিতে প্রথম ওয়ানডেতে জয়- সামনে থেকেই অবদান রেখেছেন এই ফাস্ট বোলার।
দলের সিরিজ জয় ও নিজে সেরা হতে পেরে খুশি ও গর্বিত তাসকিন। ম্যাচ শেষে তাই বলেন, ‘আমি খুব খুশি ও গর্বিত অনুভব করছি। কারণ দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম আমরা সিরিজ জিতলাম। এই প্রথম আমি আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ম্যান অব দ্য সিরিজ হলাম। আমি খুব গর্বিত ও খুশি।’
দক্ষিণ আফ্রিকার পেস সহায়ক উইকেটে বল করতে পেরে অনেক খুশি তাসকিন বলেন, ‘আমি অনেক উপভোগ করেছি। যখন সিরিজ খেলতে এসেছি, তখন থেকে নিজের লেন্থ নিয়ে কাজ করেছি। প্রসেস মেনে চলেছি, সিম্পল ও বেসিক। এটা দারুণ ব্যাপার। আমার এখনও শিখতে হবে ফ্ল্যাট ও স্লো উইকেটে কিভাবে পাঁচ উইকেট নিতে হয়। এটাই আমার পরবর্তী লক্ষ্য।’
দলের অধিনায়ক তামিম ইকবাল অনেক বেশি সাপোর্ট দিয়েছেন বলে জানান তাসকিন। তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক ম্যাচেই অধিনায়ক আমাকে সাপোর্ট করেন এবং আমাকে পরিষ্কার ভূমিকাও দেন। আমাকে বলেন, গতিময় বোলিং করতে, আগ্রাসী থেকে উইকেট এনে দিতে। আমি তা অনুসরণ করেছি।’
ওয়ানডে ক্যারিয়ারের প্রথম ম্যাচেই পাঁচ উইকেট নিলেও, দলকে জেতাতে পারেননি তাসকিন। তবে নিজের দ্বিতীয় পাঁচ উইকেট প্রাপ্তিকে করে রাখলেন অবিস্মরণীয়, জয় পেল বাংলাদেশ। সেইসঙ্গে ইতিহাস গড়ে প্রোটিয়াভূমে প্রথমবারের মতো জিতল সিরিজও।
ম্যাচের সেরা তো বটেই, ৮ উইকেট নিয়ে হলেন সিরিজেরও সেরা খেলোয়াড়। সেইসঙ্গে বোর্ড থেকেও পাবেন মোটা অঙ্কের অর্থও। অর্থাৎ দু’হাত ভরে পেলেন আইপিএল বঞ্চিত তাসকিন। ৪৮ ওয়ানডেতে ৬৭ উইকেট নেয়া পেসারের স্বপ্ন ও আশা কেবলই এগিয়ে যাওয়ার।
এনএস//