ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

ধর্মের কলে নড়ে ফেসবুক

পলাশ আহসান

প্রকাশিত : ০২:০৭ পিএম, ১৩ এপ্রিল ২০২২ বুধবার

রামচন্দ্রপুর হাইস্কুলে দশম শ্রেণির ক্লাসে হৃদয় মণ্ডলের সঙ্গে তার কথপোকথন শুনেছি। দীর্ঘ কথপোকথন, বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনতে হয়, না হলে কিছু বোঝা যায় না। এটা নিয়ে আমার আগ্রহের কারণ ভিন্ন । হৃদয় মণ্ডল বিজ্ঞান নিয়ে কি বলেছেন, তিনি ধর্ম বিশ্বাস করেন, কী করেন না এ নিয়ে এই লেখায় আগ্রহ প্রকাশ করছি না। আমার আগ্রহ, ছেলেগুলো কেন এরকম একটি কথপোকথন রেকর্ড করল? কারণ পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়া এরকম রেকর্ড করার কথা নয়। ছাত্ররা শিক্ষকের বক্তব্যের রেকর্ড নিয়ে কেন পরিকল্পনা করবে? এই বয়সী ছাত্ররা এরকম একটি পরিকল্পনা নিজেরাই করছে? নাকি তারা কারো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে?

যতদূর বুঝলাম প্রথমত হৃদয় মণ্ডলের দিক দিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তার সম্পর্ক খুবই আন্তরিক। কিন্তু শিক্ষার্থীরা মোটেও আন্তরিক নয়। বরং স্যারের ভালো মানুষির সুযোগ নিয়ে তারা কিছু সরল কথা বের করার চেষ্টা করছে। যেটা তারা হৃদয় মণ্ডলের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়াতে ব্যবহার করবে। এই উদাহরণে পরিষ্কার বোঝা যায় ফেসবুক কত সহজে ঘৃণা ছড়ানোর কাজে ব্যবহার হয়। শুধু তাই নয়, এখন এটা বলতে আর কোনো দ্বীধা নেই যে, ফেসবুকের অপব্যবহারের অশিক্ষা পৌঁছে গেছে জেলা পর্যায়ের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কাছ পর্যন্ত।

পাঠক, আপনারাও যদি ওই বক্তব্য শোনেন তাহলে বুঝবেন, তারা হৃদয় মণ্ডলের মুখ থেকে একটা অবমানকর কথা শুনতে চাইছিল। তিনি সেটা বলছেন না দেখে রীতিমত বিরক্ত হচ্ছিল তারা। এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে আরেক শিক্ষার্থীকে বার বার ইঙ্গিত দিচ্ছিল কথকোপোকথন চালিয়ে যেতে। তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ানোর মশলা খোঁজার আকুতি প্রকাশ পাচ্ছিল বার বার। কিন্তু শেষমেষ তারা সেটা পেলে না। আমিও হতাশ হলাম। কারণ পুরো রেকর্ডে জানা গেলে না কে বা কারা এই শিক্ষার্থীদের এমন নির্দেশ দিল।

যাহোক ওইদিন ওই রেকর্ডে যা পায় তাই ছেড়ে দেয়া হয় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে। এর পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় ১৯ দিন কারাবাস করেন হৃদয় মণ্ডল। একজন শিক্ষককে কোনো অপরাধ ছাড়াই জেল খাটতে হলো। তার দুই ছেলে-মেয়ে জানল তাদের বাবা একজন অপরাধী। হাজার হাজার জায়গায় প্রচার হয়ে গেল হৃদয় মণ্ডল অন্যের ধর্ম অবমাননা করেন। তিনি ভালো মানুষ নন। এর জন্যে তাকে কারাগার পর্যন্ত যেতে হলো। তিনবার আবেদন করে অবশেষে জামিনে মুক্তি পেলেন। এই মুক্তি মানে আদালতে যাওয়ার দরকার শেষ হয়ে গেল এমন নয়, বলা যায় শুরু হলো। মধ্য বয়সী এই ভদ্রলোক সম্ভবত, সারাজীবনে এমন ধাক্কা খাননি। আর আমি বলি, ফেসবুকের অস্ত্রে আত্মসম্মান হারালেন একজন সম্মানী মানুষ।

আসি আরেকজন শিক্ষকের কাছে। তিনি নওগাঁর আমোদিনী পাল। স্কুল ড্রেস না পরা শিক্ষার্থীদের শাসন করে যিনি ফেঁসেছেন। তিনি আমার এই আলোচনায় আসলেন, কারণ তিনি ঘায়েল হয়েছেন ফেসবুকের মিথ্যাচারে। ঘটনার পরদিন পরিকল্পনা করে যখন ক্ষুব্ধ লোকজন স্কুলে আমোদিনীকে খুঁজতে গিয়েছিল, তখন ফেসবুকে পুরো ঘটনা লাইভ হয়। লাইভ দেখে আরো লোকজন তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। তারা এসেছিল হিজাব পরায় শিক্ষার্থীদের মারধর করার জিহাদি প্রতিবাদে। তারা আমোদিনীকে স্কুলে না পেয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়েন, ভাঙচুর করেন। সেটাও ফেসবুকে লাইভ করে মানুষকে জানানো হচ্ছিল।

এক সময় পুলিশও এসে পড়ে ঘটনাস্থলে। যে কারণে লোকজনের বহর আমোদিনীর বাড়ি পর্যন্ত আর যেতে পারেনি। যেতে পারলে কী হতো সেটা আমরা নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারি । এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী হয়তো তার এবং পরিবারের প্রাণ বাঁচালো। কিন্তু তাকে দেশব্যাপী আলোচিত হতে হলো। একটা সময় পর্যন্ত কোটি কোটি মানুষের কাছে বার্তা গেল একজন আমোদিনী একটা বিশেষ ধর্মবিরোধী। এটা কী একজন শিক্ষিত সচেতন মানুষের জন্যে কম অসম্মানের?

মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমোদিনী যখন মেয়েদের শাসন করলেন, সেই ছবি কেউ তুলল না কিংবা তুললেও প্রচার হলো না। কারণ আর কী, এতে তো আমোদিনীর প্রতি বিদ্বেষ ছড়াবে না। বরং তিনি কী করেছিলেন সেটা বের হয়ে আসবে। এরই মধ্যে হৃদয় মণ্ডল দশম শ্রেণিতে পড়া ওই শিক্ষার্থীদের ক্ষমা করে ক্লাসে ফিরতে বলেছেন। আমোদিনী পালের বিরুদ্ধে হিজাব পরায় মারধরের অভিযোগ পায়নি তদন্ত কমিটি। কিন্তু এসব তথ্য মূল ধারার গণমাধ্যমে এলেও ফেসবুকে ওইভাবে দেখলাম না। এর মাধ্যমে আমরা দেখলাম ফেসবুকে ইতিবাচক খবর চেপে যাওয়ার প্রবণতা।

আমোদিনীর ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে আমি আবারো বুঝলাম, যেকোনো যুদ্ধে ‘ফেসবুক অপব্যবহার’ এর মত কার্যকর অস্ত্র আর নেই। কোনো শব্দ নেই, খরচ নেই, কায়িক শ্রম নেই। অথচ ছাড়লেই প্রতিপক্ষ কুপোকাত। শুধু সময় জ্ঞান থাকতে হবে। অর্থাৎ ওঁৎ পেতে থাকতে হবে শিকারী বাঘের মতো। পত্রপত্রিকা অনুযায়ী যেমনটা ছিলেন আমোদিনীর স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তার কাছে নিশ্চয়ই এটা যুদ্ধ। জয়ের পর মিথ্যাচার করার জন্য নিজেকে তিনি সেই আপ্তবাক্য বলতে পারবেন "প্রেমে আর যুদ্ধে মিথ্যে নেই"

শিরোনামে বলেছিলাম ধর্মের কল নড়ে ফেসবুকে। এটা অনুকরণ করেছিলাম ‘ধর্মের কল নড়ে বাতাসে’ প্রবাদ থেকে । কারণ ওই প্রবাদে ধর্ম ব্যবহৃত হচ্ছিল সত্যের প্রতিশব্দ হিসাবে। এই প্রবাদের মূল কথা হচ্ছে, সত্যের ওপর কখনো মিথ্যের আস্তর পড়তে পারে। কিন্ত এক সময় তা নিজের গুণেই প্রকাশ হয়ে যায়। কিন্তু বর্তমানে যে সমাজে আছি সেখানে ফেসবুকই মূল কথা। ভাইরাল বলে একটা টার্ম আছে। এই ভাইরালের ফাঁদে ফেলে একটি মিথ্যাকে সত্য অথবা সত্যকে মিথ্যা বানিয়ে দেয়া হয়। গোয়েবলসীয় সূত্রে এক সময় সেটাই স্থায়ী হয়ে যায়। যে কারণে আমাকে বলতে হলো, ধর্মের কল নড়ে ফেসবুকে।

এই ফেসবুকে অবমাননাকর কিছু লেখার ঘটনা এই প্রথম যে ঘটছে তা তো নয়। একের পর এক হচ্ছে। কিন্তু এই প্রবণতা বন্ধের ন্যূনতম কোনো পদক্ষেপ দেখছি না। ফেসবুক মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং গোপনীয়তা রক্ষায় সুন্দর সুন্দর কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড প্রকাশ করেছে। কিন্তু অনুশীলনের সঙ্গে এর মিল খুঁজতে গেলে রীতিমত লজ্জা পেতে হয়। তাদের প্রতিষ্ঠাতা জাকারবার্গ সাহেব একবার বলেছিলেন, ফেসবুককে তিনি এমন প্ল্যাটফর্ম বানাতে চান, যোগাযোগ নিয়ে যেখানে মানুষ ক্ষমতায়িত বোধ করবে। করছে সন্দেহ নেই । কিন্তু তারা স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতার পার্থক্য ভুলে গেছে।

পাঠক, দেখুন হৃদয় মণ্ডল এবং আমোদিনী পালের ঘটনা শেষ হয়নি। এরই মধ্যে বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জে কৌশিক বিশ্বাস নামের এক ব্যক্তির বাড়িতে হামলা করে আগুন দিয়েছে তারই প্রতিবেশিরা। এবারো অপরাধ ফেসবুকে ইসলাম ধর্ম অবমাননার কটূক্তি। এক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা শক্ত। প্রথমে গ্রেপ্তার হয় কৌশিক। পরে সংহিসতার দায়ে আটক হয় আরো ১৫ জন। এখন অপেক্ষা, কখন কোথায় আরেকটি অবমাননাকর কিছু ঘটবে। কারণ ফেসবুকের স্বেচ্ছাচার বন্ধে আমাদের দেশি উদ্যোগও খুব দুর্বল।
লেখক: যুগ্ম প্রধান বার্তা সম্পাদক, একাত্তর টেলিভিশন
এএইচএস/এসএ/