স্ত্রীকে হত্যার অভিযোগ সদ্গুরুর বিরুদ্ধে
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৪:৩৯ পিএম, ১৩ জুন ২০২২ সোমবার
বহু দিন পর ফের খবরের শিরোনামে জগ্গি বাসুদেব ওরফে সদ্গুরু। ফের বিতর্কের কারণে। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে তাঁর ‘ইশা ফাউন্ডেশন’ এবং ভবিষ্যৎ কিছু প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন করায় অস্বস্তিতে পড়ে যান সদ্গুরু। রেগে গিয়ে সাক্ষাৎকারের মাঝেই ক্যামেরা বন্ধ করে দিতে বলেন।
কখনও সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের পক্ষে, কখনও নারীবাদের বিপক্ষে, কখনও বা ‘ইশা ফাউন্ডেশন’ নিয়ে বিতর্কে জড়িয়েছেন। বহু কারণেই খবরে থাকেন তিনি। কিন্তু কে এই জগ্গি বাসুদেব ওরফে সদ্গুরু?
১৯৫৭ সালে ৩ ডিসেম্বর মহীশূরে বাসুদেবের জন্ম। সুশীলা বাসুদেব এবং ভিবি বাসুদেবের পাঁচ সন্তানের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ জগ্গি বাসুদেব।
মাত্র ১৩ বছর বয়সেই তিনি মল্লাদিহাল্লি রাঘবেন্দ্র স্বামীর কাছে যোগ শিখতে শুরু করেন। ছোটবেলায় তার পড়াশোনা ডেমোনস্ট্রেশন স্কুলে। মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরাজিতে স্নাতক। কর্মজীবনের প্রথম দিকে মহীশূরের এক প্রত্যন্ত এলাকায় কিছু টাকা ধার নিয়ে প্রথমে একটি পোল্ট্রি ফার্ম খোলেন। ফার্মের কাজের পাশাপাশি নির্মাণ ব্যবসাও করেন।
২৫ বছর বয়সে নিজের ব্যবসা এক বন্ধুকে দেখাশোনা করতে দিয়ে বিশ্বভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন। পরে তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ব্যবসায় তিনি নেমেছিলেন টাকা উপার্জন করে বিশ্বভ্রমণ করবেন বলে। ১৯৭৪ সালে ঋষি প্রভাকরের কাছে তিনি ‘সমাধি যোগ’ শিখতে যান। কয়েক বছরের চেষ্টায় সেটি রপ্ত করেন বাসুদেব। এই যোগব্যায়ামই তার ‘ইশা যোগ’ নামে বিখ্যাত।
১৯৮২ সাল থেকে তিনি যোগ শেখাতে শুরু করেন। ১৯৮৩ সালে মহীশূরে সাত জন অনুগামীকে নিয়ে তাঁর প্রথম যোগ ক্লাস অনুষ্ঠিত হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার পরিসরও বাড়তে থাকে। ওই সময় কর্নাটক এবং হায়দরাবাদেও ক্লাস করান।
১৯৯২ সালে তিনি কোয়ম্বত্তূরে ‘ইশা ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে যোগ এবং আধ্যাত্মিক জীবনের পাঠ দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানের প্রধান এখনও পর্যন্ত জগ্গি বাসুদেবই। বিশ্বের বহু দেশে এই প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্র রয়েছে।
প্রতিষ্ঠানের সব রকম কাজই সম্পন্ন হয় স্বেচ্ছাসেবকদের দ্বারা। সূত্রের খবর, সব মিলিয়ে ‘ইশা ফাউন্ডেশনে’র হয়ে পুরো পৃথিবী জুড়ে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার স্থায়ী এবং প্রায় নব্বই লক্ষ অস্থায়ী স্বেচ্ছাসেবক কাজ করেন।
এই প্রতিষ্ঠান নিয়েও বেশ বিতর্কের মুখে পড়তে হয় সদ্গুরুকে। অনেকের অভিযোগ, কোয়ম্বত্তূরের পাহাড়ের কোলে তৈরি ‘ইশা ফাউন্ডেশনে’র সদর দফতরটি জঙ্গল নষ্ট করে অবৈধভাবে তৈরি।
কেন্দ্রটি কোয়ম্বত্তূরের হাতিদের জন্য সংরক্ষিত এলাকার ঠিক পাশেই। এ-ও অভিযোগ, কোনও রকম অনুমতি ছাড়াই সেখানে প্রতিষ্ঠানের একটি বিশাল জলাধার এবং বহু ঘরবাড়ি বানানো হয়েছে। এক অনুষ্ঠানে তাকে এক ছাত্রী এই বিষয়ে প্রশ্ন করায় ওই ছাত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকিও দিয়েছিলেন সদ্গুরু।
প্রতিষ্ঠানটির কেন্দ্রস্থলে একটি ১১২ ফুটের আদিযোগীর মূর্তি রয়েছে। ২০১৭ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মহাশিবরাত্রিতে এই বিতর্কিত কেন্দ্রটির উদ্বোধন করেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ঘটনাচক্রে সে বছরই সদ্গুরুকে যোগব্যায়াম এবং আধ্যাত্মিক জীবন নিয়ে চর্চার জন্য পদ্মবিভূষণে সম্মানিত করা হয়।
‘ইশা ফাউন্ডেশন’ ছাড়াও তার আরও বহু ছোট ছোট সংস্থা রয়েছে, যার মাধ্যমে তিনি দৈনন্দিন জীবনের নানা সামগ্রী থেকে শুরু করে প্রসাধনী— সব রকম পণ্যই বিক্রি করে থাকেন। কর্পোরেট বিষয়ক মন্ত্রণালয় অনুযায়ী, এই সব ব্যবসার মাধ্যমে সদ্গুরু ২০১৯-২০ সালে প্রায় ১২০ কোটি টাকা আয় করেছেন।
সূত্রের খবর, কেউ যদি চান মাত্র ৫০ লক্ষ টাকার বিনিময়ে তিনি কৈলাস যাত্রা করতে পারেন। সেই যাত্রায় তাকে সঙ্গে দেবেন সদ্গুরু নিজে। কম টাকার বিনিময়ে দলবদ্ধভাবে যাওয়ার সুযোগ-সুবিধাও রয়েছে।
১২ লক্ষ টাকার বিনিময়ে সদ্গুরুর সঙ্গে মোটরবাইকে চড়ে হিমালয়ের কোলে ঘোরার সুযোগও রয়েছে।
প্রতি বছর মহাশিবরাত্রিতে এক বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ‘ইশা ফাউন্ডেশন,’ যার টিকিট মূল্য ৫০ হাজার টাকা থেকে শুরু। এই সব কিছুর জন্য সদ্গুরুকে কোনও কর দিতে হয় না। সরকারের খাতায় ‘ইশা ফাউন্ডেশন’ একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান বা চ্যারিটি ট্রাস্ট।
সদ্গুরুর প্রতিষ্ঠানে কারও কাছ থেকে কোনও ফি নেওয়া হয় না। পুরো প্রতিষ্ঠানটিই চলে ভক্তদের দানের উপর নির্ভর করে। ২০১৮ সালে সদ্গুরুর ‘ইশা ফাউন্ডেশনে’র বিরুদ্ধে বহু মামলা হয়। তার মধ্যে আয়কর সংক্রান্ত মামলাও রয়েছে কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনওটির মীমাংসা হয়নি।
দেশে-বিদেশের বহু কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি আধ্যাত্মিক জীবন নিয়ে বক্তৃতা দেন। বেশ কয়েকটি বইও রচনা করেছেন। তার অনুগামীদের মধ্যে নেতা-মন্ত্রী থেকে সিনেমাজগতের অনেক তারকাও রয়েছেন।
সমালোচকদের মতে সদ্গুরু বিজেপির হিন্দুত্বের ধ্যানধারণা পোষণ করেন। তাকে অনেক সময়েই ক্যামেরার সামনে সেই ব্যাপারে স্পষ্ট বক্তব্য রাখতে শোনা গিয়েছে। যদিও সদ্গুরুর সমর্থক বা অনুগামীরা তেমন মনে করেন না।
কখনও বিজ্ঞান সম্পর্কিত বিষয়ে আলটপকা মন্তব্য, কখনও বালাকোটে বায়ুসেনার হানা, কখনও গোমাংসে নিষেধাজ্ঞা, কখনও ব্রিটিশ শাসনের সঙ্গে মোঘল সাম্রাজ্যের তুলনা করে বিতর্ক তৈরি করেছেন এই স্বঘোষিত আধ্যাত্মিক গুরু।
কয়েক বছর আগে কংগ্রেসের তৎকালীন আইটি সেলের প্রধান দিব্যা স্পন্দনা নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের একটি রিপোর্ট টুইট করেছিলেন। যে রিপোর্টে দাবি করা হয়, স্ত্রী-র খুনে অভিযুক্ত হয়েছিলেন সদ্গুরু।
১০ অক্টোবর ১৯৯৭ সালের ওই রিপোর্টিংয়ে দাবি করা হয়, সে বছরই সদ্গুরুর বিরুদ্ধে কোয়মবত্তূর থানায় তাঁর শ্বশুর অভিযোগ করেছিলেন। অভিযোগে বলা হয়, স্ত্রীকে খুন করেছেন সদ্গুরু।
সদ্গুরুর স্ত্রী বিজিকে খুন করা হয় বলে দাবি করা করেন বিজির বাবা। তিনি পুলিশে অভিযোগ করে বলেন, আশ্রমের অন্য কারও সঙ্গে বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে ছিলেন সদ্গুরু। পথের কাঁটা স্ত্রীকে সরাতেই খুন করা হয়।
বিজির বাবার অভিযোগ ছিল, তাঁদের ধর্মে মৃতদেহ দাহ করার রীতি নেই। কিন্তু তড়িঘড়ি প্রমাণ লোপাটের জন্যই বিজির দেহ দাহ করা হয়। যদিও সদ্গুরুর দাবি ছিল, তার স্ত্রীর ‘মহাসমাধি’ হয়েছে। যদিও সদ্গুরুর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করা যায়নি বলে দাবি করে পুলিশ।
সদ্গুরু বিতর্কিত মন্তব্য করেছিলেন জেএনইউয়ের তৎকালীন ছাত্রনেতা উমর খালিদ এবং কানহাইয়া কুমারকে নিয়েও। বলেছিলেন, ‘‘এরা স্বাধীন ভাবে রাস্তায় হাঁটে কী করে!’’ যে মন্তব্যের পরও সমালোচনা হয়।
বিতর্ক রয়েছে। একই সঙ্গে সদ্গুরুর সমর্থনও রয়েছে বিপুল। তার ইউটিউব বক্তৃতারও লক্ষ লক্ষ ভিউ হয়। সূত্র: আনন্দবাজার
এসি