ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১

বর্ণমালা স্কুলের অধ্যক্ষ ও সভাপতির দুর্নীতি তদন্তে কমিটি গঠন

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৮:৪৫ পিএম, ১৫ মে ২০২২ রবিবার

রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর বর্ণমালা আদর্শ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ও সভাপতির দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, ঢাকা। 

বোর্ডের চেয়ারম্যানের আদেশক্রমে কলেজ পরিদর্শক প্রফেসর আবু তালেব মো. মোয়াজ্জেম হোসেন স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে (স্মারক নং ৬১৮/ক/স্বী:/৯৫/(অংশ-১)৩৩৪) এ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। 

এতে বলা হয়েছে, বোর্ডের উপ-বিদ্যালয় পরিদর্শক আরিফুল হক এবং সহকারি কলেজ পরিদর্শক মোহাম্মদ লোকমান মুন্সী প্রতিষ্ঠানটি সরেজমিনে পরিদর্শনে যাবেন। এর আগে স্কুলটির অধ্যক্ষ ও পরিচালনা কমিটির সভাপতির বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ করেন সহকারি সিনিয়র শিক্ষক ফরিদা ইয়াসমিন।

অভিযোগে জানা যায়, বর্ণমালা স্কুলে অবৈধভাবে পরিচালনা কমিটি গঠন, ঘুষের বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি, জামায়াত সমর্থিত শিক্ষকদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে পদায়ন, কোচিং বাণিজ্য, উন্নয়নের নামে লাখ লাখ টাকা লোপাট, ভূয়া ভাউচারে লাখ লাখ টাকা লোপাট, পরীক্ষা ও কোচিং বাণিজ্যসহ অধ্যক্ষ ও সভাপতির স্বেচ্ছাচারিতায় সাধারণ শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা অতিষ্ঠ। বিদ্যালয়ের ফান্ডের কোটি কোটি টাকা লোপাট করে ইতোমধ্যে অধ্যক্ষসহ তার অনুসারীরা কোটি কোটি টাকা সম্পদের মালিক এবং সভাপতি শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। এসব বিষয়ে প্রতিবাদ করতে গেলেই শিক্ষকদের উপর নানাভাবে নির্যাতন চালানো হয়।

ঢাকা শিক্ষা বোর্ড সূত্র জানায়, গত ১৫ মার্চ মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড বর্ণমালা স্কুলের ১১ সদস্যবিশিষ্ট গভর্নিং বডির অনুমোদন দিয়েছে সেটাও বৈধভাবে করা হয়নি। ওই কমিটিতে চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ আলহাজ্ব আব্দুস সালামকে সভাপতি পদে মনোনীত করা হয়েছে। কমিটিতে বাকি যাদেরকে রাখা হয়েছে তারা সবাই সভাপতির অনুগত, সহচর এবং আত্মীয়। কমিটি করার ক্ষেত্রে সাধারণ শিক্ষকদের কোনো মতামত বা মনোনয়ন নেয়া হয়নি। 

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গভর্নিং বডি গঠনের ক্ষেত্রে নির্বাচন ব্যবস্থার নিয়ম থাকলেও গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বিনা নির্বাচনে জালিয়াতির মাধ্যমে একই ব্যক্তি (আব্দুস সালাম) সভাপতির পদ দখল করে আছেন। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে প্রতি মেয়াদেই জালিয়াতির মাধ্যমে ভূয়া কাগজপত্র দাখিল করে কমিটি অনুমোদন নেয়া হয়। যেটা নিয়ে শিক্ষক বা অবিভাবকরা কেউ মুখ খুললে নানাভাবে হয়রানি করা হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

অভিযোগে জানা গেছে, গভর্নিং বডির সভাপতির জন্য স্কুলে রয়েছে একটি চেম্বার। যেটা দেশের কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নেই। ওই চেম্বারে তিনি সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত মিটিং-সিটিং করে থাকেন। যেখানে স্থানীয় সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, অপরাধীদের আড্ডাও জমে। সভাপতির অফিস করার নামে সকাল বিকালের নাস্তা, দুপুরের খাবারের বিল বাবদ প্রতিদিন মোটা অংকের টাকা ভাউচারের মাধ্যমে নিয়ে থাকেন। এমনকি তার বাসার বাজারের খরচ, গাড়ির তেল, ড্রাইভারের বেতন স্কুলের ফান্ড থেকে নিয়ে থাকেন। স্কুলের কমপক্ষে ৬জন পিয়ন, আয়া তার বাসায় কাজ করে। এ ছাড়া সারাবছরই স্কুলের উন্নয়নের নামে স্কুলের ভবনগুলোতে ভাঙ্গাগড়ার খেলা চলে। বর্তমানে চার মাস আগে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের হস্তান্তর করা নতুন ৬ তলা ভবন ভেঙ্গে সংস্কার করা হচ্ছে। যেটা সরাসরি আইন লঙ্ঘন। এসব ক্ষেত্রে সভাপতির ভাইসহ অত্মীয়দের ঠিকাদারি দেয়া হয়। তারা তাদের খেয়ালখুশি মতো বিল করে টাকা নিয়ে যান।

এ ছাড়া মাসে মসে মানোন্নয়ন পরীক্ষার নামে শিক্ষার্থীদের কাছে থেকে ফি নিয়ে প্রতি মাসে কমপক্ষে ৫০ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেন সভাপতি ও অধ্যক্ষ। খন্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগেও ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা ঘুষ নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। শিক্ষার্থীদের আইডিকার্ড, ডায়েরী, ব্যাচ, পোশাক ইত্যাদির নামে টাকা আদায় করে স্কুলের ফান্ডে জমা না করে সিংহভাগই আত্মসাতের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। স্কুল ভবনের দুদিকে ২৭টি দোকান রয়েছে। প্রতিটি দোকান থেকে ৫/৬ লাখ টাকা করে অগ্রীম নেয়া হলেও সেগুলো স্কুলফান্ডে জমা করা হয়নি। এমনকি দোকানগুলো থেকে মাসে লক্ষাধিক টাকা ভাড়া ওঠে সেটাও যায় সভাপতির পকেটে। এর সাথে আছে কোচিং বাণিজ্য। যার সিংহভাগ আত্মসাত করেন সভাপতি। এই কোচিং বাণিজ্যের জন্য এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বাদ দিয়ে নন-এমপিও জুনিয়র শিক্ষকদের দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস করানো হয়। শুধু তাই নয়, একাডেমিক কাউন্সিল, পরীক্ষা কমিটি সদস্যরা সবাই নন-এমপিওভুক্ত জুনিয়র শিক্ষক। কোনো সিনিয়র শিক্ষককে এসব কমিটিতে রাখা হয় না।

অভিযোগে জানা গেছে, সভাপতি তার দুর্নীতির চাবিকাঠি হিসেবে জামায়াত সমর্থক শিক্ষকদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রেখেছেন। পঞ্চম, অস্টম, নবম, দশম, কলেজ শাখাসহ সহকারি প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে রয়েছেন জামায়াত সমর্থিত শিক্ষকরা। তাদের দাপটের কাছে আওয়ামী সমর্থক শিক্ষকরা দিশেহারা। অভিযোগে জানা যায়, বিধি অমান্য করে বিনা বিজ্ঞপ্তিতে সহকারি প্রধান শিক্ষক পদে খান নাসির উদ্দিন ও কুদ্দুসুর রহমানকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ দুজনের মধ্যে খান নাসির উদ্দিন কট্টর জামায়াত সমর্থক। তিনি কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে এখন হাউজিং ব্যবসায় ব্যস্ত। স্কুলে সময় দিতে পারেন না বলে নিয়ম ভঙ্গ করে আরও একজন সহকারি প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সব মিলে স্কুল সহকারি প্রধান শিক্ষক এখন তিনজন।

স্কুলের প্রতিমাসের কোটি কোটি টাকা আয়ের হিসাব একমাত্র সভাপতি ও অধ্যক্ষ ছাড়া কেউই জানে না। কোটি কোটি টাকার অনিয়মের সাক্ষী হিসাব রক্ষক সিরাজুল ইসলাম। চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পরেও তাকে দ্বিগুণ বেতনে চুৃক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

এদিকে, অধ্যক্ষ ভূঁইয়া আবদুর রহমানের সার্টিফিকেট নিয়ে জটিলতা থাকার পরেও শুধুমাত্র জামায়াত সমর্থক হওয়ায় তাকে অধ্যক্ষ পদে বসানো হয়েছে। অধ্যক্ষ অনার্সে তৃতীয় শ্রেণি পেয়েছেন। তিনি মাস্টার্স পাশ করার পর অনার্স মান উন্নয়ন পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় বিভাগ পান। যার কারণে তার মাস্টার্সের সার্টিফিকেটের কার্যকারিতা আর থাকে না।

এক যুগেরও বেশি সময় ধরে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির মাধ্যমে অধ্যক্ষ ভূঁইয়া আব্দুর রহমান ঢাকায় ৭/৮টি ফ্ল্যাটের মালিক। গ্রামের বাড়িতেও তিনি বিশাল মার্কেটসহ বিলাসবহুল বাড়ি করেছেন। আর সভাপতি আবদুস সালাম বিগত এক যুগে শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। দুর্নীতির টাকা দিয়ে কমপক্ষে ২শ’ বিঘা জমি কিনেছেন। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জের রুপগঞ্জ থানার নুরুল হক মার্কেটের পাশে দেবৈ মৌজায় ৫ বিঘা, সোনারগাঁওয়ের মুড়াপাড়া মৌজায় ১০ বিঘা এবং বর্ণমালা স্কুলের ৩০ গজ পশ্চিমে ১ বিঘা জমির কথা সবারই জানা। এর বাইরে নরসিংদীর পাঁচদোনা মৌজা ও কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে ১৮৫ বিঘা জমি কিনেছেন। গত বছর তিনি তার মেয়ের নামে কানাডায় আলিশান বাড়ি কিনেছেন। ছেলেকে পাঠিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানেও বিপুল অঙ্কের টাকা পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

এসি