ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

আপনার ডিজিটাল যমজ তৈরি করা যেতে পারে এই দশকেই

একুশে টেলিভিশন  

প্রকাশিত : ১২:২৯ পিএম, ১৪ জুন ২০২২ মঙ্গলবার

একদম হুবহু আমার মতো একটা লোককে রাস্তায় দেখা গেছে, যার সঙ্গে নাকি আমার চেহারার অদ্ভূত মিল আছে- এরকম গল্প হয়তো আমাদের বেশিরভাগই কোন না কোন বন্ধুর কাছে শুনেছি।

কিন্তু আপনি নিজেই যদি আপনার যমজ তৈরি করতে পারেন, একেবারে হুবহু আপনার মতো দেখতে, তবে কেবলমাত্র ডিজিটাল জগতে - তখন ব্যাপারটা কেমন হবে কল্পনা করুন।

আমরা এমন এক যুগে বাস করছি, যখন আমাদের বাস্তব জগতে যা কিছু আছে তার সবকিছুরই ডিজিটাল কপি তৈরি হচ্ছে - আমাদের শহর, আমাদের গাড়ি, বাড়ি এবং এখন এমনকি আমাদেরও!

মেটাভার্স নিয়ে অনেকদিন ধরেই ব্যাপক আলোচনা চলছে। এটি নাকি হবে এমন এক ত্রিমাত্রিক ভার্চুয়াল জগত, যেখানে আপনার এক অবতার বা প্রতিমূর্তি ঘুরে বেড়াবে। মেটাভার্সের পর এখন প্রযুক্তি দুনিয়ায় মানুষের ডিজিটাল যমজ কিভাবে তৈরি করা যায়, সেটা নিয়েও শুরু হয়েছে আলোচনা।

ডিজিটাল যমজ বলতে বোঝানো হচ্ছে বাস্তব পৃথিবীর কোন মানুষের হুবহু কপি, তবে এর একটা অনন্য উদ্দেশ্য থাকবে- বাস্তব জগতের মানুষটির কিভাবে আরও উন্নয়ন ঘটানো যায় অথবা তাকে বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানানো যায়।

শুরুর দিকে এরকম ডিজিটাল যমজরা হবে বাস্তব মানুষদের কম্পিউটারের তৈরি করা অত্যাধুনিক ত্রিমাত্রিক প্রতিমূর্তি। তবে এর সঙ্গে যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) এবং ইন্টারনেট অব থিংস (যেখানে ঘরে-বাইরে দৈনন্দিন জীবনের সব জিনিসই ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত থাকবে) যুক্ত হবে, তখন ব্যাপারটা ভিন্ন মাত্রায় পৌঁছে যাবে। তখন আপনি ডিজিটাল প্রযুক্তি দিয়ে এমন যমজ তৈরি করতে পারবেন, যে বাস্তব মানুষটির কাছ থেকে সারাক্ষণ শিখবে এবং এরপর সেই শিক্ষা কাজে লাগবে বাস্তব মানুষটির উন্নতি সাধনে।

প্রযুক্তি বিশ্লেষক রব এনডার্লির ধারণা, এই দশক শেষ হওয়ার আগেই আমরা মানুষের এমন ডিজিটাল সংস্করণ পেয়ে যাবে, যারা চিন্তা করতে পারে।

"তবে এগুলো উদ্ভাবনের আগে আমাদের প্রচুর চিন্তা করতে হবে, নৈতিক বিষয়গুলো ভেবে দেখতে হবে। কারণ আমাদের ডিজিটাল যমজ যখন চিন্তার সক্ষমতা অর্জন করবে, তখন সেটি আমাদের চাকুরিদাতাদের বিরাট কাজে লাগবে", বলছেন তিনি।

"আপনার কোম্পানি যদি আপনার একটা ডিজিটাল যমজ তৈরি করে বলে, দেখ, আমরা তোমার একটা ডিজিটাল কপি পেয়েছি, যাকে আমাদের কোন বেতন দিতে হয় না, তোমাকে আমরা আর কেন রাখবো- তখন কী হবে?"

মি. এনডার্লি বলেন, মেটাভার্সের যুগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হবে- এরকম ডিজিটাল যমজের মালিকানা কার হাতে থাকবে, সেই প্রশ্ন।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের গবেষক অধ্যাপক সান্দ্রা ওয়াকটার বলছেন,মানুষের ডিজিটাল যমজ সৃষ্টির জন্য আকর্ষণটা কোথায়, সেটা তিনি বুঝতে পারেন।

অধ্যাপক সান্দ্রা ওয়াকটার বলেন, জীবনে কে কী হবে, আইন পড়ে কেউ সফল আইনজীবী হবে, নাকি অপরাধী হবে, নাকি অসুস্থতায় ভুগবে-সেটা কিসের ওপর নির্ভর করবে, সেই বিতর্ক কিন্তু আগের জায়গাতেই আছে। কোন মানুষ জীবনে যা হয়, সেটা তার স্বভাবজাত প্রকৃতির কারণে, নাকি সেভাবে তাকে গড়ে তোলার জন্য -বিতর্কটা এখনো সেখানে।

"এটা এখনো সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যের ওপর, বন্ধু, পরিবার, তাদের সামাজিক-অর্থনৈতিক পটভূমি এবং পরিবেশ, এবং অবশ্যই তাদের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ওপর নির্ভর করবে,"- বলছেন তিনি।

অধ্যাপক ওয়াকটার বলেন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স বা এআই এখনো এধরণের একক সামাজিক বিষয়ের পূর্বাভাস দেয়ার ক্ষেত্রে খুব সফল নয়, কারণে এগুলো অর্ন্তনিহিতভাবেই বেশ জটিল।

"কাজেই একজন মানুষের একেবারে শুরু থেকে জীবনের শেষ পর্যন্ত বোঝা এবং সেটার একটা মডেল তৈরি করা, সেটা কোনদিন সম্ভব হবে কিনা, তা জানতে হলে আমাদের আরও অনেকদূর যেতে হবে।"

কাজেই এই ডিজিটাল যমজের ব্যবহার বরং এখন ব্যাপক এবং ভালোভাবে হচ্ছে পণ্যের ডিজাইন, বিতরণ এবং নগর-পরিকল্পনার ক্ষেত্রে।

আর আমাদের শহরগুলোকে এখন আরও বেশি করে ডিজিটাল দুনিয়ায় তৈরি করা হচ্ছে। সাংহাই এবং সিঙ্গাপুর- এই দুটি নগরীরই ডিজিটাল যমজ আছে।

এগুলো তৈরি করা হয়েছে শহরের দালান-কোঠা, পরিবহন ব্যবস্থা এবং রাস্তার নকশা থেকে শুরু করে নগর পরিচালনার কাজ যেন আরও উন্নত করা যায়, সেজন্যে।

যেমন সিঙ্গাপুরে ডিজিটাল যমজ নগরীর একটা কাজ হচ্ছে পরিবেশ দূষণ এড়িয়ে কিভাবে লোকজন পথ চলতে পারে, তার উপায় বাতলে দেয়া।

অন্যান্য জায়গায় এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় ভূগর্ভস্থ রেললাইনের মতো অবকাঠামো কোথায় তৈরি করা হবে, সেই পরামর্শ দেয়ার জন্য।

আর মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে তো এখন বাস্তব জগত আর ডিজিটাল জগতে একই সঙ্গে নগরী তৈরি করা হচ্ছে।

একটি ফরাসী সফটওয়্যার কোম্পানি ডাসল্ট সিস্টেমস বলছে, তাদের ডিজিটাল যমজ প্রযুক্তির ব্যাপারে শত শত কোম্পানি এখন আগ্রহ দেখাচ্ছে।

যেমন ডাসল্টস সিস্টেমস চুল পরিচর্যার প্রসাধনী তৈরি করে এরকম একটি কোম্পানির শ্যাম্পুর বোতলের ডিজাইন করতে সাহায্য করেছে।

অসংখ্য সত্যিকারের বোতল বানানোর বদলে তারা ডিজিটাল ডিজাইন তৈরি দিয়েছিল, এর ফলে অনেক প্লাস্টিকের বর্জ্য তৈরি এড়ানো গেছে।

তারা আরও অনেক কোম্পানিকে অনেক ভবিষ্যৎমুখী প্রকল্পের ডিজাইন তৈরি করতেও সাহায্য করছে- জেটপ্যাক থেকে মোটরবাইক, যেগুলোর আছে ভাসমান চাকা, এমনকি উড়ন্ত গাড়ি।

প্রত্যেকটির আবার একটি বাস্তব প্রোটোটাইপও আছে। তবে প্রথম মডেলটির পরিমার্জনের কাজটি ডিজিটাল জগতেই করা হয়।

এই ডিজিটাল যমজের আসল কদর আসলে দেখা যাবে স্বাস্থ্যসেবায়।

যেমন ডাসল্টের লিভিং হার্ট প্রজেক্টে একজন মানুষের একটি সত্যিকারের হৃদযন্ত্রের অবিকল ডিজিটাল মডেল তৈরি করা হয়, যেটিকে পরীক্ষা করা যাবে, বিশ্লেষণ করা যাবে।

শল্য চিকিৎসকরা এই ডিজিটাল হৃদযন্ত্রকে নিয়ে ধারাবাহিকভাবে অনেক পরীক্ষা চালাতে সক্ষম হবেন।

এই প্রকল্পটির প্রতিষ্ঠাতা ড. স্টিভ লেভিন। এরকম একটা ডিজিটাল হৃদযন্ত্র তৈরির পেছনে তার নিজের একটা ব্যক্তিগত কারণ ছিল।

আশা করা যাচ্ছে ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ তাদের হাতে এরকম ডিজিটাল যমজ তৈরির জন্য যথেষ্ট তথ্য থাকবে।

এতে জোর দেয়া হবে বন্যা, খরা, তাপপ্রবাহ থেকে শুরু করে ভূমিকম্প, আগ্নেগিরির অগ্ন্যুৎপাত এবং সুনামির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার বিষয়কে।

এসব দুর্যোগ মোকাবেলায় এবং মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য বিভিন্ন দেশকে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা দিয়ে সাহায্য করা হবে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

এসবি/