কে এই নতুন প্রধানমন্ত্রী শহবাজ শরিফ
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৭:৪৯ পিএম, ১১ এপ্রিল ২০২২ সোমবার
এক সফল অনাস্থা প্রস্তাবে ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর সাবেক বিরোধী দলীয় নেতা পিএমএল-এন'য়ের প্রধান শাহবাজ শরিফ এখন পার্লামেন্ট নেতা এবং নয়া প্রধানমন্ত্রী।
মনে রাখা প্রয়োজন, শাহবাজ শরিফ যদিও গত সাড়ে তিন বছর ধরে বিরোধী দলের নেতা, তারপরও পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে তাকে একজন নবাগত হিসেবেই মনে করা হয়।
পাঞ্জাব প্রদেশের স্থানীয় রাজনীতির একজন নেতা হিসেবেই তার পরিচয় বেশি উজ্জ্বল। তিন মেয়াদে ১৩ বছর ধরে প্রদেশটির মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন শরিফ। ওই তের বছরে অনেকবারই আবেগপ্রবণ আচরণ ও ভিন্ন ধারার কাজের কারণে তিনি মিডিয়া ও বিরোধীদের আলোচনার কেন্দ্রে এসেছেন।
কখনো তাকে দেখা গেছে নৌকায় চড়ে বন্যা উপদ্রুত অঞ্চলে যেতে। কখনোবা তার সরকার সরকারি প্রতিষ্ঠানেই চালিয়েছে 'আকস্মিক অভিযান'। এসব ঘটনায় বিরোধীদের প্রতিক্রিয়া হতো - 'এ সবই লোক দেখানো কাজ, নইলে মিডিয়া কেন তার সঙ্গে থাকবে'?
যাইহোক সরকারি কর্মকর্তা ও সাংবাদিকদের যারা তাকে চেনেন, তারা মনে করেন তিনি একজন 'পরিশ্রমী নেতা'। পাঞ্জাবে বেশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্প তিনি নিয়েছেন। তাকে ওই প্রদেশে দেখা হয় একজন 'কঠোর প্রশাসক' হিসেবে।
তিনি কীভাবে বিখ্যাত হয়ে উঠলেন? মুখ্যমন্ত্রী থেকে কী করে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ার পর্যন্ত পৌঁছালেন?
ব্যবসায়ী থেকে রাজনীতিবিদ
লেখাপড়া শেষে পারিবারিক ব্যবসার হাল ধরেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের এই ছোট ভাই। লাহোরের একজন সিনিয়র সাংবাদিক সালমান গনি বহুদিন ধরে শরিফ পরিবার ও তাদের দল নিয়ে রিপোর্টিং করছেন।
বিবিসিকে তিনি বলেন, ১৯৮৫ সালে লাহোর চেম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট হন শাহবাজ শরিফ।
গনির বক্তব্য, শাহবাজ শরিফ তার ভাই নওয়াজ শরিফ এবং দলের রাজনীতির প্রচারে কাজ করেছেন। তিনি কঠোর পরিশ্রম করেছেন। প্রথম থেকেই তার পরিবারের কাছে নিজেকে পরিশ্রমী এবং দক্ষ প্রশাসক হিসেবে তুলে ধরেছেন তিনি। ব্যবসায় সাফল্যের পর তিনি রাজনীতিতে যোগ দেয়ার মনস্থ করেন।
উনিশশো আটাশি সালে নির্বাচনে জিতে তিনি প্রথমবারের মত পাঞ্জাব অ্যাসেম্বলির একজন সদস্য হন। উনিশশো নব্বই ও তিরানব্বই সালেও তিনি পুনঃনির্বাচিত হন। তিরানব্বই সালেই প্রাদেশিক পরিষদের বিরোধী দলীয় নেতা নির্বাচিত হন শরিফ।
'তিনি প্রধানমন্ত্রী হলেই ভাল করতেন'
পরের সাধারণ নির্বাচনে পিএমএল-এন জেতার পর ১৯৯৭ সালে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী হন শাহবাজ শরিফ। ওই সময়ের রাজনীতির সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল একজন সাংবাদিক ও বিশ্লেষক মুজিব-উর-রহমান শামি। বিবিসিকে তিনি বলেন, "তিনি (শাহবাজ শরিফ) পাঞ্জাবে একটি ভাল টিম গঠন করেছিলেন"।
শরিফ বেশ কিছু প্রকল্প নিয়ে কাজ করছিলেন পাঞ্জাবে, কিন্তু তার সরকারের অকাল-পতন ঘটে যখন ১৯৯৯ সালে সামরিক আইন জারি করে জেনারেল পারভেজ মুশাররফ ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ ও শাহবাজ শরিফকে গ্রেপ্তার করেন।
ওই সময়ের ঘটনাপ্রবাহে শাহবাজ শরিফের কোন হাত ছিল না, বলছেন সাংবাদিক মুজিব-উর-রহমান শামি। ‘তার সবসময়ের দৃষ্টিভঙ্গিই ছিল সামরিক প্রতিষ্ঠানসহ সকলেরই একযোগে কাজ করা উচিৎ।’
মুজিব-উর-রহমান শামি বলছেন, "কোন এক জায়গায় পারভেজ মুশাররফ একবার এও বলেছিলেন যে, তিনি (শাহবাজ শরিফ) প্রধানমন্ত্রী হলেই ভাল করতেন"।
মুশাররফের সাথে চুক্তি ও নির্বাসন
দুই হাজার সালে শরিফ পরিবার সেনাশাসক পারভেজ মুশাররফের সাথে এক চুক্তি করার অভিযোগে ফেঁসে যায়। এর ফলে এক পর্যায়ে শাহবাজ শরিফ দেশ ছেড়ে সৌদি আরবে পাড়ি জমাতে বাধ্য হন।
শরিফ পরিবার অবশ্য বরাবরই এই চুক্তির অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছে। মুজিব-উর-রহমান শামির বর্ণনায়, নওয়াজ শরিফ ও অন্যান্য নেতাদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা হয়েছিল, তার কোনটিতেই শাহবাজ শরিফের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হয়নি।
"তিনি কোনভাবেই দেশত্যাগ করতে চাননি। বরং দেশত্যাগ ঠেকাতে জোর চেষ্টা করেছিলেন"।
সাংবাদিক সালমান গনি বলছেন, শাহবাজ শরিফ জেলে বসে বড় ভাই নওয়াজ শরিফকে বেশ কটি চিঠি লিখেছিলেন।
ওই সব চিঠিতে তিনি বড় ভাইকে পরামর্শ দিতেন, "আমাদের প্রতিষ্ঠানের সাথে দ্বন্দ্বে জড়ানো উচিৎ নয়"। সালমান গনি বলছেন, এসব চিঠির কয়েকটি তার হাতে রয়েছে।
গনির বর্ণনায়, জেনারেল মুশাররফের সাথে চুক্তির অভিযোগ দেশ ত্যাগ করতে হবে ভেবে বিষণ্ণ ছিলেন শাহবাজ শরিফ।
গনি বলছেন, সৌদি আরব থেকে বেশ ক'বার দেশে ফেরার চেষ্টা করেছেন তিনি।
পরে পাঞ্জাবের সাবেক গভর্নর চৌধুরী সারওয়ারের মধ্যস্থতায় দু-ভাই সৌদি আরব থেকে লন্ডন যান।
মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ার নিয়ে টানাহেঁচড়া
সাত বছর পর ২০০৭ সালে শরিফ পরিবার যখন পাকিস্তানে ফিরে আসতে সক্ষম হয় তার পরের বছরটিতে ছিল পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন। শাহবাজ শরিফ অবশ্য কোন পর্যায়ের নির্বাচনেই যোগ দিতে পারেননি তখন।
তার বিরুদ্ধে ১৯৯৮ সালের একটি এফআইআর ছিল যেখানে লাহোরের সাবজাজার এলাকায় একটি বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ আছে।
ওই এফআইআর-এ অভিযোগ ছিল, শরিফ পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে পুলিশকে একটি এনকাউন্টারের নির্দেশ দেন।
শাহবাজ শরিফের অনুপস্থিতিতে ২০০৩ সালে পাকিস্তানের সন্ত্রাসবিরোধী আদালত তার বিরুদ্ধে নোটিশ ইস্যু করে।
দুই হাজার চার সালে শাহবাজ শরিফ যখন আদালতে হাজির হওয়ার জন্য পাকিস্তানে ফিরে আসার চেষ্টা চালান তখন বিমানবন্দর থেকে তাকে ফেরৎ পাঠানো হয়।
দুই হাজার সাত সালে পাকিস্তানে ফিরে ওই মামলায় জামিন নেয়ার চেষ্টা করেন শরিফ, কিন্তু সাধারণ নির্বাচনের আগ পর্যন্ত তিনি খালাস পাননি। ফলে তাকে উপনির্বাচনে অংশ নিতে হয়। তিনি পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে পুনঃনির্বাচিত হন।
কিন্তু ওই বছরই সুপ্রিম কোর্ট তাকে অযোগ্য ঘোষণা করেন। উচ্চতর বেঞ্চে এই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেন শাহবাজ শরিফ। দুই মাস পর আদালত তার পক্ষে রায় দেয় এবং তিনি মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ার ফেরৎ পান।
'চীনারা তাকে পছন্দ করে, তিনি চীনাদের পছন্দ করেন'
দুই হাজার তের সালের ভোটে জিতে টানা দ্বিতীয়বারের মত পাঞ্জাব প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হন শাহবাজ শরিফ। মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করার সময়েই তিনি 'কঠোর প্রশাসক' হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
সাংবাদিক সালমান গনি বিবিসিকে বলেন, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে "শাহবাজ শরিফের রুটিন ছিল প্রতিদিন ভোর ছটায় ঘুম থেকে ওঠা। সব দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের ওপর নির্দেশ ছিল ওই সময়েই অফিসে যাওয়ার"।
"আমার মনে আছে, তখন ডেঙ্গুবিরোধী অভিযান চলছিল এবং সব ডাক্তারদের উপর নির্দেশ ছিল ছটার মধ্যে কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার। কারোরই দেরি করার কিংবা গরহাজির থাকার জো ছিল না। আর শাহবাজ শরিফ কাজ করতেন গভীর রাত পর্যন্ত"।
সাংবাদিক মুজিব-উর-রহমান শামির বর্ণনায়, শাহবাজ শরিফ নিজের জন্য পাঁচ বছরের একটি লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিলেন। এর মধ্যে ছিল দেশের বিদ্যুতের ঘাটতি দূর করা। এজন্য তিনি চীনের সাহায্যে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র বসানোর প্রকল্পে হাত দেন। এই প্রকল্প নির্ধারিত মেয়াদের আগেই শেষ করা হয়।
এই কারণে ওই সময়ে 'পাঞ্জাবের গতি' কথাটি প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে। "বিশেষ করে সময়ের আগে প্রকল্পের কাজ শেষ করার কারণে চীনারা খুবই খুশি ছিল"
সালমান গনি মনে করেন, পাকিস্তানের বিদ্যুৎ ঘাটতি দূর করার কৃতিত্ব ছিল শাহবাজ শরিফের এবং ২০১৩ সালের নওয়াজ শরিফের দলের জয়ের পেছনে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
সালমান গনি বলেন, চীনাদের কাজে মুগ্ধ হয়েছিলেন শাহবাজ শরিফ। একারণেই তিনি বহুবার চীন সফর করেছেন। "তিনি চীনাদের পছন্দ করতেন। এবং চীনারা তাকে পছন্দ করতো। তার গতিতে মুগ্ধ ছিল চীনারা এবং তারা এর প্রশংসা করতো"।
মেট্রো বাস ও অরেঞ্জ লাইন ট্রেন
স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতের কিছু প্রকল্প নিয়েও কাজ করেছেন শাহবাজ শরিফ, কিন্তু তার সময়ের দুটো বড় প্রকল্প নিয়ে মারাত্মক সমালোচনা হয়েছিল। লাহোরে যানজট কমাতে মেট্রো বাস চালানোর পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি।
ওই সময়ে বিরোধী নেতা ছিলেন ইমরান খান। ওই প্রকল্পকে ইমরান সমালোচনা করতেন 'জঙ্গল বাস' বলে।
সাংবাদিক সালমান গনি বলেন, "সকল সমালোচনা উপেক্ষা করে মেট্রো বাস প্রকল্প সমাপ্ত করেছিলেন শরিফ। এবং তিনি সফল হয়েছিলেন"।
এর পর মুলতান, রাওয়ালপিন্ডি ও ইসলামাবাদেও একই রকম প্রকল্পের উদ্যোগ নেয়া হয়। এমনকি ইমরান খানের প্রদেশ খাইবার পাখতুনখোয়াতেও এই প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়।
অরেঞ্জ লাইন ট্রেন চালু করতে গিয়েও বিরোধীদের কাছ থেকে একইরকম সমালোচনার মুখে পড়েন শাহবাজ শরিফ। বিরোধীদের বক্তব্য ছিল, এই প্রকল্পটি এতই ব্যয়বহুল যে ভর্তুকি দিয়ে শেষ পর্যন্ত এটিকে টিকিয়ে রাখা মুশকিল হবে।
যাইহোক, পরে ইমরান খানের পিটিআই সরকারের অধীনেই প্রকল্পটি সমাপ্ত হয় এবং এখনো তা অব্যাহত আছে।
প্রদেশ থেকে কেন্দ্রে
রাজনীতিতে সবসময়ই বড় ভাই নওয়াজ শরিফের ছায়াতলে দ্বিতীয় সারির ভূমিকায় থেকেছেন শাহবাজ শরিফ। বড় ভাই যখনই প্রধানমন্ত্রী হন শাহবাজ শরিফ হন প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রী।
মুজিব-উর-রহমান শামির বর্ণনায়, শাহবাজ শরিফ গণমানুষের নেতা ছিলেন না, বরং তিনি একজন ভাল প্রশাসক ছিলেন, যিনি সামরিক প্রতিষ্ঠানের সাথে অপ্রয়োজনীয় দ্বন্দ্বে জড়ানোর পক্ষপাতী নন।
যাইহোক, পরিস্থিতি বদলে যায় ২০১৭ সালে, যখন পানামা পেপার্স ফাঁসের জের ধরে সুপ্রিম কোর্ট নওয়াজ শরিফকে আজীবনের জন্য নির্বাচনে প্রার্থী হবার অযোগ্য ঘোষণা করে।
এরপর শাহবাজ শরিফ দলীয় প্রধানের পদ পান ঠিকই, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হন শহিদ খাকান আব্বাসি।
ওদিকে কিছুদিন জেল খাটার পর আদালতের অনুমতি নিয়ে চিকিৎসার জন্য লন্ডন চলে যান নওয়াজ শরিফ। তারপর আর কখনো দেশে ফেরেননি তিনি। এই শূন্যস্থান পূরণের জন্য ২০১৮ সালের নির্বাচনে পাঞ্জাব থেকে বেরিয়ে এসে কেন্দ্রের রাজনীতিতে যোগ দিতে মনস্থ করেন শাহবাজ শরিফ।
তিনি জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দলের প্রধান হিসেবে বিরোধী দলের নেতা হন। দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের মামলা তার বিরুদ্ধেও হয়েছে কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হননি তিনি।
সর্বসম্প্রতি অন্যান্য বিরোধী দলগুলোকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে লাগেন শাহবাজ শরিফ, যার অংশ হিসেবে জাতীয় পরিষদে ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনেন।
সাংবাদিক সালমান গনি বিশ্বাস করেন, কেন্দ্রের রাজনীতি ঠিক পাঞ্জাবের মত নয় এবং এখানে তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বহু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করা শাহবাজ শরিফের জন্য ততটা সহজ হবে না।
এসি