যতক্ষণ প্রয়োজন ‘লড়ে যাওয়ার’ অঙ্গীকার ইউক্রেনীয় সেনার
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৮:০৫ পিএম, ২৮ এপ্রিল ২০২২ বৃহস্পতিবার
আজভস্তাল লৌহ ও ইস্পাত কারখানা কম্পাউন্ডের একাংশ। ছবি- রয়টার্স
মারিউপোলের ইস্পাত কারখানায় আটকে পড়া এক ইউক্রেনীয় সেনা কমান্ডার সভিয়াতোস্লাভ পালামার বলেছেন, যতক্ষণ প্রয়োজন ততক্ষণ তার বাহিনী লড়বে। সেইসঙ্গে রাশিয়ার ‘মধ্যযুগীয়’ অবরোধে আটকা পড়া বেসামরিক ও সেনাদের সরিয়ে নেয়ার উপায় বের করতে বিশ্বনেতাদের প্রতি অনুরোধও জানিয়েছেন তিনি।
ইউক্রেনের উগ্র ডানপন্থি আজভ রেজিমেন্টের ডেপুটি কমান্ডার বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এ অনুরোধ জানান।
৩৯ বছর বয়সী পালামার রয়টার্সকে এ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন আজভস্তাল ইস্পাত কারখানার ভেতর থেকে। যেটা বন্দরনগরী মারিউপোলের ইউক্রেনীয় যোদ্ধাদের শেষ দূর্গ হিসেবে টিকে আছে। ইউক্রেনীয় যোদ্ধারা এখন ওই কারখানা প্রাঙ্গণ ও এর নিচের ভূগর্ভস্থ টানেলেই মূলত অবস্থান করছেন।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন গত সপ্তাহে মারিউপোলে রুশ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দাবি করে ওই ইস্পাত কারখানাটি চারদিক থেকে এমনভাবে ঘিরে রাখতে বলেছেন, যেন ‘মাছিও গলতে না পারে’।
এমন প্রেক্ষিতে পালামার বলেন, “যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা এখানে আছি এবং লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি, ততক্ষণ পর্যন্ত শহরটি তাদের (রুশ বাহিনী) নয়।”
তবে, রুশ বাহিনীর সঙ্গে তাদের তীব্র লড়াই চলছে এবং তাদের ওপর বোমাবর্ষণ অব্যাহত আছে বলেও জানান তিনি।
এর আগে রুশ বাহিনী বেশ কয়েকটি ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান এবং একদল সেনা পাঠিয়েছিল, কিন্তু ইউক্রেনীয় যোদ্ধারা সেসব ট্যাংক ও যান ধ্বংস করে দিয়েছে বলেও দাবি করেন পালামার। আজভ বাহিনীর এ কমান্ডার বলেন, কৌশল প্রতিনিয়তই পাল্টাচ্ছে।
তিনি বলেন, “তাদের কৌশল হচ্ছে মধ্যযুগীয় কায়দায় অবরোধ করে রাখা। আমাদেরকে চারদিক থেকে ঘিরে রাখা হয়েছে। আমাদের প্রতিরোধ লাইন ভাঙতে বিপুল সংখ্যক সেনা পাঠাচ্ছে না তারা, বিমান হামলা চালাচ্ছে।”
এক সন্তানের জনক পালামার ইউক্রেনীয় বাহিনীর কৌশল সম্বন্ধে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলেননি, কেননা তা ‘শত্রুপক্ষের’ সুবিধা করে দিতে পারে। তাদের কাছে এখন কী পরিমাণ খাবার ও গোলাবারুদ আছে, তা না বললেও ভেতরে এখনও কয়েকশ ইউক্রেনীয় যোদ্ধা অবস্থান করছে বলেই নিশ্চিত করেন তিনি।
রাশিয়া গত ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে ইউক্রেনকে ‘নিরস্ত্র’ করার লক্ষ্যে ‘বিশেষ সামরিক অভিযানে’ নামে। আজভ ও অন্যান্য উগ্র ডানপন্থি বাহিনীকে নির্মূলের লক্ষ্যেই তারা অভিযানে নেমেছে বলে ভাষ্য মস্কোর।
পালামার বলেন, “নিশ্চয়ই আমাদের সম্পদ অফুরন্ত নয়, যতদিন যাচ্ছে, যত তীব্র লড়াই হচ্ছে, ক্রমেই তা কমে আসছে। পরিস্থিতি জটিল, কিন্তু যতক্ষণ হাতে আছে ততক্ষণ লড়ে যেতে হবে।”
তিনি জানান, তাদের সঙ্গে এখন পাঁচশ’র বেশি আহত যোদ্ধা আছেন, যাদের অনেকের অবস্থাই গুরুতর।
পালামার বলেন, “তাদের চিকিৎসা করার, সার্জারি করার মতো অবস্থা আমাদের নেই। ওষুধ, ব্যান্ডেজ, খাবার ও পানি ফুরিয়ে আসছে।”
রাশিয়ার জন্য মারিউপোল পুরোপুরি দখলে নেয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে তারা স্থলপথে ক্রিমিয়া উপদ্বীপে যাওয়ার পথ সুরক্ষিত করতে পারবে, পাশাপাশি মারিউপোলে থাকা রুশ যোদ্ধাদের ডনবাসের অন্য পাশে পাঠিয়ে দিতে পারবে।
ইউক্রেনের পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর লভিভ থেকে আসা পালামার ২০১৪ সাল থেকেই মারিউপোলে বসবাস করছেন। ইস্পাত কারখানায় এখন কত বেসামরিক আটকা তার সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান না দিলেও সেখানে কয়েকশ বেসামরিক আছে বলেও জানিয়েছেন।
সৈন্য ও বেসামরিকরা আলাদা আলাদা বাংকারে থাকছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমরা তাদেরকে খাবার দিয়ে আসি, তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করি, কিন্তু তাদের সঙ্গে থাকতে পারি না; কারণ, দেখা গেল শত্রুরা উসকানিমূলক কিছু করে পরে বলল, আমরা বেসামরিকদের পেছনে লুকিয়ে আছি।”
পালামার জানান, মঙ্গলবার রাশিয়ার ছোড়া রকেট বেসামরিকদের একটি বাংকারে আঘাত হানলে বয়স্ক এক নারী ও এক পুরুষ আহত হন, ওই বাংকারটিতে শিশুরাও ছিল।
ইউক্রেনীয় এই যোদ্ধা রয়টার্সের সঙ্গে জুম অ্যাপের মাধ্যমে কথা বলেছেন; তবে রাশিয়ানরা তাদের অবস্থান সম্পর্কে তথ্য পেয়ে যেতে পারে এই শঙ্কায় ক্যামেরা চালু করেননি।
পালামারের অভিযোগ, রাশিয়া বেসামরিকদের কারখানা এলাকা থেকে বেরিয়ে যেতে বলেও সেখানে গোলা ছোড়া অব্যাহত রেখেছে।
বেসামরিকদের আজভস্তাল থেকে দ্রুত সরিয়ে নিতে জাতিসংঘ বা রেড ক্রসের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে মূল ভূমিকা নেয়ার আহ্বান জানান।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এখন ইউক্রেনে আছেন, বৃহস্পতিবার তার সঙ্গে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির বৈঠকও হওয়ার কথা। গুতেরেস এর আগে মঙ্গলবার রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে দেখা করেন।
পালামার বলেন, বেসামরিকদের সরিয়ে নেয়ার পর হতাহত যোদ্ধাদের ইউক্রেনে পাঠানো ও অন্য সেনাদের নিরাপদে প্রস্থানের ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
তবে বন্দি হওয়ার উপায় নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, “বন্দি অবস্থাতেই হত্যা করা হবে, পঙ্গু করে দেয়া হবে, এজন্যই আমরা তৃতীয় কোনো পক্ষের প্রস্তাব করছি, যারা আলোচনার মাধ্যমে আজভস্তাল থেকে আমাদের সরে যাওয়ার নিশ্চয়তা দিতে পারবে।”
তৃতীয় পক্ষ হিসেবে তিনি তুরস্ক বা ইসরায়েলের নামও প্রস্তাব করেছেন।
আজভস্তালে থাকা ইউক্রেনীয় বাহিনীর মধ্যে আজভ রেজিমেন্টের পাশাপাশি ন্যাশনাল গার্ড, অন্যান্য ব্রিগেড, মেরিন, সমুদ্র নিরাপত্তা বাহিনী, সীমান্তরক্ষী ও পুলিশের সদস্যরাও আছে বলে জানা গেছে।
ইস্পাত কারখানাটিতে থাকা আজভ যোদ্ধাদের মধ্যে রুশ, বুলগেরীয়, ক্রিমিয়ান তাতার, গ্রিক, ইহুদি, ক্যাথলিক ও অন্যরাও আছে বলেও জানান পালামার।
তিনি বলেন, বিশ্বের প্রতি তার মূল বার্তা হচ্ছে, তারা যেন রাশিয়ার হুমকির বিরুদ্ধে জেগে ওঠে ও মস্কোর প্রতি নমনীয় ভাব ত্যাগ করে।
এ আজভ যোদ্ধা বলেন, “বিশ্ব এথন তার ভুল বুঝতে পেরেছে বলে আশা করছি আমি। আমাদের সৈন্যরা এখানে যা করছে, কেবল মারিউপোলে নয়, সমগ্র ইউক্রেনে। আমরা বুঝতে পারছি যে, আমরা কেবল ইউক্রেনকেই রক্ষা করছি না। পোল্যান্ড, লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া, এস্তোনিয়া, মলদোভা ও জর্জিয়াকেও রক্ষা করছি।” সূত্র- রয়টার্স
এনএস//