ঢাকা, সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪,   পৌষ ৮ ১৪৩১

দেশে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা

সোহাগ আশরাফ

প্রকাশিত : ১০:০৭ পিএম, ৭ জুন ২০২২ মঙ্গলবার | আপডেট: ০৮:৫২ এএম, ৮ জুন ২০২২ বুধবার

দেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। সেইসঙ্গে বেড়েছে প্রাণহানি ও হতাহতের সংখ্যাও। ত্রটিপূর্ণ ও মানহীন বৈদ্যুতিক উপকরণ ব্যবহার, রক্ষণাবেক্ষণে অবহেলা এবং সচেতনতার অভাব এই বিপর্যয় ডেকে আনছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

চলতি সপ্তাহে সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড দেশবাসী তথা বিশ্ববাসীকে হতবাক করে দিয়েছে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৪১ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে। এতে আহত হয়েছেন আরও প্রায় সাড়ে ৪শ’ জন মানুষ। যাদের অনেকেই জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। শনিবার (৪ জুন) রাত সাড়ে ৯টার দিকে লাগা আগুন নেভানো সম্ভব হয় মঙ্গলবার বিকেলে। 

শুধু সীতাকুণ্ডের এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাই নয়, চলতি সপ্তাহে চট্টগ্রামে বেশ কয়েকটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে অগ্নিকাণ্ডে একটি বাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এ সময় আগুনে দগ্ধ হয়ে ফোরকান (৪৬) নামে একজনের মৃত্যু হয়েছে। নিহত ফোরকান উপজেলার নাঙ্গলমোড়া ইউনিয়নের মোহাম্মদ আলীর ছেলে। শনিবার (৪ জুন) ভোর ৫টায় পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ডে এই আগুনের ঘটনা ঘটে।

অপরদিকে, বন্দরনগরীর চন্দনাইশে আগুনে পুড়ে গেছে দুটি বসতবাড়ি। এতে দুই বাড়ির চারটি পরিবারের নগদ অর্থ, আসবাবপত্র, বাড়ির তৈজসপত্র, গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র পুড়ে প্রায় ১৫ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। 

৬ জুন (সোমবার) রাত ৮টার দিকে দোহাজারী পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের হাজারী বাড়ি এলাকায় অরুন মাষ্টারের বাড়িতে এ ঘটনা ঘটে। 

এদিকে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৬টি ঘর পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এরমধ্যে ৪টি টিনের ও দু’টি পাকাঘর ছিল। এ ঘটনায় প্রায় ১৫ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো। রোববার (৫ জুন) দিনগত রাত ৩টার দিকে উপজেলার বড়কুল পূর্ব ইউনিয়নের মধ্য বড়কুল তোরাবালী বেপারী বাড়ির প্রবাসী সুমনের ঘর থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়।

দফায় দফায় এই অগ্নিকাণ্ডের রেশ কাটতে না কাটতেই রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বসিলায় আহমেদ ফুটওয়্যার লিমিটেড নামে একটি জুতা তৈরির কারখানায় আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিটের চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।

দমকল বাহিনী জানায়, সোমবার (৬ জুন) রাত সাড়ে ১০টার দিকে আহমেদ ফুটওয়্যার লিমিটেড নামে জুতার কারখানায় আগুন লাগে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রায় এক ঘণ্টার চেষ্টায় রাত পৌনে ১২টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ব্যবসায়ীরা দাবি করেছেন, এই আগুনে তাদের কয়েক লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।

এরপর আবারও চট্টগ্রামের মাদারবাড়ি এলাকায় জুতার কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

বুধবার (৮ জুন) ভোর ৫টা ৪৫ মিনিটে ফায়ার সার্ভিস আগুন লাগার সংবাদ পায়। এরপর ঘটনাস্থলে ৬টি ইউনিট গিয়ে সকাল ৭টা ২৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।

সব মিলিয়ে দেশে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা।

গত বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে সারা দেশে ২২ হাজার ২২২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। যা ২০২০ সালের দুর্ঘটনার চেয়ে ১ হাজার ৪৯টি বেশি। গত এক বছরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মোট ৩৩০ কোটি ১৫ লাখ ৩৩ হাজার ১৯০ টাকার অধিক ক্ষতি হয়েছে। 

আর এসব অগ্নিকাণ্ডের ফলে ২ হাজার ৫৮০ জন নিহত হন। আহত হন ১১ হাজার ৯৯৯ জন। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সদর দপ্তর থেকে এসব তথ্য প্রকাশ করা হয়। 

গত বছরে দেশের আলোচিত অগ্নিকাণ্ডের মধ্যে বছরের শেষে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে ঢাকা-বরগুনা লঞ্চে ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় ৪৫ জন নিহত হন। ১৮ ডিসেম্বর নাজিরাবাজার জুতার ফ্যাক্টরিতে আগুন, ১২ ডিসেম্বর সুরিটোলায় জুতার গোডাউনে, ১১ ডিসেম্বর রাজধানীর বাংলামোটর আর কে ভবনে আগুন, ৫ ডিসেম্বর রায়েরবাগ মশার কয়েল ফ্যাক্টরিতে আগুন লাগে। 

গত বছরের এপ্রিলে সবচেয়ে বেশি ২ হাজার ৮৬১টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ওই সময় ১৫০ জন নিহত হন। আহত হন এক হাজারেরও বেশি মানুষ। 

ঢাকা বিভাগে শিল্পপ্রতিষ্ঠান বেশি থাকা এবং আবাসিক এলাকায় কারখানা স্থাপন এবং দাহ্যপদার্থ রাখায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বেশি ঘটছে বলেই মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। 

২০১৭ সাল থেকে ২০২১ সাল- এই পাঁচ বছরে অগ্নিকাণ্ডের কারণে মোট ৩ হাজার ৯৩ জন নিহত এবং ১৩ হাজার ৮৬৩ জন আহত হন।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের গত পাঁচ বছরের তথ্য পর্যবেক্ষণ মতে, ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সবচেয়ে কম অগ্নিকাণ্ড ঘটে বরিশাল বিভাগে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্সের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান গণমাধ্যমকে বলেন, “আমাদের আধুনিক নগরায়ণ যত দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে, তত দ্রুততার সঙ্গে নিরাপত্তার বিষয়গুলো বাড়ছে না। দিনের পর দিন সুউচ্চ ভবনগুলো গড়ে উঠছে ইমারত নির্মাণবিধিকে উপেক্ষা করেই। এ বিষয়গুলো মনিটরিং করা হচ্ছে না। আবার যারা ইমারত নির্মাণ করছেন তারা কিছু টাকা আর জায়গা বাঁচাতে গিয়ে নিজেরাই আগুনজনিত দুর্ঘটনায় নিরাপত্তার বিষয়টি উপেক্ষা করেন। ফলে গায়ে গায়ে লেগে থাকা ইমারতের একটিতে আগুন লাগলে তা ছড়িয়ে যাচ্ছে আশপাশে।”

এই ধরণের অগ্নিকাণ্ড এড়াতে তিনি বেশ কিছু সুপারিশও করেন।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স থেকে জানা যায়, ছোটদের আগুন নিয়ে খেলা, যন্ত্রাংশের সংঘর্ষ, ত্রুটিপূর্ণ বৈদ্যুতিক সংযোগ ও বৈদ্যুতিক যন্ত্র, সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরো, খোলা বাতির ব্যবহার, চুলার আগুন, মিস ফায়ার, চিমনি, রাসায়নিক বিক্রিয়া, বাজি পোড়ানো ইত্যাদি কারণে আগুন লাগে। প্রায় প্রতি মাসেই একাধিক আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। 

বিশালসংখ্যক অগ্নিকাণ্ডের নেপথ্যে শহরে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট, বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশ (এসি, ফ্রিজ), গ্যাসের চুলাসহ আবাসিক এলাকায় দাহ্যপদার্থ রাখা ও কারখানা স্থাপনকে দায়ী করেছে সংস্থাটি।

সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞজনের মতে, অসচেতনতাই অগ্নিকাণ্ডের মূল কারণ। তাছাড়া শহরগুলো দ্রুত নগরায়ণ হলেও সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে না নগরের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের বিষয়। দিন দিন সুউচ্চ ভবনে শহর ভরলেও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা উপেক্ষিত। পরিবারের চুলা আর শর্ট সার্কিটের আগুনের বিষয় সচেতনতার ওপর গুরুত্ব দেন তারা। 

বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘এসব ক্ষেত্রে একটু সচেতন হলেই মূল্যবান জীবনের সঙ্গে অর্থসম্পদও রক্ষা করা সম্ভব।’

এসএ//এনএস//