ঢাকা, মঙ্গলবার   ২৬ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১২ ১৪৩১

সুস্থতার জন্য ধ্যান হোক করমুক্ত

সাইফ ইসলাম দিলাল

প্রকাশিত : ০৬:৫১ পিএম, ১৭ জুন ২০২২ শুক্রবার | আপডেট: ১০:৪৩ এএম, ১৮ জুন ২০২২ শনিবার

প্রস্তাবিত বাজেটে মেডিটেশন বা ধ্যানের ওপর ভ্যাট বা মূসক আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর আগেও বাজেটে এ প্রস্তাব থাকলেও তখন মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার কথা বলে প্রত্যাহার করা হয়েছিল। তখন বাজেট বক্তব্যে মেডিটেশনকে মানসিক স্বাস্থ্যের অন্তর্ভূক্ত করার কথা বলা হয়েছে।

বর্তমান অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল মহোদয় এবং মরহুম সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত মহোদয়ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য মেডিটেশন সেবার ওপর ভ্যাট অব্যাহতির কথা বলেছিলেন। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা ভ্যাটের আওতামুক্ত। মানসিক স্বাস্থ্যসেবা হিসেবে মেডিটেশন সেবাও ভ্যাটের আওতামুক্ত থাকবে এটাই স্বাভাবিক।

আমরা যদি উন্নত বিশ্ব বা আমাদের প্রতিবেশি দেশগুলোতে তাকাই তাহলে দেখবো যোগ মেডিটেশন সেবা ভ্যাটের আওতামুক্ত। চিকিৎসাবিজ্ঞান ও বড় বড় গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলছে, মেডিটেশন চিকিৎসারই অংশ।

মনের সার্বজনীন ব্যয়াম হচ্ছে মেডিটেশন বা ধ্যান। মেডিটেশনের নিয়মিত অনুশীলন জাগিয়ে তোলে মানুষের ভেতরের ইতিবাচক সত্ত্বাকে, শুভ শক্তিকে। এর নিয়মিত চর্চায় মনের রাগ, ক্ষোভ, দুঃখ, হাতাশা, মানসিক চাপ দূর হয়। নেতিবাচকতা থেকে ইতিবাচকতায় বদলে যায় দৃষ্টিভঙ্গি। অর্থাৎ মানসিক সুস্থতা থাকলে ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, কর্মক্ষেত্রে সব কিছুতেই প্রভাব পড়ে। তাই মানুষ হতে হবে সম্পূর্ণ সুস্থ।

শারীরিক বা মানসিকভাবে অসুস্থ বা পরিশ্রমে অক্ষম দুর্বল জনগোষ্ঠী কখনো সবল অর্থনীতি গড়ে তুলতে পারে না। মানসিক স্বাস্থ্য ছাড়াও মেডিটেশন চর্চায় ব্যাকপেইন, অস্ট্রিওআর্থ্রাইটিস, অনিদ্রা, আইবিএসসহ নানাবিধ অসুস্থতা কমে যায়। ফলে কর্মস্থলে অনুপস্থিতি কমে, বাড়ে উৎপাদনশীলতা।

২০১৫ সালে জাতিসংঘের ১৭৫ টি দেশ যোগ-মেডিটেশনের মনোদৈহিক উপকারিতার প্রেক্ষিতে ২১শে জুনকে বিশ্ব যোগ দিবস ঘোষণা করে (United Nations A/RES/69/131)। ২০১৫-১৬ বন্ধুদেশ ভারতেও যোগ-মেডিটেশন থেকে সার্ভিস ট্যাক্স প্রত্যাহার করে যোগকে স্থায়ীভাবে ‘Charitable activities’ এর অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে (Notification NO. 20/2015-Service Tax)।

যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও যুক্তরাজ্যে মেডিটেশন ও ইয়োগা সম্পূরক স্বাস্থ্যসেবা। ২০১৮ সালে ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব হেলথ অ্যান্ড হিউম্যান সার্ভিসেস প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, ইয়োগা ও মেডিটেশন কমপ্লিমেন্টারি হেলথ অ্যাপ্রোচ। শরীর ও মনে ভারসাম্য এবং শিথিলায়ন অর্জন করার জন্যে দমচর্চা, মেডিটেশন ও যোগাসন অনুশীলন করা হয়ে থাকে। (ইউএস ন্যাশনাল সেন্টার ফর হেলথ স্ট্যাটিসটিক্স; নভেম্বর ২০১৮)
মেডিটেশন চর্চায় আসে প্রশান্তি, ইতিবাচকতা, কর্মস্পৃহা। কমে টেনশন-স্ট্রেস। যার প্রভাব পড়ে কাজে ও উৎপাদনশীলতায়। উন্নত দেশগুলোতে স্ট্রেস ম্যানেজমেন্টের জন্যে কোটি কোটি ডলার ব্যয় হয় প্রতি বছর। কারণ, কর্মীদের মানসিক সুস্থতা না থাকলে যেকোন প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনশীলতা কমে যায়। আর মেডিটেশনের মাধ্যমে একজন মানুষের টেনশন কমে স্বস্তির সাথে কাজ করলে বাড়ে উৎপাদনশীলতা।

আমাদের দেশের চিকিৎসক গবেষকরাও বলছেন ধ্যান বা মেডিটেশন চিকিৎসা বিজ্ঞানের অংশ। সুস্থ দেহের জন্য যেমন ব্যয়ামের প্রয়োজন, তেমনি মনের সার্বিক সুস্থতার জন্যে প্রয়োজন নিয়মিত মেডিটেশন চর্চার। জাতীয় অধ্যাপক মরহুম অধ্যাপক ডা. নূরুল ইসলাম বলেছিলেন, মানসিক প্রশান্তি ও সুস্থ জীবনধারা হৃদরোগ নিরাময় করে-এটি এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য। নানা গবেষণা আর চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতামতের ভিত্তিতে সত্য প্রমাণিত হয়েছে বলেই মেডিকেল সায়েন্সের প্রধান প্রধান বই ও জার্নালগুলোতে এ কথাগুলো ছাপা হয়েছে।

জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগে. (অব) আব্দুল মালিক বলেন, মেডিটেশন আমাদের মনকে শান্ত করে, বর্তমানে নিয়ে আসে, নিজের প্রতি মনোযোগ দিতে শেখায়। টেনশন ও চাপমুক্তি তখন সহজ হয়। এর পাশাপাশি জীবনের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষন এবং জীবনধারা পরিবর্তন করাও অত্যন্ত জরুরি। তাই মেডিটেশন এখন বিকল্প চিকিৎসা হিসেব স্বীকৃতি পাচ্ছে। বর্তমান সময়ে যত রোগ হচ্ছে তার একটা বড় অংশের কারণ হলো মানুষের ভুল জীবনযাপন।

কানাডায় ডিপ্রেশন রোধে মেডিটেটিভ ট্রিটমেন্ট বেশ জনপ্রিয়। প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের মধ্যে মেজর ডিপ্রেসিভ ডিজঅর্ডার নিয়ন্ত্রণে ২০১৬ সালে ক্লিনিক্যাল গাইডলাইন প্রকাশ করে কানাডিয়ান নেটওয়ার্ক ফর মুড অ্যান্ড অ্যাংজাইটি। টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়া, ইউনিভার্সিটি অব অটোয়া ও ইউনিভার্সিটি অব অটোয়ার একদল মনোবিজ্ঞানী কর্তৃক প্রণীত এই স্বাস্থ্য নির্দেশিকায় ডিপ্রেশন আক্রান্ত রোগীদের জন্য মেডিটেটিভ ট্রিটমেন্ট হিসেবে ইয়োগা ও আকুপাংচারকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। (দ্য কানাডিয়ান জার্নাল অব সাইকিয়াট্রি; ২০১৬)

বহুমুখী গবেষণার প্রেক্ষিতে বলা যেতে পারে, মেডিটেশন সেবা সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিতে পারলে একটি জাতি লাভবান হবে। অর্থনৈতিকভাবে, সামাজিকভাবেও। তাই মেডিটেশন সেবার ওপর থেকে ভ্যাট অব্যাহতি দিয়ে একে তৃণমূলে সর্বস্তরে জনপ্রিয় করার উদ্যোগ নিতে হবে। তাহলেই অর্থনীতির সমৃদ্ধিসহ সার্বিক উন্নতি দ্রুততর হবে।

প্রসঙ্গত: এর আগের বছরগুলোর বিভিন্ন বাজেটে মেডিটেশন সেবাকে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যে উপকারী উল্লেখ করে মূসক অব্যাহতির প্রস্তাব করা হয়েছিল। গত দুই বছরে করোনার আতঙ্ক আর আর্থিক অনটনে বিপর্যস্ত হয়েছে সাধারণ মানুষের জীবন। মেডিটেশন চর্চার মাধ্যমে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ও মনোবল অটুট রাখা যেতে পারে বলে মনে করছে সরকার। যা একাধিকবার অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় ফুটে উঠেছে।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গত অর্থ বছরের বাজেট বক্তৃতায় ‘মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্যে মেডিটেশন সেবার ওপর ভ্যাট অব্যাহতি আরও এক বছরের জন্যে বৃদ্ধি’র প্রস্তাব করেন। 

করোনা মহামারীকালে ২০২০-২১ অর্থবছরেও মেডিটেশন সেবার ওপর থেকে ভ্যাট অব্যাহতির ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। সে বছর বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, বৈশ্বিক এ দুর্যোগকালে জনগণের মানসিক স্বাস্থ্য ও মনোবল অটুট রাখার স্বার্থে মেডিটেশন সেবার ওপর মূসক অব্যাহতি বলবৎ রাখার প্রস্তাব করছি।

২০১৭-১৮ অর্থ বছরের বাজেটে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনেকে একটি সমাজ কল্যাণমূলক কার্যক্রম হিসেবে আমরা বিবেচনা করবো এবং ধ্যান অথবা যোগ-মেডিটেশনের ওপর আগামী দুই বছরে কোন ভ্যাট আরোপ না করার প্রস্তাব করছি।

২০১৪-১৫ অর্থ বছরের বাজেটেও তিনি বলেছিলেন, মেডিটেশন সেবা গ্রহণ করে হতাশাগ্রস্ত অনেক মানসিক ও শারীরিক ব্যাধিগ্রস্ত মানুষ মুক্তির প্রয়াস পায়। সে কারণে মেডিটেশন সেবার ওপর প্রযোজ্য মূসক প্রত্যাহারের প্রস্তাব করছি।

এসি