ঢাকা, সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১

চীনা কারাগারে হাজারো বন্দির তথ্য ফাঁস 

একুশে টেলিভিশন  

প্রকাশিত : ০৫:৫৮ পিএম, ২৪ মে ২০২২ মঙ্গলবার

চীনের জিনজিয়ানের একটি গোপন কারাগারের পুলিশের কম্পিউটার সার্ভার থেকে কিছু চাঞ্চল্যকর নথি ফাঁস হয়েছে, যাতে হাজারো বন্দির ছবি এবং যারা পালানোর চেষ্টা করেছে তাদের হত্যা সম্পর্কিত তথ্য রয়েছে।  

ফাঁস হওয়া পুলিশি নথিগুলো এ বছরের শুরুতে বিবিসির হাতে আসার পর মাসব্যাপী তদন্ত শেষে উইঘুর এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের বন্দিদশা সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য তথ্য উঠে আসে। 

নথিগুলোর উৎস দাবি করেছে, জিনজিয়ানের বেশ কয়েকটি পুলিশ কম্পিউটার সার্ভার থেকে সেগুলো হ্যাকড করা হয়েছে। 

ফাঁস হওয়া নথি থেকে ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাইয়ের মধ্যে পুলিশের তোলা উইঘুরের পাঁচ হাজারের বেশি মানুষের ছবি পাওয়া গেছে।  

বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে ধারণা করা হচ্ছে, তাদের মধ্যে ২ হাজার ৮৮৪ জনকে বন্দি করা হয়েছে।

ছবি: বিবিসি

এর মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক নারী বন্দি ৭৩ বছর বয়সী আনিহান হামিত আর সবচেয়ে কম বয়সী কিশোরী রাহিল ওমর, যাকে মাত্র ১৫ বছর বয়সে আটক করা হয়েছিল। 

ছবি: বিবিসি

এই তালিকাভুক্ত বন্দিরা পুন:শিক্ষা ক্যাম্পে আছে বলে বিবিসি জানিয়েছে। তবে বিভিন্ন ছবিতে বন্দিদের অভিব্যক্তি বলে দেয় তারা ইচ্ছাকৃতভাবে সেখানে নেই। কারণ কিছু শিক্ষা ক্যাম্পের সামনের ছবি পাওয়া গেছে, যেখানে সশস্ত্র রক্ষীদের পাহারা দিতে দেখা গেছে। 

ছবি: বিবিসি

চীনে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়ে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ২০১৯ সালে বলেছিলেন, “জিনজিয়ানের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে মানুষকে চরমপন্থী মনমানসিকতা থেকে মুক্ত হতে সহায়তা করে।“

নথিগুলো প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কমিউনিজম মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনের বিশেষজ্ঞ ড. আদ্রিয়ান জেনজের কাছে আসে, যিনি এক সময় চীনা সরকারের অনুমোদন পেয়েছিলেন জিনজিয়ানের গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার জন্য। 

এরপরেই ড. জেনজ এই নথিগুলো বিবিসিকে দেন। নথির তথ্যদাতার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা গেলেও তারা পরিচয় জানাতে রাজি হননি বলে জানিয়েছে বিবিসি। 

ড. জেনজ সব নথি পর্যালোচনার তথ্য দিয়ে ইউরোপিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর চাইনিজ স্টাডিজ জার্নালের জন্য একটি প্রবন্ধও লিখেছেন। এছাড়া বন্দিদের ছবিসহ অন্যান্য প্রমাণের সব নথি অনলাইনে সংরক্ষণ করেছেন। 

ছবি: বিবিসি

জেনজ বলেন, “আমাদের কাছে আরও গোপন নথি রয়েছে, বক্তৃতার প্রতিলিপি রয়েছে, যেখানে চীনা নেতারা আসলে কী ভাবেন তা নিয়েও তথ্য-প্রমাণ রয়েছে, যা চীনের প্রচার করা তথ্যকে মিথ্যা প্রমাণ করতেও যথেষ্ট।”

“এমন কিছু তথ্য-প্রমাণও রয়েছে যেখানে পুনঃশিক্ষা শিবিরের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে, যেগুলোকে চীন দাবি করে বৃত্তিমূলক বিদ্যালয় হিসাবে।”

ওই নথিতে অভ্যন্তরীণ পুলিশ প্রোটোকলের একটি দলের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের বর্ণনা রয়েছে। সেখানে ওয়াচটাওয়ারে মেশিনগান এবং স্নাইপার রাইফেলের অবস্থান ও পলায়নরতদের গুলি করে হত্যার কথা রয়েছে। 

২০১৩ ও ২০১৪ সালে বেইজিং ও কুনমিং শহরে পথচারী এবং যাত্রীদের লক্ষ্য করে দুটি ভয়াবহ হামলার ঘটনা ঘটে। যার জন্য উইঘুর বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং উগ্র ইসলামপন্থীদের দায়ী করা হয়। 

এরপর থেকে উইঘুর সংস্কৃতিকেই মূল সমস্যা হিসাবে দেখতে শুরু করে জিনজিয়ানবাসী। এর কয়েক বছরের মধ্যে উপগ্রহ থেকে পাওয়া ছবিতে ওই রাজ্যে শত শত পুন:শিক্ষা শিবির দেখতে পাওয়া যায়। যেখানে উইঘুর সম্প্রদায়ের বহু মানুষকে বিনাবিচারে পাঠানো হয়েছিল। 

ছবি: বিবিসি

এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে, বহু বছর, এমনকি কয়েক দশক আগে সংঘটিত ‘অপরাধের’ জন্য অনেক মানুষকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। যেমন ২০১০ সালে নানীর সঙ্গে ইসলামের ধর্মগ্রন্থ পাঠ করায় এক ব্যক্তিকে ২০১৭ সালে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। 

মোবাইল ফোন ব্যবহারের জন্যও অনেকে লক্ষবস্তুতে পরিণত হয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই ‘অবৈধ বক্তৃতা’ শোনা কিংবা বিভিন্ন অ্যাপ ইনস্টল করার জন্য। এসব কারণে অনেকে শাস্তি পেয়েছেন এক দশক পর্যন্তও। 

ড. জেনজের তথ্য বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়, একটি এলাকাতেই প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার ১২ শতাংশেরও বেশি, প্রায় ২২ হাজার ৭৬২ জন বাসিন্দা, যারা ২০১৭-১৮ সালে কারাগারে ছিলেন। যদিও বিষয়টি বরাবরই অস্বীকার করেছে চীন। 

১১টি দেশের ১৪টি সংবাদসংস্থার একটি কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে কাজ করে জিনজিয়াং নথিগুলোর তথ্য প্রমাণে সক্ষম হয়েছে বিবিসি। 

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমটির দাবি, ইউরোপ এবং আমেরিকার বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী উইঘুরদের কাছে তাদের নিখোঁজ স্বজনদের নাম ও আইডি নম্বর চাওয়া হয়েছিল। যার সাথে ফাঁস হওয়া নথির মিল রয়েছে। এতে প্রমাণ হয়, উইঘুরদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা সত্য। 

ফাঁস হওয়া তথ্য সম্পর্কে মন্তব্যের জন্য চীনা সরকারের কাছে যাওয়ার পর ওয়াশিংটন ডিসিতে চীনা দূতাবাস থেকে একটি লিখিত প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। 

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “জিনজিয়াং সম্পর্কিত সমস্যাগুলো সন্ত্রাসবাদ, মৌলবাদ এবং বিচ্ছিন্নতাবাদ মোকাবেলা চেষ্টার অংশ বিশেষ, মানবাধিকার বা ধর্মের বিষয়ে নয়।“

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “জিনজিয়াং সম্পর্কে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দেওয়া হচ্ছে।“

এসবি/