বাংলাদেশের ফিল্ডিং অবনমন, কেন তা কেউ জানে না!
নাজমুশ শাহাদাৎ
প্রকাশিত : ০৪:৪৫ পিএম, ১৮ জুন ২০২২ শনিবার
সুযোগ তৈরী করেও উইকেট না পেয়ে হতাশ এবাদত হোসাইন
শুধুমাত্র বোলার বার অন্য কোনো ফিল্ডারের থেকে একটু আবেদন উঠলেই এনক্রুমাহ বোনারকে দিনের শুরুতেই ফেরাতে পারত বাংলাদেশ। কিন্তু সেটা হয়নি, রিভিউতে স্পষ্ট দেখা গেছে, এবাদতের বল বোনারের ব্যাট ছুঁয়ে জমা পড়েছে সোহানের গ্লাভসে। শনিবার দ্বিতীয় দিন সকালের ঘটনা এটা।
এর আগের দিন ১০৩ রানে অলআউট হওয়ার পর বিকেলেই তিনটি ক্যাচ ফেলে দেয় টাইগাররা। দ্বিতীয় দিন সকালে, বোলাররা আবারও সুযোগ তৈরি করতে শুরু করেন, কিন্তু ফিল্ডারদের ভাগ্য, সচেতনতা এবং অভিপ্রায়ের অভাব সেই সব ভালো সুযোগগুলোকে একে একে নষ্ট করে দেয়।
অবশ্য লিটন দাস ও মেহেদি হাসান মিরাজ পরের দিকে বেশ ভালো ক্যাচ নিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের লিডকে ১৬২ রানে থামাতে ভূমিকা রাখেন। ইনিংসের শুরুতে সহজ সুযোগগুলো নিতে পারলে যা আরও কম হতে পারত। বাংলাদেশ দল উইন্ডিজের ইনিংসে মোট পাঁচটি ক্যাচ ফেলেছে এবং কিপারও একটি সম্ভাব্য ক্যাচ মিস করেছেন।
এমনকি সাকিবদের ডিআরএস ব্যবহারও খুব যাচ্ছেতাই ছিল। জারমেইন ব্ল্যাকউড ৩৯ রানে এলবিডব্লিউ আউট হয়ে যেতেন, যদি সফরকারীরা ডিআরএস সুবিধাকে কাজে লাগাতেন, কিন্তু তারা তা করেননি। যার ফলে ক্যারিবীয় এই ব্যাটার বেশ খানিকটা ভুগিয়ে শেষ পর্যন্ত ৬৩ রান করে আউট হন।
এছাড়াও, ক্রেইগ ব্র্যাথওয়েট, যিনি সর্বোচ্চ ৯৪ রান করেছেন, তিনিও ০, ১৬ এবং ৬৩ রানের সময় মোট ৩টি সুযোগ দিয়েও বেঁচে গেছেন। এই একজন ব্যাটারই, যিনি ১১ বছর ধরে বাংলাদেশের বিপক্ষে আধিপত্য বিস্তার করে খেলে চলেছেন। তাকে এত ছাড় দেয়াটা ছিল রীতিমত বড় ধরণের বোকামি।
এদিকে বোনার মাত্র ৩৩ রান করলেও ব্র্যাথওয়েটের সঙ্গে তৃতীয় উইকেটে ৬২ রান যোগ করেন। এই ব্যাটারও ব্যক্তিগত ১৪ রানের মাথায় যখন সুযোগ দেন, তা লুফে নিতে পারেনি বাংলাদেশ এবং ২২ রানের মাথায় যখন বলটি উইকেটরক্ষক এবং প্রথম স্লিপের মাঝ দিয়ে ভেসে যায়, তখন সেটিও নিতে পারেনি টাইগাররা। ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থেকে দেখছিলেন নাজমুল হোসাইন শান্ত।
এসব সহজ সুযোগ নিয়ে এ বছরে সব ফরম্যাটেই টাইগারদের ফেলে দেয়া ক্যাচগুলো বাংলাদেশকে ক্ষতি করেছে। চলতি বছরে তারা যে সব ক্যাচ ফেলেছে তার এক-তৃতীয়াংশই ফেলেছে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে। মোট ওঠা ক্যাচের মধ্যে ৮৪টি নিয়েছে এবং ৩৯টিই ফেলে দিয়েছে। টেস্টে এই সংখ্যাটি অনেকটাই কাছাকাছি। এখানে পাওয়া ৬৯টি সুযোগের মধ্যে তারা ২৪টিই ফেলে দিয়েছে।
প্রত্যেকেই তাদের ব্যক্তিগত পদক্ষেপ নেয়ার সিদ্ধান্ত না নেয়া পর্যন্ত এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। বাংলাদেশ দল সম্প্রতি শান্ত, ইয়াসির আলী (বর্তমানে আহত) এবং লিটনকে (যখন তিনি উইকেট কিপিং করছেন না) স্লিপ পজিশনে ফিল্ডিং করাচ্ছে। গত তিন বছরে পাওয়া ১১টি সুযোগের মধ্যে পাঁচটিই নষ্ট করেছেন শান্ত। আর এটা এমন একজন খেলোয়াড়ের সমালোচনা করা হচ্ছে, যিনি তার শেষ ১৭ টেস্ট ইনিংসে মাত্র একটি ফিফটি পেয়েছেন।
সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, এটা একটা বাস্তব সমস্যা। কিন্তু যখনই বিষয়টি উঠে আসে, বিসিবি এবং টিম ম্যানেজমেন্ট রক্ষণাত্মক হয়ে যায়। ফিল্ডিং কোচরা সম্ভবত জানেন কি ঘটছে, কিন্তু তারা এসবের ব্যাখ্যা করার জন্য খুব কমই জনসমক্ষে উপস্থিত হন।
বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞের স্মরণাপন্ন হয়েছে। এর মধ্যে রায়ান কুক এসেছেন এবং গেছেন। রাজিন সালেহকে সাময়িকভাবে একটি সিরিজে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। এখন দায়িত্বে আছেন শেন ম্যাকডারমট- তবে পার্থক্য বা উন্নতি কিছুই লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
চলতি বছরের মার্চে প্রধান কোচ রাসেল ডমিঙ্গো আফগানিস্তানের বিপক্ষে পাঁচটি সাদা বলের ম্যাচে ৯টি ক্যাচ ড্রপ করার জন্য ফিল্ডারদের বিপক্ষে বিস্ফোরণ ঘটান। যদিও ডমিঙ্গো স্বীকার করেছেন যে, কেন এটি ঘটছে, তা তিনি জানেন না।
ডমিঙ্গো তখন বলেছিলেন, "আপনি যখন এটা নিয়ে ভাববেন, তখন আপনার কাছে এটা অবিশ্বাস্যই মনে হবে। যদি আমরা জানতাম, সমস্যাটা আসলে কোথায়, আমরা সম্ভবত তা সমাধান করতাম। এগুলো আসলে একাগ্রতা, আত্মবিশ্বাস বা চাপ মোকাবেলার কারণে হচ্ছে কিনা, আমি শতভাগ নিশ্চিত নই। আমাদের শুধু নিশ্চিত করতে হবে যে, আমরা উন্নতি করার চেষ্টা করছি। আমরা মাঠের মধ্যে অনেক বেশি ভুল করছি, যার জন্য আমাদের খেসারৎও দিতে হচ্ছে। বিশ্বকাপে, এখানে, টেস্ট ম্যাচে আমাদের ক্ষতি হয়েছে। শুধু অনেকগুলো ক্যাচ ফেলার কারণেই। আপনি অনুশীলনে সব কসরত করতে পারেন, কিন্তু খেলোয়াড়দের তো তা মাঠে করে দেখাতে হবে!"
যদিও নির্বাচক হাবিবুল বাশারের একটা তত্ত্ব আছে। গত বছর, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সময় তিনি বলেছিলেন যে, ফিল্ডাররা ভুল করছেন কারণ তাদের ওপর চাপ আসছে।
সাবেক এই অধিনায়ক বলেন, "ব্যাটিং বা বোলিংয়ে আপনার খারাপ দিন যেতেই পারে, তবে আমাদের ফিল্ডিংয়ে আরও ধারাবাহিক হতে হবে। এটি বড় টুর্নামেন্টে আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। মিসফিল্ডিং দলের গতিধারাকে নষ্ট করে দেয়। আমরা একটা ভালো ফিল্ডিং দল, কিন্তু আমি এমনটা বাস্তবেই দেখতে চাই। এই জায়গাটায় অনেক উন্নতি দরকার।"
তিনি আরও বলেন, "প্রশিক্ষণের সময় আমরা প্রচুর ফিল্ডিং করি। আমরা যখন ঘরের মাঠে বা বড় কোনো টুর্নামেন্টে খেলি, তখন মনস্তাত্ত্বিক চাপ সামলানোটা আসলেই গুরুত্বপূর্ণ। আমি মনে করি, আমরা সেই চাপ সামলাতে গিয়েই পিছিয়ে পড়ছি। আমাদের সেরা কিছু ফিল্ডার ক্যাচ ফেলেছেন। আমাদের আসলে চাপের মুহূর্তগুলো কীভাবে সামলাতে হয়, তা নিয়ে কাজ করতে হবে এবং এইসব মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ ক্যাচ নিতে হবে।"
এদিকে, অন্যান্য টেস্ট দলের মতো বাংলাদেশও ডিআরএস নিয়ে বেশ ভুগছে। আগের টেস্ট অধিনায়ক মোমিনুল হকের কেন এতগুলো রিভিউ ভুল হয়েছে- সেই প্রশ্নের উত্তর দেয়াটা তার জন্য সত্যিই কঠিন ছিল। এবার সাকিব আল হাসানের পালা।
বাংলাদেশের বোলিং আসলে এমন একটি বোলিং লাইন আপ, যার কোনো এক্স-ফ্যাক্টর নেই। যেমন- ঘণ্টায় ৯০ কিলোমিটার গতির একজন বোলার বা সত্যিই বিশ্বমানের কেউ এই দলে নেই। যে কারণে উইকেট নেয়ার জন্য ধৈর্য ধরতে হবে। তবে এটা শুধুমাত্র তখনই কাজ করে, যখন আপনার একটি ভালো ফিল্ডিং ইউনিট থাকে, যারা কিনা সব ধরণের ক্যাচ নিয়ে দক্ষতার অভাব পূরণ করতে পারে।
টেস্ট ম্যাচে জয় পাওয়াটা আসলে যথেষ্ট কঠিন, যখন আপনার ব্যাটিং বাংলাদেশের মতো আনপ্রেডিক্টেবল হবে। এখন তাদের ফিল্ডিংয়ের মানও হ্রাস পাচ্ছে, যার ফলে অধিনায়করা উত্তেজিত এবং কোচরা হতবাক।
ক্রিকেট মূলত একটি দলগত খেলা। কিন্তু এগুলো সবই ব্যক্তিগত সমস্যা। যতক্ষণ না কোনো ড্রেসিংরুমের প্রতিটি খেলোয়াড় আরও ভালো হওয়ার ও করার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিশীল হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত সেই দলের ক্ষেত্রে আরও ক্যাচ ড্রপ হবে এবং আরও রিভিউ নষ্ট হবে। এবং ওই দলকে আরও ভুগতে হবে।
এনএস//