ঢাকা, মঙ্গলবার   ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪,   পৌষ ৯ ১৪৩১

যাকাত নিয়ে আটটি প্রশ্ন ও তার উত্তর

একুশে টেলিভিশন  

প্রকাশিত : ০৯:১৩ এএম, ১৭ এপ্রিল ২০২২ রবিবার

ইসলামের নবী হযরত মোহাম্মদ যখন ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মদিনায় গিয়ে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা চালু করেন, তখন সে রাষ্ট্রে যাকাত ব্যবস্থা চালু হয়েছে। কিন্তু যাকাত কীভাবে কতটুকু দিতে হবে সে বিষয়ে অনেকের মধ্যেই আছে নানা প্রশ্ন।

যদিও ইসলামী চিন্তাবিদরা বলে থাকেন যে মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআনে যাকাত সম্পর্কে নির্দেশনা দেয়া আছে।

তারপরেও কোরআনের বিধান সম্পর্কিত ব্যাখ্যাগুলো দরকার হয় বিস্তারিত জানার জন্য।

ইসলামি ফাউন্ডেশনের মুফতি মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ বলছেন যে যাকাত সম্পর্কে অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য অনেক ধরণের মাসালার উপর নির্ভর করতে হয়।

তারপরও যাপিত জীবনের আলোকে যাকাত সম্পর্কে অনেক প্রশ্নের উদ্ভব হয় অনেকের মনে। যাকাত কীভাবে দেয়া হবে সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রেও তার জন্য এগুলো হয়ে ওঠে গুরুত্বপূর্ণ।

যেমন সবাই জানে যে এক বছরের বেশি সময় ধরে সঞ্চিত স্বর্ণালংকার ও নগদ অর্থ ছাড়াও বিভিন্ন দলিল, শেয়ার সার্টিফিকেট, প্রাইজবন্ড ও অন্যান্য কাগজপত্র যার আর্থিক মূল্য আছে ইত্যাদির মূল্য যদি নিসাব পরিমাণ, অর্থাৎ যাকাত প্রদানের উপযুক্ত পরিমাণ হয় এবং পূর্ণ এক বছর অতিবাহিত হয় তাহলে ইসলামিক আইন অনুযায়ী যাকাত দেয়া বাধ্যতামূলক।

কিন্তু কোন ক্ষেত্রে যাকাত দিতে হবে, কোন ক্ষেত্রে যাকাত দিতে হবে না? কারা এটা পেতে পারে? সরকারি ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে কী বলা আছে? এমন আটটি প্রশ্ন ও তার জবাব:

১. কেউ যদি ব্যাংক থেকে ঋণ নেয় তাহলে কি যাকাত দিতে হবে?

মুফতি মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ বলছেন, ব্যাংক থেকে ব্যক্তিগত ঋণ নিলে সেটি আগামী এক বছরের কিস্তির সমপরিমাণ টাকা বাদ দিয়ে বাকী টাকার ওপর যাকাত প্রযোজ্য হবে।

টাকা-পয়সা ব্যবসায় না খাটিয়ে এমনি রেখে দিলেও তাতে যাকাত ফরয হয়।

কিন্তু কারো ঋণ যদি এতো হয় যা বাদ দিলে তার কাছে নিসাব পরিমাণ যাকাতযোগ্য সম্পদ থাকে না তাহলে তার ওপর যাকাত ফরয নয়।

২. কোন ধরণের সম্পদের ওপর যাকাত প্রযোজ্য?

আব্দুল্লাহ বলছেন বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে রাখা প্লট, ফ্ল্যাট বা জমির যাকাত দিতে হবে।

কিন্তু বাড়ি করার জন্য রাখা প্লট বা জমির যাকাত দিতে হবে না।

আবার কেউ যদি সন্তানের জন্য বা এ ধরনের ব্যবহারের জন্য ফ্লাট রাখেন সেটারও যাকাত প্রযোজ্য হবে না।

কারও দোকান থাকলে সেখানে থাকা পণ্যের ওপর যাকাত দিতে হবে, কিন্তু দোকান ভবন বা জমির ওপর যাকাত প্রযোজ্য হবে না।

অনেকের মধ্যে ধারণা আছে, নিজের বা পরিবারের অধিকারে থাকা মূল্যবান দ্রব্যাদি যেমন স্বর্ণ-রৌপ্যালঙ্কার, দামী রত্ন বা এ ধরণের জিনিস থাকলেই কেবল যাকাত দিতে হবে।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের যাকাত ফাণ্ড পরিচালক মোহাম্মদ হারুনুর রশীদ বলেছেন, ব্যাপারটি তেমন নয়।

তিনি বলেছেন, হাতে গচ্ছিত নগদ অর্থ, শেয়ার সার্টিফিকেট, প্রাইজবণ্ড ও সার্টিফিকেটসমূহ, স্বর্ণ-রৌপ্য, মূল্যবান ধাতু ও সোনা-রুপার অলংকার, বাণিজ্যিক সম্পদ ও শিল্পজাত ব্যবসায় প্রতিশ্রুত লভ্যাংশ, উৎপাদিত কৃষিজাত ফসল, পশু সম্পদ—৪০টির ওপরে ছাগল বা ভেড়া, এবং ৩০টির ওপরে গরু-মহিষ ও অন্যান্য গবাদি পশু, খনিজ দ্রব্য, প্রভিডেন্ট ফাণ্ড - এসব কিছুর ওপরই যাকাত দিতে হবে, কিন্তু সেটা নিসাব অনুসারে।

৩. দাতব্য সংস্থায় যাকাত কি যাকাতের অর্থ দেয়া যাবে?

মুফতি মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ বলছেন যাকাত আদায় শুদ্ধ হওয়ার জন্য যাকাত গ্রহীতাকে সে অর্থের মালিক বানিয়ে দিতে হয়।

যাতে করে সে নিজ ইচ্ছায় বা স্বাধীনভাবে নিজের প্রয়োজনে তা ব্যবহার করতে পারে।

"সংস্থায় টাকা দিলে সেটি ব্যয়ের অধিকার তো সুনির্দিষ্টভাবে সেই গরীব বা মিসকিন থাকছে না। এ টাকার মালিক নির্দিষ্টভাবে কোন গরীব বা মিসকিন হয় না। সে কারণে যাকাত হিসেবে নগদ টাকা দেয়াই উত্তম," বলছিলেন তিনি।

৪. স্ত্রীর স্বর্ণালংকারের যাকাত কে দেবে? স্বর্ণালংকার বলতে কি বোঝায়?

আব্দুল্লাহ বলেন, স্ত্রীর ও মেয়ের যাকাতের দায় তার উপরই বর্তায়।

কিন্তু ধরুন স্ত্রীর দশ ভরি সোনা আছে কিন্তু নগদ টাকা নেই। সেক্ষেত্রে স্বর্ণ বা কিছু অংশ স্বর্ণ বিক্রি করেও তিনি যাকাত দিতে পারেন।

আবার স্বামীও পরিশোধ করতে পারেন, তবে সেটা ঋণ হিসেবে নেয়া যাবে না।

তিনি বলেন, স্বর্ণালংকার বলতে সোনা ও রূপাকে বোঝানো হয়।

"তবে হীরা বা জহরত কিংবা অন্য কোন অলংকারের ক্ষেত্রে কী হবে সেটি পরিষ্কার নয়। তবে এগুলো ব্যবসার পণ্য হলে যাকাত দিতে হবে," বলছিলেন তিনি।

৫. কাপড় দিয়ে কি যাকাত দেয়া যায়?

মুফতি আব্দুল্লাহ বলেন, "এটি ঠিক হলেও উত্তম নয়"। কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, যার যেটা উপকারে লাগবে সেটা দিয়েই তাকে যাকাত দেয়া উত্তম।

"কারও হয়তো কাপড় লাগবে না, বরং খাবার লাগবে। আবার কারও হয়তো নগদ অর্থ লাগবে। এসব বিবেচনা করে সুনির্দিষ্টভাবে যা দরকার তা দিয়েই সহায়তা করা দরকার। সেটি না হলে নগদ টাকা দেয়াই ভালো," বলছিলেন তিনি।

৬. নিসাব কী?

নিসাব একটি ইসলামি শব্দ। এর মানে হচ্ছে দৈনন্দিন প্রয়োজন পূরণ ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী বাদ দেয়ার পর সাড়ে বায়ান্ন তোলা পরিমাণ রূপা অথবা সাড়ে সাত ভরি পরিমাণ স্বর্ণ থাকলে অথবা এর সমমূল্যের ব্যবসায়িক পণ্যের মালিকানা থাকলে তাকে যাকাতের নিসাব বলে।

ধর্মের নিয়ম অনুযায়ী নিসাব পরিমাণ সম্পদ এক বছর অতিবাহিত হলে যাকাত দিতে হবে।

ধরুন, এক জনের কাছে সাড়ে সাত ভরির চাইতে সামাণ্য বেশি স্বর্ণ আছে। ধরা যাক ওই স্বর্ণ তিনি বাজারে ৪ লাখ টাকায় বিক্রি করতে পারবেন। এটাই নিসাব পরিমাণ সম্পদ।

এখন তাকে এই নিসাবের জন্য শতকরা আড়াই টাকা হিসেবে দশ হাজার টাকা যাকাত দিতে হবে।

৭. যাকাত কারা পেতে পারেন?

যাকাত শুধু মুসলিমদের দেয়া যায়। যেসব মুসলিম এটি পেতে পারেন তার মধ্যে আছে:

মুসলিম গরীব মিসকিন
ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি
জিহাদকারী ও মুসাফির
দ্বীনদার দরিদ্র
গরিব-অসহায় আত্মীয়-স্বজন

৮. সরকারের যাকাত ফান্ড কীভাবে কাজ করে?

বাংলাদেশ সরকারের একটি যাকাত ফান্ড আছে, যা ১৯৮২ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

এর মাধ্যমে দেশের ৬৪ জেলাতেই যাকাত সংগ্রহ করে, সরকারি বিধান অনুযায়ী সংগৃহীত অর্থের ৭০ শতাংশ সংশ্লিষ্ট জেলাতেই ব্যয় করা হয়।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের এর যাকাত ফান্ডের মাধ্যমে ১৯৮২ সাল থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত প্রায় সাড়ে নয় লাখ মানুষকে প্রায় ৩৫ কোটি টাকার যাকাত বণ্টন করা হয়েছে।

ব্যক্তিকে যাকাত দেয়ার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানেও যাকাত দেয়া যায়।

এক্ষেত্রে বাংলাদেশে সরকারিভাবে সংগ্রহ করা যাকাত যাকাত বোর্ড শিশু হাসপাতাল, সেলাই প্রশিক্ষণ এমন নানা খাতে খরচ করা হয়।

 

সূত্র: বিবিসি বাংলা

এসবি/