বাংলার বন্ধু, একুশের বন্ধু সায়মন ড্রিং
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ১০:৩৪ এএম, ১৪ এপ্রিল ২০২২ বৃহস্পতিবার
বাইশ বছর আগে ২০০০ সালের ১৪ এপ্রিল যাত্রা করে টেলিভিশন চ্যানেল একুশে টেলিভিশন। এর মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের মানুষ প্রথমবারের মত স্বাদ পায় একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের। যে কারণে বাংলাদেশের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে এখনও জ্বল জ্বল করে একুশে টেলিভিশনের নাম। এই বিশাল অর্জনের পেছনেও রয়েছে গল্প। সেই গল্পের নায়ক ব্রিটিশ সাংবাদিক সায়মন ড্রিং। তাই বরাবরের মতো একুশে টেলিভিশনের ২৩তম জন্মদিনেও স্মরণীয় স্বপ্নের এই সারথী।
১৯৯৭ সালে যখন একটি বেসরকারি টেলিভিশন হিসাবে একুশে টেলিভিশনের বীজ বপণ হয়, তখন শুরুতেই ডাক পড়ে সায়মন ড্রিংয়ের। সেই ডাকে সাড়াও দিয়েছিলেন তিনি। কারণ বাংলার সাথে তার বন্ধন বাংলার জন্মলগ্ন থেকেই। সেটিও আরেক ইতিহাস।
ওই সময় সায়মন কর্মরত ছিলেন বিবিসিতে। সেই চাকরি ছেড়ে একুশে টেলিভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসাবে যোগ দেন।
টেলিভিশনের লাইসেন্স পাওয়া থেকে শুরু করে টেস্ট ট্রান্সমিশন পর্যন্ত পুরো কর্মযজ্ঞে যার অক্লান্ত পরিশ্রম ছিল তিনিই সায়মন ড্রিং। প্রতিষ্ঠানের জন্য সংবাদকর্মী নিয়োগ থেকে শুরু করে তাদের প্রশিক্ষণ, সব ক্ষেত্রেই তার অবদান অসীম। বাংলাদেশে ব্রডকাস্ট সাংবাদিকতার জনকও বলা হয় তাকে।
বাংলাদেশের জন্মলগ্নেও এই মানুষটির অবদান তাকে জায়গা করে দিয়েছে ইতিহাসের পাতায়।
১৯৭১ সালে দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফের রিপোর্টার ছিলেন সাইমন ড্রিং; কাজ করতেন কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেন থেকে।
হঠাৎ একদিন লন্ডনের হেড কোয়ার্টার থেকে ফোন করে তাকে বলা হলো, ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত। সেখানে বড় কিছু ঘটতে যাচ্ছে, তুমি ঢাকা চলে যাও।’
পাকিস্তান কিংবা পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে সে সময় তার কোনো ধারণাই ছিল না। তবু তিনি মার্চের ৬ তারিখে কম্বোডিয়া থেকে ঢাকায় আসেন।
পরদিন ৭ মার্চ ছিল রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামী লীগের জনসভা। সেই ঐতিহাসিক দিনের ফুটেজও নিয়েছিলেন তিনি। অথচ পুরো ভাষণের কিছুই বুঝতে পারেননি। কিন্তু লাখ লাখ জনতার প্রতিক্রিয়া, তাদের চোখমুখের অভিব্যক্তি দেখে অনুভব করলেন, এক বিশাল মোড় নিচ্ছে একটি দেশ ইতিহাসের মহাকালে।
রাজনৈতিক নেতা ও জনসাধারণের সঙ্গে দোভাষীর মাধ্যমে কথা বলে বুঝতে পারলেন এই দেশ আজীবন কেবল শাসিত হয়েই আছে। এরা আজীবন অত্যাচারিত হয়েই আছে।
তিনি বুঝতে পারলেন এই অসহায় মানুষেরা এখনও এক জনের আঙ্গুলের ইশারায় স্বপ্ন বুনছেন নতুন করে। ভয়ংকর এক ঝড় চলছে মানুষের মনে। সপ্তাহখানেকের জন্য ঢাকা এসেছিলেন সাইমন ড্রিং, কিন্তু আর ফিরে যেতে পারলেন না।
সাইমন ড্রিং পরবর্তীতে এক সাক্ষাৎকারে সেদিনের ঘটনা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘সেদিন মানুষের উদ্দীপ্ত চোখ যেন একেকটা বারুদ। আমি বুঝতে পেরেছিলাম ইতিহাসের নতুন মোড় নিচ্ছে।’
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের রাজনীতি, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আন্দোলন, সংগ্রাম সম্পর্কে তার জানাশোনার পরিধি বাড়ল। বেশ কিছু বই পড়লেন তিনি। শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের বহু নেতার সঙ্গে তার পরিচয় হলো, সখ্যতা গড়ে উঠলো। চেষ্টা করলেন জনগণের মতামত জানার। সব মিলিয়ে নিয়মিত লন্ডনে রাজনৈতিক ঘটনাবলি নিয়ে রিপোর্ট পাঠাতেন তিনি।
২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী গণহত্যা শুরু করার আগে ঢাকায় অবস্থানরত প্রায় ২০০ বিদেশি সাংবাদিককে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আটকে ফেলে।
সকল সাংবাদিককে হোটেল থেকে সরাসরি বিমানে তুলে ঢাকা ছাড়তে বাধ্য করা হয় যাতে করে বিশ্ব গণমাধ্যমের জন্য তারা গণহত্যার কোনো সংবাদ সংগ্রহ করতে না পারেন। তাদের মধ্যে ছিলেন সাংবাদিক সাইমন ড্রিং।
কিন্তু পাকিস্তানী সামরিক আইন অমান্য করে সাইমন ড্রিং হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে লুকিয়ে থাকেন। তার শ্বাসরুদ্ধকর ৩২ ঘণ্টা সময় কাটে হোটেলের লবি, ছাদ, বার, কিচেন প্রভৃতি স্থানে। পরে তিনি ঘুরে ঘুরে স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেন গণহত্যার বাস্তব চিত্র।
জীবনের বহু পথ অতিক্রম করেও বাংলাদেশকে ভুলতে পারেননি সাইমন ড্রিং। ভুলতে পারেননি এদেশের আকাশ-বাতাস মাটি ও মানুষকে। তাই বোধহয় ১৯৯৭ সালে একুশের হাত ধরে আবারও বাংলায় পাড়ি জমিয়েছিলেন তিনি।
অথচ বাংলাদেশের এই পরম বন্ধুকে আমরা অপমান করেছি। ২০০২ সালে এক রাতের মধ্যেই দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয় তাকে। সে সময় সম্প্রচার আইন লঙ্ঘনজনিত অভিযোগে একুশে টেলিভিশনের সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়া হয়।
সে বছর ৩০ সেপ্টেম্বর তৎকালীন সরকার সাইমন ড্রিংয়ের ভিসা ও ওয়ার্ক পারমিট বাতিল করে তাকে অবিলম্বে বাংলাদেশ ছাড়ার আদেশ দেয়। মাত্র এক রাতেই চরম অপমানের শিকার হয়ে তিনি বাংলাদেশ ছাড়তে বাধ্য হন।
তবুও সায়মন ড্রিং এদেশের মায়া ভোলেননি। এরপরেও বেশ কবার বাংলাদেশে এসেছেন তিনি। যে মানুষ, যে বাতাস, যে দেশকে মনেপ্রাণে ভালোবেসেছেন সাইমন ড্রিং সেই দেশকে তিনি কি করে ভুলতে পারেন!
২০২১ সালের ১৬ জুলাই রোমানিয়ার একটি হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করার সময় মারা যান বাংলার বন্ধু, একুশের বন্ধু সায়মন ড্রিং।
এসবি/