রক্ত কেন দেবেন? জেনে নিন কিছু জরুরি তথ্য
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৬:৩৬ পিএম, ৩০ মে ২০২২ সোমবার
রক্ত দিয়ে একজন মানুষকে বাঁচিয়ে তোলাকে পৃথিবীর ‘সর্বশ্রেষ্ঠ ও নি:স্বার্থ’ উপহার বলা হয়। এর মাধ্যমে মানসিক প্রশান্তিও লাভ করা যায়। সুস্থ, সবল, নিরোগ একজন মানুষ প্রতি চার মাস অন্তর রক্ত দিতে পারেন।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, রক্তদানের ফলে রক্তদাতার শারীরিক কোনো ক্ষতি হয় না। রক্তের লোহিত কণিকার আয়ু ১২০ দিন। অর্থাৎ আপনি রক্ত দিন বা না দিন ১২০ দিন পর লোহিত কণিকা আপনা আপনিই মরে যায়। সেখানে জায়গা করে নেয় নতুন লোহিত কণিকা। রক্তের আর উপাদানগুলোর আয়ুষ্কাল আরও কম।
এখন প্রশ্ন হলো একজন মানুষ তার জীবদ্দশায় কতজন মানুষকে বাঁচানোর ক্ষমতা রাখেন? অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক জেমস হ্যারিসন এমন এক ব্যক্তি যিনি একাই বাঁচিয়েছেন ২০ লাখ শিশুর প্রাণ।
এতোগুলো শিশুর প্রাণ বাঁচিয়েছেন স্বেচ্ছায় ও বিনামূল্যে নিজের রক্ত ও রক্তের উপাদান প্লাজমা দানের মাধ্যমে। এজন্য গিনেজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নিজের নামও লিখিয়েছেন তিনি।
মাত্র ১৪ বছর বয়সে জরুরি অস্ত্রোপচারের কারণে ১৩ লিটার রক্তের প্রয়োজন হয়েছিলো হ্যারিসনের। সে যাত্রায় রক্ত পেয়ে প্রাণ বেঁচে যায় তার। এরপর বয়স ১৮ বছর হতেই নিয়মিত রক্তদান করতে শুরু করেন তিনি।
রক্ত কেন দেবেন?
রক্তদানের বহুবিধ উপকারিতা রয়েছে। রক্তদান করার সাথে সাথে আমাদের শরীরের মধ্যে অবস্থিত ‘বোন ম্যারো’ নতুন কণিকা তৈরির জন্য উদ্দীপ্ত হয় এবং দান করার দুই সপ্তাহের মধ্যে নতুন রক্ত কণিকা জন্ম হয়ে এ ঘাটতি পূরণ করে। বছরে তিনবার রক্তদান রক্তদাতার লোহিত কণিকাগুলোর প্রাণবন্ততা বাড়িয়ে দেয় এবং শরীরে আয়রণের ভারসাম্য বজায় থাকে।
দুর্ঘটনায় আহত, ক্যান্সার বা অন্য কোন জটিল রোগে আক্রান্তদের জন্য, অস্ত্রোপচার কিংবা সন্তান প্রসব অথবা থ্যালাসেমিয়ার মতো বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় রক্ত সঞ্চালনের প্রয়োজন হয়। তবে বাংলাদেশে জনসংখ্যার তুলনায় রক্তদাতার সংখ্যা এখনো নগণ্য।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে বছরে নয় থেকে দশ লাখ ব্যাগ রক্তের চাহিদা থাকলেও রক্ত সংগ্রহ হয় ছয় থেকে সাড়ে ছয় লাখ ব্যাগ। ঘাটতি থাকে তিন লাখ ব্যাগের বেশি। এছাড়া সংগ্রহকৃত রক্তের মাত্র ৩০ শতাংশ আসে স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের থেকে।
নিজের পরিবারের সদস্য বা পরিচিতজন না হলে এখনো বেশিরভাগ মানুষ রক্তের জন্য নির্ভর করেন পেশাদার রক্তদাতার ওপর। রক্তের অভাবের কারণে প্রতিবছর বহু রোগীর প্রাণ সংকটের মুখ পড়ে। এক ব্যাগ রক্ত দিতে সময় লাগে মাত্র ১০ থেকে ১২ মিনিট। এই অল্প সময়ে চাইলেই একজনের প্রাণ বাঁচানো সম্ভব।
কারা রক্ত দিতে পারবেন?
চিকিৎসকদের মতে প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ নারী-পুরুষ চাইলেই নির্দিষ্ট সময় পরপর রক্ত দিতে পারেন।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের হেমাটোলজি বিভাগের প্রধান ড. সিরাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়সের মধ্যে শারীরিকভাবে সুস্থ নারী ও পুরুষ রক্ত দিতে সক্ষম।
এক্ষেত্রে পুরুষের ওজন থাকতে হবে অন্তত ৪৮ কেজি এবং নারীর অন্তত ৪৫ কেজি।
এছাড়া রক্তদানের সময় রক্তদাতার তাপমাত্রা ৯৯.৫ ফারেনহাইটের নিচে এবং নাড়ির গতি ৭০ থেকে ৯০ এর মধ্যে এবং রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকতে হবে। পুরুষদের ক্ষেত্রে রক্তের হিমোগ্লোবিন প্রতি ডেসিলিটারে ১৫ গ্রাম এবং নারীদের ক্ষেত্রে ১৪ গ্রাম হওয়া দরকার।
রক্তদাতাকে অবশ্যই ভাইরাসজনিত রোগ, শ্বাসযন্ত্রের রোগ এবং চর্মরোগ মুক্ত থাকতে হবে।
সাধারণত ৯০ দিন পর পর, অর্থাৎ তিন মাস পর পর রক্ত দেওয়া যাবে। সাধারণত প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মানুষের শরীরে ৪ থেকে ৬ লিটার পরিমাণ রক্ত থাকে। প্রতিবার ৪৫০ মিলিলিটার রক্ত দেয়া হয়।
এ কারণে রক্ত দিলে ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা একেবারেই নেই।
রক্ত দেয়ার পর কী হয়?
রক্ত দেয়ার পর কিছুটা মাথা ঘোরাতে পারে। এটা স্বাভাবিক। তবে এ সময় হাঁটাহাঁটি না করে অন্তত এক থেকে দুই ঘণ্টা বিশ্রাম নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। রক্তদাতা যদি ঘামতে থাকেন এবং অস্থিরতা হয়, তবে তাকে স্যালাইন খাওয়ানো যেতে পারে।
রক্ত দেয়ার পর লোহিত রক্তকণিকার মাত্রা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যেতে অন্তত এক থেকে দেড় মাস সময় লাগে। এ বিষয়ে ড. সিরাজুল ইসলাম বলেন, রক্ত দেয়ার সময় শরীর থেকে রক্তের পাশাপাশি ২৫০-৩০০ মিলিগ্রাম আয়রন কমে যায় তাই তার ক্ষয়পূরণে আয়রন ও প্রোটিনযুক্ত খাবার বেশি বেশি খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
কে কাকে রক্ত দিতে পারবে?
রক্তের গ্রুপ মোট ৮ ধরণের: এবি পজিটিভ, এবি নেগেটিভ, এ পজিটিভ, এ নেগেটিভ, বি পজিটিভ, বি নেগেটিভ, এবং ও পজিটিভ, ও নেগেটিভ।
জেনে নিন কে কাকে রক্ত দিতে পারবে?
রক্ত দেয়ার উপকারিতা:
দেশের বিভিন্ন ব্লাডব্যাংকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় নিয়মিত রক্ত দেয়ার কিছু উপকার রয়েছে। সেগুলো হলো:
১. এতে একজন মানুষের জীবন বাঁচানো সম্ভব।
২. নিয়মিত রক্তদাতাদের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে।
৩. বছরে তিনবার রক্ত দিলে শরীরে নতুন লোহিত কণিকা তৈরির হার বেড়ে যায়। এতে অস্থিমজ্জা সক্রিয় থাকে। দ্রুত রক্ত স্বল্পতা পূরণ হয়।
৪. রক্তে কোলেস্টরেলের মাত্রা কমে যায়, এতে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। ফলে হৃদরোগ ও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়।
৫. রক্ত দিলে যে ক্যালোরি খরচ হয়, তা ওজন কমানোর ক্ষেত্রে ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
৬. শরীরে হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি, জন্ডিস, ম্যালেরিয়া, সিফিলিস, এইচআইভি বা এইডসের মতো বড় কোন রোগ আছে কি না, সেটি বিনা খরচে জানা যায়।
৭. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।
৮. রক্তদাতার যদি নিজের কখনো রক্তের প্রয়োজন হয় তাহলে ব্লাড ব্যাংকগুলো তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে রক্তের ব্যবস্থা করে দেয়।
প্রতিবছর দেশে প্রায় সাড়ে ৯ লাখ ব্যাগ নিরাপদ ও সুস্থ রক্তের চাহিদা রয়েছে। এর বিপরীতে কেবল ৩০ শতাংশ আসে স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে। বাকি ৭০ শতাংশ আসে রক্তগ্রহীতার স্বজন, বন্ধু-বান্ধবসহ পরিচিতজনদের কাছে। সেখানেও ব্যর্থ হলে তারা পেশাদার রক্ত বিক্রেতার স্মরণাপন্ন হয়। তবে এদের রক্ত নিরাপদ নয়। কারণ আত্মীয় ও পরিচিতজনের রক্ত অনেকে প্রয়োজনীয় স্ক্রিনিং ছাড়াই রোগীর শরীরে দিতে চায় যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
এদিকে পেশাদার রক্ত বিক্রেতাদের রক্ত আরো বিপজ্জনক। তাদের রক্ত ব্যবহারের ফলে রোগীর দেহে ঘাতকব্যাধির জীবাণু সংক্রমিত হতে পারে। এজন্য স্বেচ্ছা রক্তদাতার রক্তই সবচেয়ে নিরাপদ। এ লক্ষ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্বেচ্ছায় রক্তদানের মাধ্যমে চাহিদার শতভাগ রক্তের সরবরাহ নিশ্চিত করতে প্রতিবছরের ১৪ জুন বিশ্ব রক্তদাতা দিবস পালন করে আসছে। যাতে সাধারণ মানুষকে রক্তদানে উৎসাহিত করা যায়।
এসি