হিন্দু দিলেন মসজিদে জমি, মুসলিম দিলেন শ্মশানে
বাগেরহাট প্রতিনিধি
প্রকাশিত : ০৪:১৬ পিএম, ২৮ এপ্রিল ২০২২ বৃহস্পতিবার
মসজিদ ও শ্মশান
দুই ধর্মের দুই ব্যক্তি বিপরীত ধর্মের উপসানালয়ের জন্য জমি দান করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন বাগেরহাটের ফকিরহাটে। উদার মনের এই দুই ব্যক্তিকে সম্প্রতি সন্মাননা দিয়েছেন বেসরকারি একটি উন্নয়ন সংস্থা। এরপর থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্নভাবে সমাদৃত হচ্ছে তাদের এই মহৎ কর্ম।
পারষ্পরিক সহমর্মিতা থেকেই বিপরীত ধর্মের উপসানালয়ের জন্য জমি দান করেছেন বলে জানিয়েছেন ওই দুই ব্যক্তি।
ফকিরহাটে কাজী আজাহার আলী কলেজের সহকারী অধ্যাপক প্রণব কুমার ঘোষ ২০০৯ সালে ফকিরহাট বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন এলাকায় মুসলিম ধর্মের অনুসারীদের মসজিদ নির্মাণের জন্য নিজ দখলে থাকা রেলওয়ের ৩৩ শতক জমি নামমাত্র মূল্যে হস্তান্তর করেন। এরপর গত এক বছর আগে ২০২১ সালে পরধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতা দেখিয়ে মুসলিম ধর্মের অনুসারী আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মিজানুর রহমান হিন্দু ধর্মের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের জন্য নিজ দখলে থাকা পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১০ শতক জমি বিনামূল্যে হস্তান্তর করেন।
এই দুটি ঘটনা দুই ধর্মের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির নতুন সেতু বন্ধন হিসেবে কাজ করছে বলে মনে করেন স্থানীয়রা।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, ফকিরহাট বিশ্বরোড সংলগ্ন এলাকায় দীর্ঘদিন কোনো মসজিদ ছিল না। স্থানীয় মুসল্লীরা অনেক দূরের মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করতেন। মুসলমানদের এই সমস্যার সমাধানে ২০০৯ সালে মহাসড়কের বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন এলাকায় মসজিদ নির্মাণের জন্য ৩৫ শতক জমি দেন ফকিরহাট কাজী আজহার আলী কলেজের সহকারী অধ্যাপক প্রণব কুমার ঘোষ। ওই জমি বাবদ নামমাত্র মূল্য নেন সনাতন ধর্মালম্বী এই মহৎ ব্যক্তি। এরপর থেকে স্থানীয় ও যাত্রাপথে থাকা অসংখ্য মুসল্লী এই মসজিদে নামাজ আদায় করে আসছেন। এছাড়া মসজিদে নারীদের নামাজের জন্যও উদ্যেগ গ্রহণ করেছেন তিনি।
অন্যদিকে তিন বছর আগে একই এলাকায় ভৈরব নদের গর্ভে বিলীন হয়ে যায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের শ্মশান। ফলে শেষকৃত্য করতে বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছিল সনাতন ধর্মালম্বীদের। এ অবস্থায় ফকিরহাট উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শেখ মিজানুর রহমান হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় জমি প্রদান করেন। তবে কতটুকু জমি দিয়েছেন তা জানাতে রাজি হননি তিনি।
মসজিদের জন্য জমিদাতা ফকিরহাট কাজী আজহার আলী কলেজের সহকারী অধ্যাপক প্রণব কুমার ঘোষ বলেন, আমরা এই এলাকায় হিন্দু-মুসলমানরা ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। সবার সুখ-দুঃখ পরস্পর ভাগাভাগী করে নিই। ফকিরহাট বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন মার্কেট এলাকায় দীর্ঘদিন মুসলমান ভাইদের জন্য মসজিদ ছিল না। আমি তখন এলাকার মানুষের সাথে কথা বলি এবং কিছু জমি প্রদান করি। পরবর্তীতে এখানে নারীদের নামাজের স্থান করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এখানে লিল্লাহ বোডিং করারও পরিকল্পনা আছে মসজিদ কমিটির। পাশাপাশি আমাদের এক মুসলমান ভাই শ্মশান এর জন্য জমি দান করেছেন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এ এক বিরল দৃষ্টান্ত। আমি আশা করি আমাদের এই পারষ্পরিক বন্ধন চির অটুট থাকবে।
শ্মশানের জন্য জমিদাতা শেখ মিজানুর রহমান বলেন, কয়েক বছর আগে ভৈরব নদী পুনঃখননের কারণে প্রায় দুইশত বছরের পুরাতন শ্মশানটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। ফলে হিন্দু ভাই-বোনদের শেষকৃত্য অনুষ্ঠান নিয়ে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছিল। আমি অন্য ধর্মের লোক হলেও তাদের এই সমস্যা আমার অনূভুতিতে আঘাত করে। তখন নদীর পাশে থাকা আমার জায়গা আমি শ্মশানের জন্য উৎসর্গ করি, এবং বলেছি, আপনাদের যতটুকু জায়গা প্রয়োজন আপনারা নিয়ে নিন।
মসজিদের মুয়াজ্জিন মো. গাউসুল আলম বলেন, এই বিশ্বরোড এলাকায় কাছাকাছি কোনো মসজিদ না থাকায় আমাদের নামাজ পড়তে বেশ অসুবিধা হত। পরবর্তীতে প্রণব বাবু নিজ উদ্যেগে নামমাত্র মূল্য নিয়ে মসজিদের জন্য জায়গা প্রদান করেন। আমরা তার প্রতি কৃতজ্ঞ।
হাঙ্গার প্রজেক্টের উপজেলা পিএফজি (পিস ফ্যাসিলেটেটর গ্রুপ) কমিটির সমন্বয়কারী মো. আরিফুল হক বলেন, ফকিরহাট উপজেলায় একজন হিন্দু ব্যক্তির মসজিদে জমিদান এবং মুসলমানের শ্মশানের জন্য জমিদান সত্যিই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত। তাদের এই মহত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ গত ২৩ এপ্রিল হাঙ্গার প্রজেক্টের মাধ্যমে তাদের সন্মাননা দেয়া হয়। আমরা বিশ্বাস করি, অত্র এলাকায় সব ধর্মের মানুষের মধ্যে যে পারস্পরিক সহমর্মিতা ও সম্প্রীতির বন্ধন, তা সারাজীবন টিকে থাকবে।
ফকিরহাট উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান স্বপন কুমার দাশ বলেন, আমাদের পরিচিতি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অঞ্চল হিসেবে। এখানের মানুষ একদিকে যেমন স্ব-স্ব ধর্মে নিষ্ঠাবান, অপরদিকে পারস্পরিক সৌহার্দ ও সহযোগীতায়ও ইতিবাচক মনোভাবের অধিকারী। তার-ই প্রতিফলন ঘটেছে একজন সনাতন ধর্মাবলম্বীর মসজিদে ও একজন মুসলমানের শ্মশানে জমি প্রদানের মধ্যে দিয়ে। আমি তাদের এ ধরনের মহৎ কাজকে সাধুবাদ জানাই।
পাশাপাশি পারস্পরিক সহমর্মিতার এই নিদর্শন যেন সকলের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ হয়, সেই অনুরোধ জানান তিনি।
এনএস//