ঢাকা, সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪,   পৌষ ৮ ১৪৩১

সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডি: দমকল বাহিনীর ৯ সদস্যের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা

শাহরিমা বৃতি

প্রকাশিত : ০৯:৪১ পিএম, ৭ জুন ২০২২ মঙ্গলবার

চট্টগ্রাম শহর থেকে ৩০ কিলোমিটারের দূরে সীতাকুণ্ডের কদমরসুল এলাকার বিএম কন্টেইনার ডিপোতে আগুন লাগে শনিবার রাত ৯টার দিকে। খবর পেয়ে সবার আগে ঘটনাস্থলে পৌঁছে সীতাকুণ্ড এবং কুমিরা ফায়ার স্টেশনের দমকল কর্মীরা। কিন্তু তাদের কেউ জানতেন না ঘটনাস্থলে রয়েছে রাসায়নিকের কন্টেইনার।

যে কারণে সাধারণ আগুন নেভানোর পদ্ধতিতেই এগিয়েছিলেন তারা। এতেই ঘটে বিপত্তি। আগুন ছড়িয়ে পড়লে একে একে ঘটে কন্টেইনার বিস্ফোরণ। আর সেই বিস্ফোরণে প্রাণ হারান দমকল বাহিনীর জলজ্যান্ত নয় জন সদস্য। তাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

ইমরান হোসেন মজুমদার
কুমিরা ফায়ার স্টেশনের মোট দমকল কর্মী ১৫ জন। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন ইমরান হোসেন মজুমদার। শনিবার আগুন লাগার পর যে দলটি প্রথম কুমিরা থেকে কন্টেইনার ডিপোর আগুন নেভাতে গিয়েছিলেন তাদের দলনেতা ছিলেন তিনি।

কিন্তু আগুন নেভাতে গিয়ে বিস্ফোরণ ঘটে, আর এর থেকেই নিখোঁজ হন তিনি। শেষ পর্যন্ত সোমবার দুপুরে পাওয়া যায় তার দগ্ধ মরদেহ।

ইমরানের মৃত্যুর খবরে শোকের মাতম তার পরিবারে। তার দুই সন্তানের মধ্যে ছেলে নয় বছরের, আর কন্যা পাঁচ বছরের, এই নিয়ে এখন দিশেহারা ইমরানের ছয় মাসের গর্ভবতী স্ত্রী। জানান, “এবারেও মেয়ে বাচ্চার খুব শখ ছিলো ইমরানের।”

চাঁদপুরের কচুয়ার বাসিন্দা ইমরান হোসেন মজুমদার ২০০১ সাল থেকেই কর্মরত ছিলেন দমকল বাহিনীতে।

রমজানুল ইসলাম
শেরপুরের বাসিন্দা রমজানুল ইসলামের বয়স ছিল মাত্র ২২ বছর। বছর দুই আগে দমকল বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন তিনি।

ছাত্র অবস্থায় চার বছর প্রেমের পর মাস ছয়েক আগে পারিবারিকভাবে বিয়ে করেছিলেন সাদিয়া আফরিনকে। কিন্তু চাকরির কারণে দুইজন ছিলেন দুই জেলায়।

সাদিয়া জানান, মাত্র এক মাস আগে সীতাকুণ্ডে ভাড়া বাসায় তারা নতুন সংসার পেতেছিলেন। কিন্তু এসবই যেন এখন স্বপ্ন।

ঘটনার দিন আগুনের খবর পেয়েই দ্রুত বেরিয়ে গিয়েছিলেন রমজানুল। যাওয়ার আগে স্ত্রীর কাছে পরনের গেঞ্জি চেয়েছিলেন তিনি। এটাই ছিল শেষ কথা।

মিঠু দেওয়ান
কুমিরা ফায়ার স্টেশনে কর্মরত ছিলেন মিঠু দেওয়ান। ঘটনার দিন তিনিও ছিলেন উদ্ধার তৎপরতার সম্মুখভাগে।

সহকর্মী মিঠুকে হারিয়ে শোকে স্তব্ধ বাকিরা। একজন জানান, গ্রামের বাড়ি রাঙামাটি থেকে আগেরদিনই কর্মস্থলে ফিরেছিলেন তিনি। ফেরার সময় সহকর্মীদের জন্য রাঙামাটির আনারস এনছিলেন তিনি।

আর এর পরদিনই সীতাকুণ্ডের আগুনের খবর আসে। সে সময় স্টেশনের টিম লিডার হিসেবে সেখানে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ফিরেছেন লাশ হয়ে।

আলাউদ্দিন
নিহত ফায়ার ফাইটার মো. আলাউদ্দিনের বাড়ি নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডে। বাবা আব্দুর রশিদ ছিলেন সাবেক ওয়ার্ড সদস্য। ভাইবোনের মধ্যে আলাউদ্দিন ছিলেন সেজো। ঘরে রয়েছে তার ৩ বছরের ছেলে সন্তান। তার মৃত্যুতে পরিবার পরিজনসহ গোটা এলাকায় নেমে এসেছে শোকের ছায়া।

সন্তান হারিয়ে পাগলপ্রায় আলাউদ্দিনের মা মমতাজ বেগম। আলাউদ্দিনের বড় ভাই নাসির উদ্দীন বলেন, আগুন লাগার পর প্রথম ইউনিটের সদস্য হিসেবে আগুন নেভাতে গিয়েছিলেন আলাউদ্দিন।
  
মনিরুজ্জামান
মাত্র ৭ দিন আগে কন্যা সন্তানের বাবা হয়েছিলেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সদস্য মো. মনিরুজ্জামান। ছুটি নিয়ে শিগগিরই মেয়েকে দেখতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মেয়ের মুখ না দেখেই বিদায় নিলেন তিনি।

সীতাকুণ্ডে কন্টেইনার ডিপোতে আগুন ও বিস্ফোরণের ঘটনায় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান চট্টগ্রামের কুমিরা ফায়ার সার্ভিস স্টেশনে নার্সিং অ্যাডেনটেন্ট মনিরুজ্জামান (৩২)। তার বাড়ি কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলার সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের নাইয়ারা গ্রামে।

তিনি বিয়ে করেছেন বরিশালে। স্ত্রী বাবার বাড়িতেই কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। এটিই তাদের প্রথম সন্তান।

নিপুন চাকমা


সীতাকুণ্ড ফায়ার স্টেশনের আরেক লিডার নিপুন চাকমা। এই অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে নিখোঁজ ছিলেন তিনি। তার বাড়িও রাঙামাটি। ঘটনার দিন আগুন নেভানোর কাজে যোগ দেয়ার পর থেকে তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করতে পারেননি সহকর্মীরা। পরে উদ্ধার করা হয় তার নিথর দেহ।

শাকিল তরফদার
সীতাকুণ্ডে কনটেইনার ডিপোতে আগুন নেভাতে গিয়ে নিহত হন ফায়ার ফাইটার শাকিল তরফদার। মৃত্যুর সংবাদে শাকিলের গ্রামের বাড়ি খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার সুখদারা গ্রামে চলছে শোকের মাতম।

ছেলের শোকে কাতর মা জেসমিন বেগম ও বাবা সাত্তার তরফদার। পরিবারের সদস্যরা জানান, শনিবার (৪ জুন) বিকেল ৫টায় মায়ের সঙ্গে ফোনে সবশেষ কথা হয় শাকিলের। এরপরেই আসে দুঃসংবাদ। 
শাকিলের বাবা সাত্তার তরফদার জানান, আসছে কোরবানির ঈদের পরেই বিয়ের কথা চলছিলো শাকিলের। কিন্তু কীভাবে কী হয়ে গেল, কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না তিনি।

২০১৮ সালের জুনে খুলনার কমার্স কলেজে পড়ার সময় ফায়ার সার্ভিসে চাকরি পান শাকিল। প্রথমে তিনি বটিয়াঘাটা ফায়ার স্টেশনে, পরে মোংলা ইপিজেডে ফায়ার স্টেশনে বদলি হন। সেখান থেকে ছয় মাস আগে তাকে চট্টগ্রামের কুমিরা ফায়ার স্টেশনে পাঠানো হয়।

সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী
ডিপোতে আগুনের ঘটনায় নিহত ফায়ার সার্ভিসকর্মী সালাউদ্দিনের বাড়ি ফেনী সদর উপজেলার ধলিয়া ইউনিয়নের মাছিমপুর গ্রামে। তিনিও সীতাকুণ্ড ফায়ার সার্ভিস ইউনিটে কর্মরত ছিলেন।

দুর্ঘটনার সময় তিনি সম্মুখভাগে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করছিলেন। যেকারণে বিস্ফোরণের সময় মৃত্যু হয় তার।

শনিবার রাত থেকে চেষ্টা করেও তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি পরিবারের সদস্যরা। পরে হাসপাতালের মর্গে পাওয়া যায় মরদেহ। প্রায় ১১ বছর ধরে ফায়ার সার্ভিসে কর্মরত ছিলেন তিনি। 

রানা মিয়া
কুমিরা ফায়ার স্টেশনের ফায়ার ফাইটার রানা মিয়া (২২)। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোর আগুন নেভাতে গিয়ে মারা যান তিনি।

রানা মিয়া শিবালয় উপজেলার নবগ্রামের পান্নু মিয়ার বড় ছেলে। চট্টগ্রামের কুমিরা ফায়ার স্টেশনে ফায়ার ফাইটার হিসেবে কর্মরত রানা ২০২০ সালে চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন।

এই অগ্নিকাণ্ডে এখনো নিখোঁজ রয়েছেন তিন জন দমকল কর্মী। আরও অনেকের চিকিৎসা চলছে হাসপাতালে। 

দমকল বাহিনীর তথ্যমতে, বাংলাদেশের ইতিহাসে অর্থাৎ ১৯৮১ সালে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স পূর্ণগঠনের পর থেকে এ পর্যন্ত সব মিলিয়ে ১৭ জন দমকল কর্মী মারা গেছেন। তবে দেশে একসঙ্গে এতজন দমকল কর্মীর প্রাণহানি এটাই প্রথম।

এনএস//