ঢাকা, শনিবার   ০২ নভেম্বর ২০২৪,   কার্তিক ১৮ ১৪৩১

‘হানাদার বাহিনী নয়, হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে পাকিস্তান’

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০১:৫৬ পিএম, ২৬ মার্চ ২০২২ শনিবার | আপডেট: ০২:১৩ পিএম, ২৬ মার্চ ২০২২ শনিবার

মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই বাংলাদেশে সক্রিয় রয়েছে দাবি করে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও লেখক কর্নেল (অব.) তৌফিকুর রহমান বলেছেন, সাংগঠনিকভাবে এদেরকে মোকাবেলা করতে না পারলে নতুন প্রজন্ম কিছুই জানতে পারবে না। 

জাতীয় প্রেস ক্লাবে শুক্রবার এক আলোচনা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে তিনি একাত্তর সালের ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর চালানো গণ্যহত্যার ভয়াবহ স্মৃতি তুলে ধরেন।
সম্প্রীতি বাংলাদেশ আয়োজিত আলোচনায় প্রধান অতিথি ছিলেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন।
২৫ মার্চের পাকিস্তানি বাহিনীর নারকীয় হত্যাযজ্ঞ দেখে ভয় পাওয়ার কথা উল্লেখ করে বীর মুক্তিযোদ্ধা তৌফিকুর রহমান বলেন, “আগেরকার দিনে যদি কেউ ভয় পেত শরতায় করে লবণ খাওয়াতো বাপ-মা। আম্মা তাড়াতাড়ি শরতায় করে লবণ নিয়ে আসলেন, বললেন লবণ খাও। কারণ, আমি তো কাঁপছিলাম। তারপরে আমরা ঘরের মধ্যে থাকলাম। তবে আমার মধ্যে শুধু ওই দৃশ্য ভেসে উঠতে থাকে। ছেলেগুলো পড়ে আছে, কোথায় তার বাপ, কোথায় তার মা। এদের কে কবর দিবে? কি অবস্থায় তারা মারা গেছে, কত কষ্ট পেয়ে তারা মারা গেছে। 

“মাথার মধ্যে আরও খেলতে থাকে- আমি তো শুনেছি, পাকিস্তান আর্মি আমাদের দেশ রক্ষা করবে। এরা তো আমাদের টাকা দিয়ে চলে, তো আমাদের হত্যা করবে কেন? যত দোষ হোক না কেন সেটা অন্যভাবে করতে পারে। মানুষ মানুষকে মারতে পারে- এটা তো যুদ্ধক্ষেত্র না। আর পাকিস্তান মিলিটারি যদি হত্যা করেও থাকে, তাহলে এদের তো বিচার হওয়া দরকার। বিচারের কোনো কথাই নাই, যে যত মারছে তাদের তত পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে বলে আমার মনে হচ্ছিল।”

সেদিনের স্মৃতি রোমন্থন করে তৌফিকুর রহমান বলেন, “ঠিক সন্ধ্যার সময় একটা আওয়াজ পেলাম। মনে হল কিছু একটা হচ্ছে। পরে দেখি চাঁনখার মোরে কামানের মত কি যেন একটা পাকিস্তান আর্মি এনেছে। সেটা বসাতে দেখে আমি তাড়াতাড়ি চলে আসি। পরে জানতে পারি ওটা আরআর ছিল। আরআর হল রিকয়েললেস রাইফেল, যেটা স্ট্রেট ফায়ার করতে পারে। এটা দিয়ে ফায়ার শুরু করল শহীদুল্লাহ হলে। প্রথম ফায়ারটা যখন করল তখন বিকট আওয়াজ হলো। 

“হলের পেছনে ছিল আমাদের বাসা। ওই আওয়াজে বাসার ছিটকিনি আটকানো দরজা ধাম করে খুলে গেল। তখন আমরা সবাই দোয়া-দরুদ পড়ছি। আব্বা-আম্মা বললেন সবাই জোরে জোরে দোয়া-দরুদ পড়তে থাক। আমরা যে যতটুকু পারি পড়ছিলাম। দরজা খুলে গেলে আমরা ভয়ে কাঁপতে ছিলাম। তখন আস্তে আস্তে ক্রল করে করে আব্বা-আম্মা দু’জনে দরজাটা বন্ধ করলেন। তখন আটা-চালের বস্তা, পানির ড্রাম দিয়ে বন্ধ করে দিলেন।”

তিনি বলেন, “সবচেয়ে কষ্টকর জিনিস আমি এখনও ভুলতে পারি নাই। রেলওয়ের লাইনের পাশের বস্তিতে কি যেন একটা মারল, হঠাৎ দেখি আগুন। পরে জানতে পারলাম ওটা ছিল ফসফরাস গ্রেনেড, যেটা মারলে আগুন ধরে যায়। দুঃখজনক হলেও সত্যি, এই গরীব লোকগুলো কাঁদতে থাকল, দোষ- এরা বাঙালি। এরা যখন বের হতে থাকল, পালাতে থাকল তখন পাখির মত গুলি করে মারা হলো। আমি জানি না এটা মানুষ পারে কিনা। আমি এখনও পর্যন্ত এরকম দেখিনি।

সেদিনের ১৫ বছরের কিশোর তৌফিকুর রহমান বলেন, “আজকে কেউ বলে হানাদার বাহিনী, তবে আমি শুরু থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ছাড়া কিছু বলি নাই। এই হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে পাকিস্তান। গুলি করে মারার পর কিছু লাশ আগুনে পোড়াল। আগুনে পোড়া লাশের একটা গন্ধ হয়, এই গন্ধটা আমার নাকে আসলো। এরপরে আমি ভাত খেতে পারতাম না, খেতে গেলে বমি আসে। ঘুমাতে পারতাম না, চোখের সামনে ওই লাশগুলো ভেসে উঠত। 

“তখন আমি চিন্তা করলাম এইভাবে বেঁচে থেকে লাভ কি? আমরা কুকুর থেকেও অধম। আমাদেরকে মারছে আমাদের দেশের সেনাবাহিনী। আমাদের টাকা দিয়ে যাদের ভরণ-পোষণ, অস্ত্র কেনা হয়। এসব মানুষের দোষ কি? কোন সব অস্ত্র ব্যবহার করছে এসব মানুষগুলোকে মারার জন্য, যে অস্ত্রগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। এগুলো দেখে সহ্য করতে পারি না বলে আমি মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করি। ১৪ জুন দেশ ছেড়ে আগরতলায় চলে যাই। সেখানে চার সপ্তাহ প্রশিক্ষণ নিই খালেদ মোশাররফের অধীনে। তারপর থেকেই আমি একনাগারে যুদ্ধ করেছি।বাড়িতে ফিরেছি ১৬ ডিসেম্বর।” 

একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বরের একটি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, “টাঙ্গাইল হয়ে কাশিপুর দিয়ে পাকিস্তান আর্মি ঢাকার দিয়ে আসছিল। গ্রামবাসী আমাদেরকে এই খবর জানায়। আমরা তখন অ্যাম্বুস করি। দুজনের মধ্যে একজন হল পাঠান। পাঠান সোলজারটা বলল, আমাদেরকে বলা হয়েছে ইন্ডিয়ার সাথে যুদ্ধ হচ্ছে। আরেকজন পাঞ্জাবি শেখ। সে মুখ বন্ধ করে আছে, তার পায়ে গুলি লেগেছে। তার পা দেখি ফোলা। ব্লিডিং বন্ধ করার জন্য ইনজেকশন আমার কাছে ছিল, ওটা যখন পুশ করতে যাব তখন গ্রামবাসী বললো পকেটে কি ওনার? পকেটে হাত দিয়ে দেখি, দুই পকেটভর্তি ঘড়ি। টাঙ্গাইলে নিশ্চয়ই কোনো দোকান লুট করেছে। তখন গ্রামবাসী তার কোনো চিকিৎসা করতে দেয়নি, রশি দিয়ে বেঁধে নিয়ে গেছে।”

যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে বাঙালি ২৫ মার্চের গণহত্যার প্রতিশোধ নিতে পারলেও নতুন প্রজন্ম সঠিক পথে নেই বলে মনে করেন তৌফিকুর রহমান। 

“তিনদিন আগে আমি ফেসবুকে একটা জিনিস লেখেছিলাম যে, পাকিস্তান আর্মি আমাদের এত লোক হত্যা করেছে, তো ওদের দেশে না যাওয়াই উচিত। একজন কমেন্ট করেছেন, তৌফিক সাহেব আপনি বোধহয় ভুল বলছেন, এগুলো সব মিথ্যা কথা, এগুলো ফেক। বড় কষ্ট লাগে।

“একাত্তরের ডিসেম্বরের পরের দিন থেকেই খুব অ্যাকটিভ আইএসআই। আমরা বসে বসে ঘুমিয়েছি, ৫ থেকে ১০ বছর। টু লেট, এখন অর্গানাইজ ওয়েতে যদি এখন এদেরকে ট্যাকেল না করি, নতুন প্রজন্ম কিছুই জানবে না। যদি গ্রামে যান, কয়টা পাবেন স্কুল-কলেজ, তার থেকে অনেক বেশি মাদ্রাসা। এসব ইনস্টিটিউশনে ফ্ল্যাগ ওড়ায় কিনা আমার সন্দেহ আছে। জাতীয় সঙ্গীত গায় কিনা সন্দেহ আছে। যেখানে সংখ্যায় তারা বেশি, দিন দিন তারাই তো আস্তে আস্তে বেড়ে উঠবে। আমি জানি না ভবিষ্যৎ কী? কিন্তু অর্গানাইজ ওয়েতে যদি না করা হয়, আমি খুবই শঙ্কিত।”

সম্প্রীতি বাংলাদেশের সদস্য সচিব মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীলের সঞ্চালনায় এবং আহ্বায়ক পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভপতিত্বে আলোচনা অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সাজ্জাদ আলী জহির বীরপ্রতীক, সংসদ সদস্য ও শহীদ পরিবারের সদস্য আরমা দত্ত এবং শহীদ সন্তান নট কিশোর আদিত্য।

এএইচএস