ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

মস্তিষ্কের ক্ষমতা ও মনের শক্তিকে সুতীক্ষ্ণ করে মেডিটেশন

ডা. আয়েশা হান্না

প্রকাশিত : ০৬:৫৩ পিএম, ১৯ মে ২০২২ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০৮:০৮ পিএম, ২৪ মে ২০২২ মঙ্গলবার

২১ মে সারা বিশ্বে উদযাপিত হচ্ছে বিশ্ব মেডিটেশন দিবস। বাংলাদেশেও সাড়ম্বরে বিশ্ব মেডিটেশন দিবস পালিত হবে। এবারের প্রতিপাদ্য ‘ভালো মানুষ ভালো দেশ স্বর্গভূমি বাংলাদেশ’।

সুস্থ দেহের জন্যে যেমন ব্যায়ামের প্রয়োজন, তেমনি মনের সার্বিক সুস্থতার জন্যে প্রয়োজন নিয়মিত মেডিটেশন চর্চার। অর্থাৎ নিয়মিত মেডিটেশন মনটাকে রাগ ক্ষোভ ঘৃণা হতাশা বিষণ্নতা দুঃখসহ সব রকম মানসিক চাপ বা স্ট্রেস থেকে মুক্ত রাখে। ফলে একজন মানুষ সুস্থ ও ভালো মানুষ হওয়ার পথে এগিয়ে যায় সহজেই। আর অসংখ্য ভালো মানুষ নিয়েই তো একটি ভালো দেশ।

মাইন্ড অব দ্য মেডিটেটর শিরোনামে একটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে খ্যাতনামা বিজ্ঞান-সাময়িকী সায়েন্টিফিক আমেরিকান। মেডিটেশনের বিভিন্ন দিক নিয়ে নিউরোসায়েন্টিস্টদের সর্বশেষ গবেষণা ও তথ্য-উপাত্তের আলোকে রচিত এ নিবন্ধটি যৌথভাবে লিখেছেন ম্যাথু রিকার্ড, অ্যান্টনি লাট্জ ও রিচার্ড জে ডেভিডসন।

একসময় সেলুলার বায়োলজিস্ট হিসেবে কাজ করলেও বর্তমানে ম্যাথু রিকার্ড একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী। বছর চল্লিশেক আগে তিনি ফ্রান্স ছেড়ে হিমালয়ে পাড়ি জমান এবং বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হন। 

ফ্রেঞ্চ ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ এন্ড মেডিকেল রিসার্চ এবং যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন-ম্যাডিসন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক-বিজ্ঞানী অ্যান্টনি লাট্জ। তিনি নিউরো-বায়োলজি অব মেডিটেশন বিষয়ক দীর্ঘ গবেষণায় নেতৃত্ব দেন।

এ-ছাড়াও উইসকনসিন-ম্যাডিসন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েজমেন ল্যাবরেটরি ফর ব্রেন ইমেজিং এন্ড বিহেভিয়ার এবং সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিং হেলদি মাইন্ডস-এর পরিচালক রিচার্ড জে ডেভিডসন মেডিটেশন ও বিজ্ঞান-বিষয়ক গবেষণায় একজন পুরোধা বিজ্ঞানী।

আলোচ্য নিবন্ধটির ভূমিকায় বলা হয়েছে, ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসি-তে অনুষ্ঠিত হয় সোসাইটি ফর নিউরোসায়েন্সের বার্ষিক সম্মেলন। আর তাতে আলোচনার জন্যে আমন্ত্রণ জানানো হয় তিব্বতীয় বৌদ্ধশাস্ত্রের আধ্যাত্মিক নেতা ১৪ তম দালাই লামা ও সাধক তেনজিন গ্যাৎসোকে। কিন্তু সোসাইটির অন্তত কয়েকশ সদস্য এতে আপত্তি জানান। তাদের বক্তব্য ছিল, এমন একটি বিজ্ঞান সম্মেলনে ধর্মীয় নেতার অবস্থান বা তার কথার গুরুত্ব কতখানি? একপর্যায়ে তারা এ আমন্ত্রণ বাতিলের দাবি পর্যন্ত তোলেন। 

যা-হোক, পরে দালাই লামা অবশ্য আলোচনা করেন এবং বিরোধী মতের বিজ্ঞানীদের ধারণায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে যখন তিনি প্রাচীন ভারতীয় দর্শন ও এর চিরায়ত আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য, বিশেষত মেডিটেশনকে আধুনিক বিজ্ঞানের আলোকে ব্যাখ্যা ও উপস্থাপন করেন।

কেন মেডিটেশন
পৃথিবীর সব প্রধান ধর্মেই গুরুত্বের সাথে মেডিটেশনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মেডিটশন বা ধ্যান প্রকৃত অর্থে এমন একটি নিমগ্ন চর্চার বিষয়, যা মানুষের মানবীয় গুণাবলির বিকাশ ঘটায়। মানুষকে ধীর স্থির এবং তার মনকে স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন করে তোলে। আবেগীয় ভারসাম্য বজায় রাখে। মনোযোগকে করে লক্ষ্যভেদী। হৃদয়ে সৃষ্টি করে গভীর কল্যাণচেতনা, ভালবাসা, সমমর্মিতা। সবমিলিয়ে আমরা বলতে পারি, সবদিক থেকে ভালো থাকার জন্যে মেডিটেশন একটি সহজ উপায়।

আর মেডিটেশন এখন নিছক ধর্মীয় কোনো বিষয় নয়। সারা পৃথিবীতেই আজ এটি জীবনচর্চার একটি বহুল প্রচলিত ও জনপ্রিয় অনুষঙ্গ, যা নিয়মিত অনুশীলনে মস্তিষ্কের ক্ষমতা ও মনের শক্তি হয়ে ওঠে সুতীক্ষ্ন ও সুসংহত। তাই এর চর্চা আজ বিশ্বব্যাপী সর্বত্র, এমনকি স্কুল থেকে হাসপাতাল পর্যন্ত।

গবেষণায় দেখা গেছে, মেডিটেশন মানুষকে সচেতন করে তোলে সার্বিকভাবে এবং বদলাতে সাহায্য করে মনোদৈহিক অস্তিত্বের একেবারে ভেতর থেকে। আমাদের দেহকোষ ও শারীরবৃত্তীয় কর্মকাণ্ড এর দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়। ফলে এটি নিরাময়ে রাখে বিশেষ ভূমিকা। উচ্চতর গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, দীর্ঘদিনের ব্যথা-বেদনা থেকে শুরু করে বিষণ্নতা প্রতিরোধ ও প্রতিকারে এর ভূমিকা রয়েছে।

মস্তিষ্কের গঠন ও কর্মকাঠামোতে ঘটে ইতিবাচক পরিবর্তন
মস্তিষ্কের গঠন ও কর্মকাঠামোতে ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা করে মেডিটেশন। যখন আমরা জাগলিং বা এ ধরনের কোনো কৌশল আয়ত্ত করি কিংবা কোনো বাদ্যযন্ত্র চালনায় দক্ষতা অর্জন করি, তখন আমাদের নিউরোপ্লাস্টিসিটি বাড়ে অর্থাৎ মস্তিষ্কের নিউরোনগুলোর মধ্যে বহুগুণে বাড়ে আন্তঃপারস্পরিক যোগাযোগ। 

আর মস্তিষ্কের যে অংশ এটি (বিভিন্ন কৌশল ও বাদ্যযন্ত্র চালনা) নিয়ন্ত্রণ করে, সে অংশের পুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। একাধিক গবেষণায় নিশ্চিত হয়ে এ শতকের শুরু থেকেই নিউরোসায়েন্টিস্টরা বলছেন, নিয়মিত মেডিটেশন চর্চার ফলে একই ঘটনা ঘটে। শুধু তা-ই নয়, এর পাশাপাশি মেডিটেশন চর্চাকারী শরীর-মনে উপভোগ করেন ভালো থাকার এক অভূতপূর্ব অনুরণন, যা মনকে প্রশান্ত করে। সব ধরনের স্ট্রেস থেকে মুক্ত করে। সেইসাথে সারা শরীরে ছড়িয়ে দেয় সুস্বাস্থ্যের এক দারুণ অনুভূতি, যা তার নিরাময় ও সার্বিক সুস্থতাকে নিশ্চিত করে।

মানসিক প্রশান্তি আর ব্যথামুক্তির অনুভূতি হয় মেডিটেশনে
বিক্ষিপ্ত আর ইতস্তত ঘুরে বেড়ানো মনকে প্রশান্ত করে মেডিটেশন। সাধকরা কথাটা বলছেন হাজার বছর ধরেই। বিজ্ঞানীরা বুঝতে শুরু করেছেন সম্প্রতি, বড়জোর কয়েক দশক। প্রতিদিন নানা কারণে চারপাশে কী হচ্ছে, ঘটছে, চলছে কিংবা কর্মক্ষেত্রে অসহযোগী সহকর্মী বা বাড়িতে দুরন্ত সন্তানের চিন্তা, এমন অসংখ্য নানামুখী ভাবনায় আচ্ছন্ন থাকে আমাদের মন। ব্যাহত হয় আমাদের মনোযোগ আর কাজ। মেডিটেশনকেই এর কার্যকর সমাধান হিসেবে রায় দিচ্ছেন আধুনিক মনোবিদ ও বিজ্ঞানীরা।

মেডিটেশনে ব্যথামুক্তির অনুভূতি সৃষ্টি হয়। এমনটাই জানাচ্ছেন গবেষকরা। তারা বলছেন, ব্যথা যেমনই হোক, অন্যান্যদের চেয়ে মেডিটেশন চর্চাকারীরা তা অনুভব করেন তুলনামূলক কম। এ-ছাড়াও যে-কোনো ধরনের সংক্রমণের ঝুঁকিও তাদের ক্ষেত্রে কম। সেইসাথে তাদের শরীরে স্ট্রেস হরমোনের প্রবাহ হ্রাস পায় বলে স্ট্রেসজনিত রোগ থেকে তারা তুলনামূলক মুক্ত থাকেন। তাদের ঘুম ভালো হয়।

এসব কারণে বিষণœতার হার বেশ কমে যায় নিয়মিত মেডিটেশনে। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট জন টিসডেইল ও টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক জিন্দেল সেগাল ২০০০ সালে পরিচালিত একটি গবেষণায় প্রমাণ করেন যে, বিষণ্ণতার রোগীদের ক্ষেত্রে ছয় মাস নিয়মিত মেডিটেশন বিষণ্ণতা উপশমে সহায়ক।

মমতা ও সমমর্মিতাপূর্ণ সুখী জীবনের পথে
নিয়মিত মেডিটেশন করেন যারা, তাদের মনোজগত ও দৃষ্টিভঙ্গিতে ঘটে গভীর পরিবর্তন। হৃদয় পূর্ণ হয়ে ওঠে মমতা ও সমমর্মিতায়, তা কেবল নিজের পরিবারের সদস্য ও আপনজনদের জন্যে নয়, এমনকি হতে পারে খোদ শত্রুর জন্যেও। অন্যের প্রয়োজন ও চাহিদা তাদের কাছে গুরুত্ব পায় অনেক বেশি। 

আর এ অনুভূতিটা হয় নিঃস্বার্থ ও নিঃশর্ত। দৃষ্টিভঙ্গির জগতে ঘটে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি জীবনকে করে তোলে প্রশান্ত, স্থির। ইতিবাচক আবেগের প্রাবল্য বৃদ্ধি পায়। পরিবর্তনের সূচনা ঘটে মস্তিষ্কের গঠন ও কর্মপন্থায়। ইলেক্ট্রো-এনসেফালোগ্রাফ যন্ত্রের সাহায্যে পরীক্ষার মাধ্যমে এটি প্রমাণিত হয়েছে।

বিশ্বজুড়ে এমন অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা আর বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গবেষকরা তাই বলছেন, নিয়মিত মেডিটেশন করুন। শারীরিক-মানসিক সুস্বাস্থ্য অর্জনসহ সবদিকেই আপনি ভালো থাকবেন। এগিয়ে যাবেন কর্মপ্রাণ সুখী জীবনের পথে।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান প্লাস্টিক সার্জারি ডিপার্টমেন্ট, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল।

এসি